
স্মৃতিচারণা
কৈশোরের পাতা থেকে
ম্যায় জিন্দেগি কা সাথ নিভাতা চলা গয়া
হর ফিকর কো ধুঁয়ে মে উড়াতা চলা গায়া….
পর্দায় পয়তাল্লিশ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে ঘাড় বেঁকিয়ে তাকালেন এক উন্নতনাসা পুরুষ। তারপর সামনে ফিরে ধোঁয়ার কুণ্ডলী পাকাতে পাকাতে অসাধারণ ভঙ্গিতে লিপ দিয়ে চললেন মোহাম্মদ রফিকে। রবিবারের সকালে রঙ্গোলির আসরে সেই সম্মোহনী দৃষ্টিতে ঘায়েল তখন এক সদ্য কিশোরী । দেব সাহা্ব ভিন্ন যে আর দ্বিতীয় জানে না।
একখানা মেঘ ভেসে এলো আকাশে
এক ঝাঁক বুনো হাঁস পথ হারালো...
শরতের আকাশ যেন এক পরিপাটি রমনীর মুখের ওপর খেলে বেড়ানো বাঁধ না মানা অলকগুচ্ছ। পরিণত বয়সে বাড়ি থেকে অনেক দূরে কর্মস্থল থেকে সপ্তাহান্তে ফেরার পথে যতবারই শরতের আকাশের দিকে চেয়েছি, পথের দু'ধারে কাশের ঝোঁপ আর মাথার উপরে ভাসমান মেঘেরা জানান দিয়েছে, উমা আসছে...।
আমাদের মেয়েবেলায় এই আগমনী দিনগুলো কিন্তু সির্ফ নিখাদ আনন্দে মোড়া ছিল না। এর আগে পিছে ছিল লম্বা কাজের ফিরিস্তি। প্রথমেই মনে পড়ে ভাদ্দর মাসে সাফাই অভিযানের কথা।
নিত্য দিনের হেঁসেল সামলানোর পর বাড়ির রঙিন শাড়িরা সাদা শাড়িদের হাতে ভাড়ার ঘরের চাবি তুলে দিয়ে মাঠে নেমে পড়তো। সঙ্গে নিত ফ্রক আর হাফ প্যান্টদের। বাড়ির অন্ধকার কোণা থেকে লুকানো আড়শোলাদের বেছে বেছে নিকেশ করা চলত দিনভর। কখনো সখনো উঁচু তাক পরিষ্কার করার জন্য ফুল প্যান্টদেরও ডাক পড়তো। তবে পাছে সম্মানহানি হয়, এই ভয়ে তারা এসব মেয়েলি কাজকে বিশেষ পাত্তা দিত না! ভাদ্রের চরবড়ানি রোদ কিন্তু পুরনো জামা কাপড়ের সোঁদা গন্ধ কাটানোর জন্য একেবারে মোক্ষম দাওয়াই। দিন কয়েক ধরে চলতো, বছরভর দেখা না পাওয়া ন্যাকড়ার পুঁটুলি গুলোকে রোদ খাওয়ানো। সেই কটা দিন যেন ট্রাঙ্ক ,দেরাজ, আলমারিরা বুকের পাষাণ ভার নামিয়ে ক্ষণিক স্বস্তিতে বলে উঠতো, যাক বাবা বাঁচা গেল!
ভোকাট্টা…
তখনো বাংলায় গণেশ চতুর্থী এমন জেঁকে বসেনি। সিদ্ধিদাতার জন্য পয়লা বৈশাখ আর অক্ষয় তৃতীয়াই ছিল বরাদ্দ। বিশ্বকর্মা পুজো থেকেই শারদ উৎসবের কাউন্টডাউন শুরু হয়ে যেত। বাড়িতে বিশ্বকর্মার নামগন্ধও ছিল না। বিশ্বকর্মা পুজো বলতে তখন বুঝতাম, স্বর্ণকারের দোকান ,হার্ডওয়ারের দোকান, কামারশালা অথবা ছোটখাটো যন্ত্রপাতি সারানোর দোকানদারদের দ্বারা আয়োজিত ঘট পুজো। সকাল থেকেই এ বাড়ি ও বাড়ীর ছাদে শুরু হয়ে যেত ঘুড়ির লড়াই। একটু বড় হতেই চোখ চেয়ে দেখলাম বাহন প্রেমিকদের বাহনপ্রেম এই দিনটিতে একটু বেশিই উথলে ওঠে। খেয়াল করলাম রাস্তায় বেড়ানো দু’চাকা,চারচাকা, আটচাকা ,দশ চাকার গাড়িগুলো সব ফুল, মালা, চন্দনে সেজে বিয়ে করতে যাওয়া বর যেন।
এমন আমি ঘর বেঁধেছি
আহা রে যার ঠিকানা নাই…
কিশোরী বেলার দেব আনন্দ ম্যাজিক কাটিয়ে এখন এক বিশ্বকর্মার বরপুত্রের সঙ্গে ঘরবসত। গৃহিণী জীবনের প্রথম পর্বেই সুযোগ মিলে ছিল মাটির পৃথিবীর বিশ্বকর্মাদের দ্বারা আয়োজিত দেব স্থপতির জাঁকজমকপূর্ণ আবাহনের। সে এক অন্য অভিজ্ঞতা। ভাবতে অবাক লাগে, যে দেবতাকে আযৌবন প্রতিবেশীর ঘরে পুজিত হতে দেখেছি ; যার জন্য কোন হেল দোল অনুভব করিনি। তিনি যেন কোন গোপন অভিসন্ধি নিয়ে ঢুকে পড়লেন আমার সংসারবৃত্তের কেন্দ্রবিন্দুতে। আমাকে দেখে বুঝি একচোট মুচকি হেসে বলে উঠলেন-'দ্যাখ্ আর উপেক্ষা করবি আমাকে'!
কহি দূর জব দিন ঢল যায়ে
সাঁঝ কি দুলহান বদনে চুরায়ে
চুপকে সে আয়ে…
আজকের এই আলোকিত বৃত্তে দাঁড়িয়ে মাঝে মাঝেই মন বানজারা হয়ে ঢ়ু্ঁ মেরে আসে দশক কয়েক পুরনো পৃথিবীতে। যেখানে এমনই কাশের গন্ধ মাখা দিনগুলোতে সর্বজয়া তার অপু- দুর্গাকে সঙ্গে নিয়ে জীবনের সেরা লড়াইটা লড়ছেন। সেদিনের সেই সর্বজয়া তার মরনপণ ম্যাচটা জিতেছেন ।তবে আজ ও এদেশের কোণে কোণে হরিহর ও সর্বজয়ারা তাদের স্বল্প সমর্থ্য নিয়ে অপু- দুর্গাদের চোখে স্বপ্ন এঁকে চলেছেন। পুজোর ঢাকঢোল ধুনোর গন্ধ কি পারে তাদের সেই স্বপ্নকে একটু উড়ান দিতে!
স্বনন্দিনী