TAIMUR KHAN

অভিমান পুরের বালক

তৈমুর খান

উনশো নব্বই এবং তার পরবর্তী বেশকিছু সময় ধরে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় কবিতা প্রকাশিত হচ্ছে।বেশকিছু সংকলনেও কবিতা লিখেছি। কিন্তু মন কিছুতেই শান্ত হতে চাইছে না। তরুণ গড়ুরের মতো এক খিদে। আরও লিখতে চাই । আরও এবং আরও।
প্রতিদিনই বিভিন্ন কাগজে লেখা পাঠাই। প্রকাশিতও হয়। কিন্তু আশ্চর্য সেইসব পত্রপত্রিকা যখন অন্যকোনও কাগজে আলোচিত হয়, তখন পত্রিকার সূচিপত্রে থাকা সব কবির নাম উল্লেখ করলেও আমার নামটি উল্লেখ করে না কোনও পত্রিকাতেই। এমনকী পত্রিকার প্রথমেই যদি আমার লেখাটিও থাকে, তবুও আশ্চর্য কৌশলে আমার নামটি এড়িয়ে যায়, একবারও উল্লেখ করে না। সংকলন গ্রন্থগুলির ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। আলোচক আমার নামটি অনুল্লেখ রেখে শেষে ‘প্রমুখ’ শব্দটি ব্যবহার করে। সবক্ষেত্রেই যখন এই অবস্থা তখনই আমার ভাবনায় আসে বিষয়টি।
কেন এরকম হয়? কেন আমার নামটি উল্লেখ করে না? আমি বহুদিন ধরে ভাবতে থাকি। কিন্তু কোনও উত্তরই পাই না।
হ্যাঁ আমার নাম নিয়ে অনেকেই টিপ্পনী করে। একেতো ঐতিহাসিক নাম। দুর্ধর্ষ খুনি একজন লুটেরা এবং হানাদার শাসকের নামে আমার নাম। তাই নাম শুনেও অনেকেই আড়চোখে দেখে। সেই কারণেই কি আমাকে ওরা বাদ দেয়? আমাকে প্রমুখের দলে রাখে?
বহু ভাবনা আসে আমার?
কিন্তু নাম নিয়ে কী হবে?
তা কিছু হোক আর না হোক, বহুদিন থেকে লিখছি তখন সবার নাম নিলেও আমার নাম-ই বা নেবে না কেন?
এই ভাবনা থেকেই একটা অভিমান আসে। নিজেকে গুটিয়ে নিতে থাকি। তারপর যে কবিতাটি লিখি সেটির নাম-ই ‘অভিমানপুরের বালক’:

“অভিমানপুরের বালক

তৈমুর খান

হে বিস্ময় , আমাকে বাতিল করো
তোমার মাহাত্ম্য বাজুক আলোঘরে
আমি শুধু অন্ধকার , লক্ষ্মীহীন , দূরে
একাকী বাজাই বাঁশি অভিমানপুরে

আমি থাকি অনুল্লেখ , প্রমুখের দলে

হে বিস্ময় , মুখ আমি দেখাব না কোনোদিন
তোমার আশ্চর্য পিচ্ছিল পদতলে….”

আলোচক বা সম্পাদকদের ‘বিস্ময়’ বলে সম্বোধন করেছি। এই ‘বিস্ময়’দের সম্মুখে গিয়ে কখনো মুখ দেখাতে চাইনি। এঁদের পদতল বড় পিচ্ছিল মনে হয়েছিল।
আরও বহুদিন পর অভিমান আরও প্রগাঢ় হয়েছিল। বহু জায়গায় সামাজিক অনুষ্ঠানে, অফিসে-আদালতে ‘তৈমুর’ নাম নিয়ে হেনস্তার শিকার হয়ে চলেছি। নামের জন্যই অনেকের অপছন্দের তালিকায়। না, কেউ হৃদয় ছুঁতে চায়নি। মেধাও ছুঁতে চায়নি। অনেকেই কবিতা পড়ে জানিয়েছে ‘আমরা ছদ্মনাম ভেবেছিলাম’। কিন্তু এটাই যে আসল নাম ছিল জানার পর অনেকেরই আফসোস হয়েছে। আমার অভিমান তখন আরও দ্বিগুণ। কী উত্তর দেবো আমি? ইন্টারভিউ বোর্ডে হাসাহাসি করছে অফিসাররা। বুঝতে পারছি এবারও আমার চাকরিটা হবে না। ওরা সন্দেহ করছে: একজন বাঙালির নাম কি এমন হয়? অফিস থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ফিরছি। বিরাট শহরে তখন সন্ধ্যা নামতে শুরু করেছে। আমার একপাটি চপ্পলের ফিতে ছিঁড়ে গেছে। খালি পায়ে হাঁটছি। চাকরির টেনসনে মুখ শুকিয়ে গেছে। ঘামে ভেজা জামাটিতে ছোপ ছোপ শরীরের নুনের দাগ। চোখ ফেটে কান্নার মতো অভিমান বেরিয়ে আসছে। সেদিন বহু রাতে বাড়ি ফিরে যে কবিতাটা লিখেছিলাম তার নাম ‘আত্মবোধন’:

“আত্মবোধন

তৈমুর খান

আমি কেন তৈমুর
আর লোকে কেন লঙ্ বলে ডাকে
ভাবতে ভাবতে অন্ধকার হয়ে যায়
আমার পৃথিবী

চপ্পল ছিঁড়ে গেলে
খালি পায়ে হেঁটে হেঁটে ফিরি
এশহর ধূসর শহরে
আমার কোনো বসতি নেই
সারাদিনের ক্লান্ত সাম্রাজ্য
খণ্ড খণ্ড হয়ে ভেঙে যায়

চেঙ্গিস খাঁর বংশধর সর্বহারার মুকুট পরে
আসন্ন নির্বাক গোধূলিতে চেয়ে থাকি
মেঘেরা ইমারত বানায়

কল্পনার এরোপ্লেন উড়ে যায়
নিসর্গ পথে
চুল এলোমেলো অসংখ্য প্রত্ন রমণীরা চেয়ে থাকে নীল উদ্বাহু শিখরে

অন্ধকার পৃথিবীতে আমার শিহরন লাগে
কলমটি তরবারি হয়ে যায়”
কিন্তু তবুও স্বপ্ন ফুরিয়ে যায় না। একটা শিহরন জেগে ওঠে, কলমটিকে তরবারি ভাবতে থাকি। এই তরবারি নিয়েই আমার যুদ্ধযাত্রা। এক একটি কবিতা হয় তরবারির ঝলকানি। আমি হই অভিমানপুরের বালক। নিসর্গ আকাশের প্রত্ন রমণীরা উদ্বাহু শিখরে আমাকে ডাকতে থাকে। কবি নজরুলের মতোই যেন বলে ওঠি:
“বল বীর
বল চির উন্নত মম শির”
হতাশা যন্ত্রণা আর অভিমান নিয়ে আমার এই অভিমানপুর।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *