Tanmoy Sinha Roy

শিরোনাম :

গৃহবন্দী কে?
গ্যালিলিও , তসলিমা ,
না মনুষ্যত্ব?

তন্ময় সিংহ রায়

ধর্ম বনাম বিজ্ঞান , সাপ আর নেউল-এর এই তীব্র দ্বন্দ্ব আজ আর নতুন কোনো বিষয় নয় ,
এর উৎকৃষ্ট এক ঐতিহাসিক সাক্ষী হয়ে আজও অনড় দাঁড়িয়ে আছেন সেই গ্যালিলিও গ্যালিলেই।
ফলস্বরূপ শেষ পর্যন্ত বিজয়ের শিরোপাটা ছিল কিন্তু সেই বিজ্ঞানেরই।
এমনকি একবিংশ শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী ও বিগ ব্যাং তত্ত্বের প্রবক্তা বিশ্বখ্যাত পদার্থবিদ স্টিফেন হকিংও পর্যন্ত এই বিতর্কে অবস্থান নিয়েছিলেন বিজ্ঞানের পক্ষেই।
আর ধর্মীয় ও রাজনৈতিক গিলেটিনের চাপে পড়ে জীবন ও মহৎ লক্ষ্য পূরণের নিদারুণ ইচ্ছের ধড় থেকে মুন্ডু আলাদা হয়ে যাওয়াটাও নিছক নতুন কোনো ঘটনা নয় , যার উল্লেখযোগ্য ও জীবন্ত নজির হয়ে আছেন সেই গ্যালিলিও , নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু , বর্তমানে তসলিমা নাসরিন প্রভৃতি।
এ হল কিছু চরম স্বার্থান্বেষী ও অন্ধ মানুষ দ্বারা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সৃষ্ট , সেই প্রাচীনকাল থেকে চলে আসা ঈর্ষা এবং হিংসার এক অতি উত্তপ্ত ও ধ্বংসাত্মক আবহাওয়া।

মানবদেহ যেমন ৬০ শতাংশ পরিপূর্ণ
জলে , ঠিক তেমনই , আনুমানিক ধর্মের প্রায় ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ পরিপূর্ণ কল্পনায় এবং এগুলো বংশপরম্পরায় চলে আসা এক দৃঢ় বিশ্বাস।
পাশাপাশি বিজ্ঞান হল সঠিক পর্যবেক্ষণ , কারণ অনুসন্ধান , পরীক্ষা-নিরীক্ষা , সঠিক তথ্য-প্রমাণ ও যুক্তির সংমিশ্রণ , যেখানে কল্পনার স্থান সীমিত।

খ্রিস্টীয় ২ শতাব্দীতে টলেমী বলেছিলেন , ‘পৃথিবী স্থির রয়েছে , আর সূর্যসহ সব গ্রহ আবর্তিত হচ্ছে একে ঘিরে।’
পরবর্তীকালে বিশ্ববিখ্যাত গ্রিক দার্শনিক প্লেটোর বিশ্বপ্রসিদ্ধ ও বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছাত্র অ্যারিস্টটলও বলে গেছেন সেই একই কথা , বা পোষণ করেছেন একই ধারণা।
সবচেয়ে বড় ব্যাপার , এই ভ্রান্ত মতবাদ চলে আসছিল প্রায় দু’ হাজার বছর ধরে , এবং বিশেষত শিক্ষিত মানুষ থেকে মানুষে এর সংক্রমণ পৌঁছে গেছিল প্রায় মহামারি আকারে।
কিন্তু ইতালীয় সেই বিশ্ববন্দিত জ্যোতির্বিজ্ঞানী , পদার্থবিজ্ঞানী ,
গণিতজ্ঞ , দার্শনিক ও লেখক
গ্যালিলিও কিন্তু আদৌ ছিলেন না এই মতবাদে বিশ্বাসী।
বরং তিনি আর্যভট্ট , অল বিরুনী ও আর্কিমিডিসের মতই প্রবলভাবে বিশ্বাসী ছিলেন যাজক নিকোলাস কোপারনিকাসের সূর্যকেন্দ্রিক মতবাদে , অর্থাৎ পৃথিবীসহ সব গ্রহই প্রদক্ষিণ করছে সূর্যকে কেন্দ্র করে।
কিন্তু দীর্ঘদিনের এক শক্ত-পোক্ত বিশ্বাসকে , নতুন একটা বিশ্বাস দিয়ে হঠাৎই ভেঙে ফেলা যে সহজ কাজ নয় , এও তিনি বুঝতে পেরেছিলেন বোধকরি হাড়েহাড়ে।

এদিকে সে সময়ের বুকে দাঁড়িয়ে ক্যাথলিক চার্চের ক্ষমতাশালী পোপরা বিজ্ঞানের বিরোধিতা করতেন একেবারে সরাসরিই।
পাশাপাশি বাইবেলের যুক্তিভিত্তিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দিয়ে তাঁরা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করতেন প্রায় সবকিছুকে বলাটাই এখানে যুক্তিসংগত।
অর্থাৎ কোনো বিষয় যদি বৈজ্ঞানিক যুক্তি-তথ্যের ভিত্তিতে প্রমাণিত হয়েও যায় নির্ভুল সত্যি বলে , তাতেও ছিল তাঁদের তীব্র আপত্তি।
বলা যেতে পারে এও সেই এক ধরণের ঈর্ষা , হিংসা , দম্ভ ও ধর্মান্ধতা , যা সমাজের দু’একটা বিশেষত নির্দিষ্ট ধর্মের ডি এন এ-এর মাধ্যমে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে আজও হয়ে আসছে বহাল তবিয়তে সঞ্চারিত।
যাইহোক , সার কথা , বিজ্ঞানীদের কোনো যুক্তি , প্রমাণ , তথ্য সঠিক প্রমাণিত হলেও দৌড়ে বা লাফিয়ে কোনওভাবেই তা এগিয়ে যাওয়া যাবে না বাইবেলের বিপরীতে।
আর যদিও বা ভুলবশতঃ গেল এগিয়ে ,
তো তাঁদের জীবনে নেমে আসতো অকল্পনীয় এবং অসহনীয় অত্যাচার , এমনকি মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত , এবং এসবের ব্যতিক্রম কিন্তু আদৌ হয়নি গ্যালিলিওর ক্ষেত্রেও।

১৬৩২ সালে ফ্লোরেন্স থেকে ইতালিয়ান ভাষায় গ্যালিলিও প্রকাশ করেন তাঁর বিখ্যাত বই ‘ডায়ালগ কনসার্নিং দ্য টু চিফ্ ওয়ার্ল্ড সিস্টেমস্’ ,
যে বইটা ছিল তিন ব্যক্তির মধ্যে কথোপকথনের উপর ভিত্তি করে।
কেমন ছিল সেই কথোপকথন?
না সেখানে একজন ব্যক্তিকে লেখক কথা বলিয়েছিলেন কোপারনিকাসের সৌরকেন্দ্রিক তত্ত্বকে সমর্থন করে ,
তো অপরদিকে অন্যজন বা দ্বিতীয় ব্যক্তি প্রাণপণে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন যেভাবেই হোক সেই যুক্তিগুলোকে সপাটে আঘাত করে খন্ডন করার , আর তৃতীয় ব্যক্তি ছিলেন নিরপেক্ষ ভূমিকাতেই।
কিন্তু বইটা প্রকাশ পাওয়ার সাথে সাথেই
এক তীব্র দুশ্চিন্তা ও আতঙ্ক যেন গ্রাস করতে শুরু করে চার্চ প্রধানদের , তাঁদের ভয় ছিল এই যে , এই তত্ত্বের বিরুদ্ধে যথাশীঘ্র ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে , বিশেষত পরবর্তীতে তা প্রোটেস্ট্যান্টদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে বাধা পাবে প্রবলভাবে ও বাইবেলের প্রতি বিশ্বাস হু হু করে কমে যাবে বহু মানুষের।
এরপর গ্যালিলিওকে তাঁরা সরাসরি ডেকে পাঠান রোমের পবিত্র দপ্তরে , ও দমননীতি গ্রহণের মাধ্যমে আদেশ জারি করেন যে , কখনই তিনি এ মতবাদ মেনে চলতে কিংবা এর স্বপক্ষে পারবেন না প্রচার করতে।
এমনকি শারীরিকভাবে অত্যাচারের হুমকি দিয়ে তাঁকে দিয়ে স্বীকারও করানো হয়
যে , তিনি তাঁর ডায়ালগ বইতে সমর্থন করেছেন কোপারনিকাসের সূর্যকেন্দ্রিক মতবাদকেই , এবং বৃদ্ধ বয়সেও গ্যালিলিওকে দিয়ে ঘোষণা করতে বাধ্য করানো হয় , ‘আমি ফ্লোরেন্সের পরলোকগত ভিনসেঞ্জো গ্যালিলেই-এর পুত্র ৭০ বছর বয়স্ক গ্যালিলিও গ্যালিলেই আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে শপথ করছি যে , সূর্যই মহাবিশ্বের কেন্দ্রস্থল এবং স্থির ,
এই ভ্রান্ত ধারণা আমি ত্যাগ করছি ও
উক্ত ভ্রান্ত ধারণা বা তথ্য সমর্থন , প্রচার বা ঘোষণা করা থেকে আমি বিরত থাকবো যথাসম্ভব।’

যদিও ১৬১২ খ্রিস্টাব্দে তাঁর লেখা ‘লেটারস অব সানস্পটস’ নামক পুস্তিকা থেকেই সূত্রপাত পোপের সাথে ঠান্ডা লড়াইয়ের ,
যে বইয়ের মূল বিষয়বস্তু হল , সূর্য নিখুঁত নয় , বরং এর গায়ে আছে কালো কালো দাগ , যাকে তিনি অভিহিত করেছেন সৌরকলঙ্ক বলে।
অবশেষে ধর্মদ্রোহীতার গুরুতর অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করে তাঁকে করা হয় গৃহবন্দী।
এরপর নানান দুঃখ , শারিরীক ও মানসিক কষ্ট-যন্ত্রণা এবং অভাব-অনটনের করাল গ্রাসে পড়ে এই অসুস্থ ও কালজয়ী , মহান বিজ্ঞানী অনির্দিষ্টকাল ধরে কারাগার থেকে এক পুরোহিতের বাড়ি ও শেষমেশ ইতালির অন্যতম এক ঐতিহাসিক শহর সিয়েনায় তাঁর নিজের বাসভবন আরসেত্রিতে গৃহবন্দিত্ব কাটিয়ে ১৬৪২ খ্রিস্টাব্দের ৮ জানুয়ারি করেন মর্মান্তিক মৃত্যুকে অনিচ্ছাকৃত বরণ।
বলাবাহুল্য মৃত্যুর তিন বছর আগে তিনি হয়ে গিয়েছিলেন সম্পূর্ণভাবে অন্ধ।

ভাবলে অবাকও হয়ে পড়ে বিষ্ময়ে হতবাক যে ,
শেষমেশ কোপার্নিকাসের তত্ত্বের সমর্থনে গ্যালিলিওর তত্ত্ব যে একেবারে সঠিক , ক্যাথলিক গির্জা কর্তৃপক্ষ এটা আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করেছেন গ্যালিলিওর মৃত্যুর ৩৫০ থেকে ৫১ বছর পর , অর্থাৎ ১৯৯২ সালে।
কিন্তু সত্যি হল সেই আগুন , যাকে ছাই চাপা দিয়ে রাখা যায়নি কোনও দিনও , আর ভবিষ্যতেও যাবে না রাখা।

এদিকে প্রায় সেই একই ফ্লেভার।
অর্থাৎ রাজনীতি ও ধর্মের অপারেশন থিয়েটারের টেবিলে নিয়ে ,
অবৈধভাবে দিনের পর দিন ধরে অজস্র ও ইচ্ছেস্বাধীন কাঁটাছেড়ার মাধ্যমে রক্তাক্ত ও ক্ষতবিক্ষত করার পরেও যে মানুষটার জীবন সমাজের মানুষের জন্যে উৎসর্গীকৃত?
নিজের জন্মভূমি থেকে ২৭ টা বছর
নির্বাসিত হয়ে , সেই স্থানে ফেলে আসা অমূল্য সব স্মৃতিগুলোকে প্রতিদিন , প্রতিরাত দু’বাহুতে আজও আঁকড়ে ধরে , অসহনীয় মানসিক যন্ত্রণা , দুঃখ , কষ্ট নিয়েও যে মানুষটা আজও নির্ভীক সংগ্রামে রত মানুষের আগামীর ভালোর জন্যে?
নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য , শান্তি ও বিলাস-বৈভবকে আজও প্রতিমুহূর্তে নির্দ্বিধায় গলা টিপে হত্যা করেও যে মানুষটা অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে থাকে অবিচল?
তাঁর আদর্শ , চিন্তাধারা , দূরদর্শিতা ,
বুদ্ধ্যঙ্ক , শিক্ষা-দীক্ষা , জ্ঞান-বুদ্ধি ,
যুক্তি-তর্ক , মনুষ্যত্ব , বিজ্ঞান , ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ-এর ওজন যে সবাই পারবে না বহন করতে , এটাই কিন্তু স্বাভাবিক।

সর্বশেষ বলার এই যে , হিন্দু-মুসলমান , বৌদ্ধ , খ্রিস্টান কিংবা জৈন , ইহুদি হওয়া তো সোজা , কিন্তু মানুষ হওয়া বেশ কঠিন।
ধর্ম কমলে , এ পৃথিবীর বিশেষ কিছু আসে যাবে না , বরং মানুষ ক্রমশঃ কমলে ,
এ পৃথিবী নিশ্চিত ধ্বংসের এও হবে এক উল্লেখযোগ্য কারণ।
হোমোহাবিলিসরা কিন্তু না ছিল হিন্দু , না বৌদ্ধ না পারসিক , আর না ছিল ধর্মযুদ্ধে
রত।
কিন্তু হোমোস্যাপিয়েন্সদের ধর্ম ৪৩০০ , আর বিশ্বের বিভিন্ন ভূমি টাটকা লাল রক্তে স্নান করেছে ঠিক সে সময়েই।
সেই আদিকাল থেকেই নানান সংষ্কারও কিন্তু করে আসছে এই মানুষই , সমাজ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে প্রয়োজনে সর্বক্ষেত্রেই সংষ্কার অত্যাবশ্যক , আর বিজ্ঞান বোধহয় হিংসে করেনা ধর্মকে , বিপরীতে বিজ্ঞানই বরং চরম শত্রু কাল্পনিক ধর্মের।

 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *