Taimur Khan

সময়কে চেনার কাব্য
🏞️

অমিতাভ সরকারের ‘অচেনা সময়ের কাব্য'(চতুর্থ সংস্করণ ১৪২৭) সময়কে চেনার কাব্য হয়ে উঠেছে। সহজভাবে সময়কে উচ্চারণ করার এবং উপলব্ধিকে প্রকাশ করার মধ্যে দিয়েই এই যাপিতজীবনের অভিক্ষেপ। কবি বলেছেন:
“অভিমন্যুর চক্রব্যূহে
জীবনের চলচ্চিত্র।”
এই সময়কে বোঝানোর এটিই মনে হয় উপযুক্ত উপমা। কেননা যে সংগ্রামময় জীবনের অভিমুখ কবি অন্বেষণ করেছেন তা গোলকধাঁধার মতো। জয়ের সম্ভাবনা সেখানে নেই বললেই চলে। তাই অসুখকেই সুখ হিসেবে পেতে চেয়েছেন। স্বার্থপর বিবেকহীন আত্মকেন্দ্রিক এই সমাজের কাছে যেন কোনও স্বপনেরই মূল্য নেই। বিভেদ আর দ্বন্দ্বের মাঝখানে পড়ে মানবিক চৈতন্যের জাগরণ কবিকে প্রশ্নব্যাকুল করে তুলেছে:
“আজও রাত আটটায়
আজানের চেনা সুর ভাসে
মানুষ তো একই আছে।
তবু।
অচেনা সময়।”
‘আজানের চেনা সুর’ প্রাত্যহিক জীবনের চেনা ছন্দকে ঘোষণা করলেও কোথাও যেন বিভেদের বাতাবরণ তৈরি হয়েছে। কিন্তু মানুষ?
হ্যাঁ, মানুষ তো বদলাইনি। এখনও মানুষকে নাম ধরে ডাকা যায়। জীবনানন্দ দাশও ডেকেছিলেন:
“যদি ডাকি রক্তের নদীর থেকে কল্লোলিত হ’য়ে
ব’লে যাবে কাছে এসে, ‘ইয়াসিন আমি,
হানিফ মহম্মদ মকবুল করিম আজিজ—

আর তুমি?’ আমার বুকের ’পরে হাত রেখে মৃত মুখ থেকে
চোখ তুলে সুধাবে সে— রক্তনদী উদ্বেলিত হ’য়ে
বলে যাবে, ‘গগন, বিপিন, শশী, পাথুরেঘাটার;
মানিকতলার, শ্যামবাজারের, গ্যালিফ স্ট্রিটের, এন্টালীর—’”
১৯৪৬-৪৭-এ দেশভাগ ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় যে সাধারণ মানুষের মৃত্যু ঘটেছিল, যে রক্ত প্রবাহিত হয়েছিল এখানে তারই উল্লেখ আছে। কিন্তু মানুষের মৃত্যুকে কবির কাছেও অসহ্য মনে হয়েছিল। তারা স্বপ্ন নিয়ে জীবন সংগ্রামে বাঁচতে চেয়েছিল পরস্পর। কেউ মরতে চায়নি। কেউকে মারতেও চায়নি। তবুও মরতে হয়েছিল। সেই হিংস্রতা যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কতিপয় মানুষের লোভ-লালসায় সংঘটিত হয়েছিল তা বলাই বাহুল্য। সেই জীবনের ছায়া বর্তমান জীবনেও পতিত হতে দেখেছেন কবি। তাই ‘মানুষ তো একই আছে।’ পংক্তিটিতে পূর্ণচ্ছেদ ব্যবহার করেছেন। একটি বাক্যেই একটি সময়ের ইতিহাসকে লিপিবদ্ধ করেছেন। তেমনি পরবর্তী একটি অব্যয় ‘তবু’ লিখেও পূর্ণচ্ছেদ ব্যবহার করেছেন, যা সীমাহীন সংশয় এবং অবিশ্বাস নিয়ে বিরাজ করছে। আর শেষ বাক্যটি ‘অচেনা সময়’। চিরচেনা সময়ও অচেনাসময় হয়ে যায়। মানব সভ্যতায় তাহলে ‘মানুষ’ শব্দটার কি কোনো মর্যাদা নেই?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে কবি আত্মবিশ্লেষণ করেছেন। শৈশবের সঙ্গে প্রৌঢ়ের, অতীতের সঙ্গে বর্তমানের, মিথ্যার সঙ্গে সত্যের এবং নিজের সঙ্গে অন্যেরও। জীবনের স্থিতি এসেছে। নীরবতা এসেছে। একান্ত অভিনিবেশ এসেছে। কবি বুঝেছেন মানুষের পরিবর্তন কত দ্রুত হতে পারে। মুখরতা আনন্দউচ্ছ্বাস নিমেষেই মুছে গেছে। কবি বুঝেছেন মানুষ চিরদুঃখী। মানুষ নিজেই জানে না সে কী চায়। কবি বলেছেন:
“ভিতরে ভিতরে আমরা বেশ দুঃখী।
অনেক কষ্ট নিয়ে আমরা বেঁচে আছি।
কাজ আর বিশ্রামের বাইরে
আমাদের অস্তিত্ব আজ পরম শূন্য।”
এই শূন্য অস্তিত্ব নিয়ে শুধু উপলব্ধি হয় ‘বেঁচে আছি’। নিসর্গে নান্দনিক শোভায় মন আশ্রয় পায়:
“একলা মনে বৃষ্টি ঝরে।”
এই বৃষ্টিতে চুমু ঝরে। চাঁদ নামে মেঘের বাসর ঘরে। ফাঁপা মনের ঘরের দেওয়াল বৃষ্টিতে ভিজিয়ে দেয়। মাঝে মাঝে রোমান্টিক হয়ে যান কবি।
সমগ্র কাব্য জুড়েই জীবনের নানা অভিজ্ঞতাকে তিনি সহজ করে বলতে চেয়েছেন। নিজের মতো করে লিখতে চেয়েছেন। কবিতার জটিলতায় তিনি গিমিক সৃষ্টি করেননি। মেধার আলোকে বোধের জগৎকে জটিল করে তোলেননি। আত্মজীবনের পরিধিতেই যা পেয়েছেন তা-ই লিখেছেন। চোখ-কান খোলা রেখে জগৎ-সংসারকে দেখেছেন। একদিকে বাস্তব জীবন, অপরদিকে রোমান্টিক স্বপ্ন-মেদুর এক কাল্পনিক জগতের হাতছানিকেও অস্বীকার করেননি। একবার বলেছেন:
“ভার্চুয়ালি এই জগতে,
আমি-তুমি সব্বাই যন্ত্র।
বোঝা যাক মনটার রসায়ন।
ক্রিয়া-বিক্রিয়া সেই এখানে।”
অন্যত্র আর এক ভিন্ন অভিজ্ঞতা বা ভিন্ন দর্শনও লিপিবদ্ধ করেছেন:
“বইছে বাতাস মৃদুমন্দ,
পৃথিবীতে যেন নেইকো দ্বন্দ্ব,
সবই যেন আজ ঠিকই ছন্দ,
দেখে যেন মনে হয়।”
প্রকৃত শিল্পের বিচারে কবিতাগুলি শিল্পোত্তীর্ণ কিনা সে বিচারের জন্য এই লেখাটি নয়। বরং কবির নিজস্ব অভিজ্ঞতা প্রকাশের দায় কতখানি মানবিক ও সামাজিক দৃষ্টিতেই তা দেখার চেষ্টা করেছি। সে দিক দিয়ে কবি তাঁর বক্তব্য বা বিবৃতি সরাসরি প্রকাশ করেছেন, কোথাও আড়াল করেননি। ছলনারও আশ্রয় নেননি। বিবৃতি বা বক্তব্য এবং পুনঃ পুনঃ সংশয় সূচক শব্দ ‘যেন’এর ব্যবহার সাম্প্রতিককালের কবিতায় খুব একটা দেখা যায় না। কিন্তু এই কাব্যে তা ঘটেছে। ছন্দের ক্ষেত্রেও গতানুগতিকতার ছায়া পড়েছে। ফলে আঙ্গিক গঠনেও বৈচিত্র্য আসেনি। তবে বেশ সম্ভাবনাময় এবং ক্ষমতাশালীও এই কবি।
—তৈমুর খান
অচেনা সময়ের কাব্য:অমিতাভ সরকার,
ওরিয়েন্ট বুক কোম্পানি, ৯ শ্যামাচরণ দে স্ট্রিট, কলকাতা – ৭৩,মূল্য ৭৫ টাকা। প্রচ্ছদ:শঙ্খজিৎ জানা। 🚴

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *