https://www.facebook.com/storyandarticle/posts/253581536569155
নিয়াজুল হক এর কবিতা:সময়চেতনার সঙ্গে আত্মচেতনার সেতু নির্মাণ
তৈমুর খান
আশির দশকে বেশ কিছু কবিতা লিখে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন কবি নিয়াজুল হক (১৯৫৬)। সেই সময়ে নামকরা পত্রিকাগুলি এবং তথাকথিত বাংলার কবিগণও এক ডাকে তাঁকে চিনে নিয়েছিলেন। কিন্তু কবি হওয়ার তথাকথিত যশ-খ্যাতির পিপাসায় তিনি আর অগ্রসর হননি। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ভূমি সংস্কার আধিকারিক হিসেবে চাকরিতে যোগদান করে বাংলার বিভিন্ন এলাকায় ঘুরেছেন। ঘনিষ্ঠ হয়েছেন সাধারণ মানুষের সঙ্গে। কখনো তাদের সঙ্গে মিশে জীবনযাত্রায়ও অংশগ্রহণ করেছেন। সরকারি পোর্টফলিও তকমার কথা ভাবেননি। সেই সময়ে সাহিত্যচর্চা করেননি এমনটি নয়। তবে তা প্রকাশের তাগিদ অনুভব করেননি। মাঝেসাজে কোথাও দু-একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছে। কখনো ছুটে গেছেন কফি হাউস, কলেজস্ট্রিটে কবিদের আড্ডায়। কখনো তুমুল বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছেন। কারও ভালো কবিতা পড়ে কিংবা শুনে বাহবা দিয়েছেন। কদর করেছেন। বই মেলায় গিয়ে ব্যাগভর্তি বইও কিনেছেন। কখনো থেমে যায়নি পড়াশোনাও। এখনও স্মৃতি থেকে ঝরঝরে উদ্ধৃতি দিতে পারেন পঞ্চাশ-ষাট দশকের কবিদের কবিতার পংক্তি। বিদেশি শিল্পকলার নানা আন্দোলনের ইতিহাসও তাঁর মুখস্থ। সাম্প্রতিককালে যেসব নতুন কবিরা কবিতা লিখছেন তাঁদের লেখার ধরনও কোন দিকে, সেসব বিষয়ও তুলে ধরতে পারেন। অবাক লাগে ষাটোর্ধ্ব মানুষটির সাহিত্য সম্পর্কে ব্যাপ্তি ও প্রজ্ঞা দেখে। তাঁর পরিমিতিবোধ এবং জীবন সম্পর্কে আমরা যথেষ্ট ধারণা পেতে পারি তাঁর লেখায়। এখনো কি আমাদের দেখার সময় হয়নি তাঁর সম্পর্কে?
তাঁকে চেনার এবং জানার সময় বহু আগেই হয়েছে, কিন্তু আমাদের উদাসীনতা, আমাদের ক্ষুদ্রতা, আমাদের চেতনাহীনতাই এজন্য দায়ী। হ্যাঁ সত্যি কথাই বলছি, বহু আগে ‘অলীক অর্গান'(১৯৯৫) এবং ‘অশনি অপেরা'(২০১০) নামে দুটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ হলেও আর কোনো কাব্য নিয়াজুল হক প্রকাশ করেননি। অবশ্য কয়েকটি কাব্য সংকলনে তাঁর কবিতা স্থান পেয়েছে। কয়েকটি সাহিত্য সংস্থা তাঁকে সম্বর্ধনা জানিয়েছে। কিন্তু এটাই কি শেষ? যে মানুষটি যৌবন থেকে বার্ধক্যে পৌঁছালেন তাঁর সৃষ্টির দীর্ঘপথ পরিক্রমায়—আমরা কি অন্বেষণ করব না? পাঠকের মনে থাকবে তাঁর দুটি কাব্যগ্রন্থ কীরকম সাড়া ফেলে দিয়েছিল। এতদিনে তাঁর শ্রেষ্ঠ কবিতা প্রকাশ হওয়ার কথা।
মানবজীবনের মৌলিক প্রবৃত্তিগুলিকে যেমন আমরা অস্বীকার করতে পারি না, তেমনি জীবনের স্বপ্ন, বাঁচার সংগ্রাম তাকেও অস্বীকার করতে পারি না। নিয়াজুল হক তাঁর জীবনপরিক্রমার ভাবনায় একদিকে মানবিক চৈতন্যের এই সারাৎসারকে কবিতায় রূপ দিয়েছেন; অপরদিকে মানবিক সভ্যতার নিরন্তর সংগ্রামের ইতিহাস এবং ব্যক্তিভাঙনের সময় নিদর্শ তাঁর লেখনীতে ঠাঁই পেয়েছে। ইহকাল-পরকাল, ধার্মিক-নাস্তিক, মানবিক-অমানবিক, সাধারণ-অসাধারণ, ক্ষুদ্র-বৃহৎ, ত্যাগ ও ভোগ ইত্যাদি এসবের দ্বন্দ্বে সত্য ও মৌলিক জীবনমহিমার প্রাচুর্যকেই প্রশ্রয় দিয়েছেন তিনি। তাই প্রচলিত ধারণা থেকে তাঁর কাব্যবোধকে বিচার করা ঠিক হবে না। অতি সাধারণ এক সরলতা ও স্বচ্ছতা তাঁর জীবন-আদর্শের প্রতীক। তাই তাঁর উচ্চারণেও কোনো জটিলতা নেই। ক্ষুরধার শব্দ প্রয়োগে নির্মেদ কাব্যশরীর, কোথাও সমাজদর্শন, কোথাও জীবনদর্শন, আবার কোথাও আত্মদর্শনের প্রজ্ঞাপারমিতা উচ্ছল হয়ে উঠেছে। কবিতাকে তিনি ভারবাহী শিল্প করে তোলেননি, উপলব্ধির রোদ্দুরচকিত স্পর্শমেদুর আয়না করে তুলেছেন। যাতে আত্মদ্যুতির ছায়া ভেসে উঠেছে, তার সঙ্গে সময় এবং সময়ের অবক্ষয়ী স্বরও।
আমাদের প্রত্যেকের বুকে ‘ঢেউ’ আছে। ঢেউ তো আবেগ, ঢেউ তো জীবনের উল্লাস, ঢেউ তো সংগ্রামী স্পন্দন, ঢেউ তো জীবনপ্রজ্ঞার সম্মোহনী উত্থান। নিয়াজুল হক ‘ঢেউ’ নামের একটি ছোট্ট কবিতায় এই ব্যঞ্জনাগুলিই অদৃশ্য কথনের ভেতর ইঙ্গিত করলেন। consciousness এবং power-কে ‘তুমি’ ব্যক্তিবাচক সর্বনামে সম্বোধন করে লিখলেন:
“তুমি আর চুপ করে থেকো না ঢেউ”
তারপর ঢেউকে ক্রিয়াময় স্বয়ংক্রিয়তায় মানবিক উচ্ছ্বাসের ভেতর চালিত হতে বললেন:
“তোমাকে সমতল থাকা মানায় না
তুমি উঁচু হয়ে ওঠো,
তোমার এক একটা দাবড়ায়
ভেঙে যাক ঘুঘুর বাসা”
সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিতে আমরা এর মধ্যে পেলাম:
১, সাম্যবাদী চেতনা
২, বিপ্লবী চেতনা
৩, মানবিক চেতনা
কবি লিখলেন:
“আমরা চামড়ার জুতো নয়,
সামান্য চটিপায়ে শান্তিতে থাকতে চাই”
ন্যূনতম শান্তি ও সহাবস্থানের পক্ষেই আমজনতার দাবিকে তুলে ধরলেন। সমাজের শ্রেণিবিন্যাসে শোষক-শোষিতের বিভেদ দূর করে রাষ্ট্রযন্ত্রের বৈষম্যমূলক আচরণের প্রতিবাদে তাঁর কবিতা যে তীক্ষ্ণ এবং মেধাবী উত্তরণের অস্ত্র তা বলাই বাহুল্য। কমকথায় বহুকথা বলার, আবেগকে পরিশীলিত বোধের উপলব্ধিতে পরিবেশন করা একমাত্র তাঁর পক্ষেই সম্ভব। আর এই কারণেই তাঁর কবিতা নির্মেদ। শব্দ ব্যবহারেও মার্জিত নিয়ন্ত্রণ এবং বুদ্ধিদীপ্ত প্রয়োগ। ইংরেজি সাহিত্যের বিখ্যাত লেখক অস্কার ওয়াইল্ড একবার বলেছিলেন: “I don’t want to be at the mercy of my emotions. I want to use them, to enjoy them, and to dominate them.”
অর্থাৎ আমি আমার আবেগের দয়াতে থাকতে চাই না। আমি এগুলি ব্যবহার করতে, তাদের উপভোগ করতে এবং তাদের উপর আধিপত্য বজায় রাখতে চাই। নিয়াজুল হক এমন এক ব্যক্তিত্ব তিনি বাস্তবতার মধ্যে থেকেই প্রকৃত সত্যের দাসত্ব করতে ভালোবাসেন। তাই আবেগও সঠিক মাত্রায় নিয়ন্ত্রিত হয় তাঁর কবিতায়। নিয়াজুল হক এর কথনরীতিতেও যে সিঁড়ি এবং চিত্রকল্পের সৃষ্টি হয়, তাতে যেমন চাবুক থাকে, তেমনি প্রশ্নও থাকে। সামাজিক বিবেকের কাছেই তিনি প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন। আপাতত তা হালকা চাল হলেও সিরিয়াস এক ক্রিটিক মুহূর্ত উত্থাপিত হয়। তাই তাঁর কবিতা পাঠ করতে গেলে আগে থেকেই আমাদের তৈরি হতে হবে:
“একজন সাড়ে পাঁচফুটের মানুষকে
প্রথমে ছোট করা হল
তারপর ধুলোয় মিশিয়ে পুনরায় দাঁড় করিয়ে
তাকে অণুবীক্ষণ যন্ত্রের তলায় রাখা হল
এবং যথেচ্ছ বড় করে আকাশে তুলে দেওয়া হল
এর মধ্যেই
গ্রহণ-বর্জন
এর মধ্যেই
যাবতীয় বেলুন ওড়ানো এবং হাততালি
একে তোমরা কী বলবে বলো ?
গ্রহণ না অন্যকিছু ?” (গ্রহণ)
সময়ের ভ্রান্তি এবং রাজনৈতিক মিথ্যাচারের ফানুস আমাদের প্রকৃত সত্য থেকে বিচ্যুত করে চলেছে। তার সঙ্গে মিডিয়ার সংবাদ পরিবেশনাও বড় বিভ্রান্তিকর। সবকিছুর চাপেই নিখুঁত মূল্যায়ন না করে মানুষও দ্বিচারী এবং দুরাচারী। হাততালিমারা পেটুয়া অনুসারীতে পরিণত হয়েছে। সময়কে এভাবেই ধারণ করেছেন কবিতায়। ‘সাক্ষাৎ’ নামের একটি কবিতায় অসুখের সঙ্গে অসুখের সাক্ষাৎ ঘটেছে। ব্রেস্ট ক্যান্সারের সঙ্গে অনিয়ন্ত্রিত ব্লাড সুগার, হার্ট অ্যাটাক, ও বেড়ে যাওয়ায় স্ফীতকায় প্রোস্টেট গ্ল্যান্ডের সাক্ষাৎ। অবক্ষয়ের মাত্রাতিরিক্ত প্রশ্রয়, ব্যক্তি মানুষের অবসাদগ্রস্ততা এই সাক্ষাৎকারের চিত্রকল্পে অভিনব রূপ পেয়েছে। সভ্যতার বা জাতীয়জীবনের কদর্যতা, ভঙ্গুরতা, বিচ্ছিন্নতা, যৌনতা, অনিয়ন্ত্রিত ভোগাকাঙ্ক্ষাকে এই রোগগুলির প্রতীকেই চিহ্নিত করলেন কবি। কবিতায় লিখলেন:
“তুমি যেতে বলেছ
আমি যাব
সঙ্গে করে নিয়ে যাব
আমার অনিয়ন্ত্রিত ব্ল্যাডসুগার,
একবার অ্যাটাক হয়ে যাওয়া হৃৎপিণ্ড,
এবং বিশাল স্ফীতকায় প্রস্টেট গ্লাণ্ড
তোমার ব্রেস্ট ক্যান্সারের সঙ্গে দেখা করাতে ;”
১, ব্রেস্ট ক্যান্সার—দেহবাদের আসক্তির বিষাদ
২, ব্লাড সুগার—অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের প্রবঞ্চনা
৩,হার্ট অ্যাটাক—আত্মকেন্দ্রিকতার ঘোরে পর্যুদস্ত
৪,স্ফীতকায় প্রোস্টেট গ্ল্যান্ড—অতিযৌনতায় বিকলাঙ্গতা
কবিতার শেষ অংশে একটি পংক্তিতে উল্লেখ করলেন:
“অনেক গল্প হবে”
এই গল্প তো সভ্যতা ধ্বংসের গল্প। মৃত্যুর গল্প। রোগগ্রস্ত সভ্যতাকে মিতকথনের অদ্ভুত চিত্রকল্পের মাধ্যমে এভাবে তুলে আনা যায় তা তিনি দেখালেন। মহৎ কিছু অর্জন করতে হলে তা মহৎ ত্যাগের মাধ্যমেই সম্ভব। স্বার্থপরতায় কখনো তা লাভ করা যায় না। বিখ্যাত আমেরিকান কথাসাহিত্যিক নেপোলিয়ন হিলের এই প্রসঙ্গে একটি মন্তব্য উল্লেখযোগ্য:”Great achievement is usually born of great sacrifice, and is never the result of selfishness.”
(Napoleon Hill) অর্থাৎ মহৎ প্রাপ্তি ঘটে মহৎ ত্যাগের দ্বারাতেই। আমাদের যখন ত্যাগ শূন্য, স্বার্থপরতার অন্ধকার ঘনীভূত, তখন গল্পও কুৎসিত অন্ধকারের। এই একটি কবিতা মানবসভ্যতায় সময়চেতনার কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছে।
বাহুবলী থেকে ভণ্ড নেতা-নেত্রী শাসক-শোষক এখন দেশের ক্ষমতা ভোগ করে চলেছে। মানবসভ্যতা সেই কারণেই বিপদের মুখে। কবি বলেন:
“একটা কালো রঙের ভয়
একটা ধূসর রঙের আতঙ্ক
একটা আগুন রঙের দোলাচল
আমাকে গরুর মতো তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে
আমি ছাগলের মতো পাতা খেতে খেতে সরু গলায়
মেমিয়ে উঠছি
মাঝরাতে
আমি শেয়ালের মতো
হুক্কা হুয়া করে উঠছি” (কিছুই জানি না)
অস্তিত্ব বিপন্ন হলে মানবিকবোধের পরিচয়টিও হারিয়ে যায়। আত্ম-অন্বেষণের ভেতর জেগে ওঠে পশুর বহুত্ব নির্ণয়। সংশয় পীড়িত আত্মক্ষরণের বিভ্রমে বিশেষণগুলিও স্বাভাবিকত্ব হারায়। কবিরও তাই হয়েছে। কখনো গরু, কখনো ছাগল, কখনো শিয়ালের রূপ পেয়েছে। অনিশ্চিত জীবনের দিকে কবি অগ্রসর হয়েছেন। ব্যক্তিছায়ার এই ঘোরে নিজস্বতা হারানোর মুহূর্তটিতে আমরা সবাই আক্রান্ত। বিস্কুটের মতো পৃথিবী বহু কৌণিক এবং নকশা কাটা। মানুষও এই নকশা কাটা পৃথিবীর মতো। কিন্তু এই দলে কিছু মানুষরূপী জন্তুও থাকে। যারা সহাবস্থান করতে দেয় না। নিজেকে উত্তুঙ্গ প্রাচুর্যের উপর তুলে ধরে। ক্ষমতায়নের লোভই তাদের লক্ষ্য। উইনস্টন চার্চিল এই কারণেই বলেছিলেন:”I am fond of pigs. Dogs look up to us. Cats look down on us. Pigs treat us as equals.” অর্থাৎ আমি শুয়োরের প্রতি অনুরাগী। কুকুর আমাদের দিকে তাকাও। বিড়ালরা আমাদের দিকে তাকাচ্ছে। শূকররা আমাদের সমান বলে বিবেচনা করে। আমাদের মানব চরিত্র পশুসংকুল জীবনের আধার। ব্যক্তি পরিচয়ের আড়ালে এদেরই বসবাস। এরাই হত্যা করে, হত্যার পরামর্শ দেয়, প্রভুভক্ত হয়, আবার পাও চাটে। স্বার্থপরতার চূড়ান্ত রূপ দেখা যায় কখনো কখনো। আবার আমাদের মধ্যে পুরুষ বেশ্যা, নারী বেশ্যা এবং তৃতীয় লিঙ্গের বেশ্যাও থাকে। রূপকের আড়ালে সেইসব রূপের প্রতিও ইঙ্গিত করেন কবি। কিন্তু একথাও বলতে ভোলেন না:
“ইলিশ মাছের ওপর সবাই একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ে”
পাহাড়ের সামনে দাঁড়িয়ে মানুষের যেমন বিস্ময় প্রকাশ, তেমনি চকচকে ইলিশ মাছের ওপরও ক্রেতা সেজে ঝাঁপিয়ে পড়াতেই সামাজিক পরিচয়টি ফিরে আসে। কিন্তু মানবিক পরিচয়টি খুঁজে পাওয়া যায় না। কারণ পাখি দেখার আনন্দ থেকে পাখি মারার পাগলামিও তাদের মধ্যে আছে। সালিম আলির মতোই তারা অভিনয় করে, আসলে তারা নকল পাখি প্রেমিক।
তাঁর কবিতায় সমাজ জীবনের মানুষের এই মৌলিক পরিচয় থাকলেও দার্শনিক চেতনার গভীর পরিচয়টিও তিনি দিয়েছেন। ‘কালো জলের মৃত্যু’ কবিতায় কবি জানিয়েছেন কালো জলের মৃত্যু আমরা কেউ আটকাতে পারি না। জীবনাবেগের প্রাচুর্যে অবিমিশ্র আমাদের প্রেমস্পৃহার মৃত্যু উপলব্ধ হয়। স্বচ্ছজলে আত্মরতির ছায়া ভেসে উঠলেও কালোজলে তা প্রকীর্ণ অন্ধকারে প্রবহমান। কবিতায় কবি উল্লেখ করলেন:
“আমাদের নিজস্ব রক্তপাত সমূহ
শুধু প্রকাশ্য অথবা গোপনে
নদী হয়ে বয়ে যায়”
আমরা এই নদীর কথা কাউকে বলতে পারি না। প্রত্যেকেই আমরা নদী ধারণ করে বয়ে চলেছি মহা সমুদ্রের দিকে। টি এস এলিয়ট Four quartet কাব্যে Dry salvages অংশে বলেছেন:
“The river is within us, the sea is all about us;”
অর্থাৎ নদী আমাদের মধ্যে থাকলেও সমুদ্র আমাদের চারপাশে। আমরা সমুদ্রে বিলীন হচ্ছি ক্রমশই। কবির দার্শনিক চেতনা সমাজ চেতনার ভেতর দিয়েই প্রবহমান। ব্যক্তিচেতনা সমষ্টি চেতনায় ধাবিত।
নিয়াজুল হক এর কবিতা পড়তে পড়তে সুভাষ মুখোপাধ্যায়েরও কবিতার কথা মনে পড়ে যায়:
“ফুলগুলো সরিয়ে নাও,
আমার লাগছে।
মালা জমে জমে পাহাড় হয়
ফুল জমতে জমতে পাথর।
পাথরটা সরিয়ে নাও,
আমার লাগছে।” (পাথরের ফুল)
ফুল পাথর হয়ে যায় তখন ভার হয়ে বুকের উপর চেপে থাকে। নিয়াজুল হক লিখলেন:
“মৃতদেহ থেকে ফুল সরিয়ে নিয়ে
পাথর রেখে দিন”(পাথর ও ফুল)
তাহলে পাথরও ফুল হয়ে যাবে। সংগ্রামী এবং বিপ্লবী চেতনায় এই পুষ্পশোভিত লাশ কৃত্রিম করে দেয় ভালোবাসাকে। জীবন চেতনাকে ফুলের পাথরে ঢাকা যায় না। কবি আর একবার বুঝিয়ে দিলেন।
‘হাসরের ময়দান’ না কোনো বিশ্বাস থেকে নয়। জীবনের রূপকে ছাগল ও মৃত্যু, পাতা ও গাছের এবং চৌবাচ্চার মাছের মধ্যে সঞ্চারিত করে বেশ মজা পান কবি। কল্পনায় রমণীয় হয়ে ওঠা এক উপলব্ধি মাত্র।
বহু কবির ভিড়েও নিয়াজুল হক এর কবিতা আলাদা করে চেনা যায়। প্রচলিত কথনরীতির বাইরে তিনি কবিতায় গুটিকয় শব্দ সাজিয়ে দেন। ছন্দকে ভেঙে বের করে আনেন পর্বগুলি। চেনা শব্দ, চেনা ভাষাতেও মর্মরিত হয় এক প্রতিবাদী স্বর । ঝরনার মতো সূক্ষ্ম প্রবাহেও তীব্রতা অনুভব করা যায়। সময়চেতনার সঙ্গে আত্মচেতনার সেতু নির্মাণ চলতে থাকে।
https://www.facebook.com/storyandarticle/posts/253581536569155
নিয়াজুল হক এর কবিতা:সময়চেতনার সঙ্গে আত্মচেতনার সেতু নির্মাণ – লেখাটি ফেসবুকে প্রকাশিত হয়ে গেছে । লিঙ্ক https://www.facebook.com/storyandarticle/posts/253581536569155