‪Suprabhat Sarkar

সুপ্রভাত সরকার

গভীর একাকিত্বের কাব্য

💦

তৈমুর খান

🌱

কেন্দ্রবিন্দুতে মাকড়সা, চারিপাশে ছড়ানো আছে জাল। জাল নির্মাণ করেছে মাকড়সা। জাল নির্মাণের উদ্দেশ্য হলো শিকার ধরা এবং নিজের আত্মরক্ষা। এইরকম প্রচ্ছদেই ‘মাকড়সার জাল'(প্রথম প্রকাশ শারদীয়া ১৪২৯) কাব্যের নামকরণের কী সার্থকতা সেটাই উপলব্ধি করা যায়।

যাঁর কাব্যের কথা বলছি তিনি বাংলার বাইরের দিল্লিবাসী কবি সুপ্রভাত সরকার। পেশায় ডাক্তার হলেও নেশায় কবি। আর এই নেশার কারণেই একের পর এক কাব্য লিখে চলেছেন। মূলত কাব্যভাবনাতেই নিজের আশ্রয় রচনা করেছেন। আর এই আশ্রয় মাকড়সার জাল হয়ে উঠেছে।

দীর্ঘ জীবনের ভার বহন করে করে যখন মানুষ ক্লান্ত হয়ে পড়ে, যখন তাঁর চারিপাশে হাত প্রসারিত করে খুঁজতে থাকে আপনজনদের, তখন হয়তো কাউকেই পায় না। হাতে শুধু শূন্যতা উঠে আসে। আর এই শূন্যতাকে কী দিয়ে ভরাট করবেন তা ভাবতে পারেন না। তখনই স্মৃতির জাল বিস্তার করেন আর মাঝখানে তাঁর মাকড়সা সত্তা একাকিত্ব জীবনকে স্থির করার চেষ্টা করেন। কিন্তু সম্ভব হয় না। চারিপাশ থেকে হাওয়া এসে দোলাতে থাকে তাঁর জাল। মৃত্যুর হাওয়া, অসুখের হওয়া, উদ্বেগের হওয়া, যন্ত্রণার হাওয়া, মনখারাপের হাওয়া। সেইসব অভিঘাত অসহ্য হয়ে উঠলে নিজস্ব শব্দের কাছেই ফিরে যেতে হয় তাঁকে। আর তখনই তা কাব্য হয়ে ওঠে। শোক আর স্মৃতি একইসঙ্গে বিরাজ করে। কাঁদায়। কষ্ট দেয়। বিপন্নতার গভীরে ফেলে দিতে চায়।

এই জীবনই সুপ্রভাত সরকারের। অতীতের দীর্ঘ ছায়া এবং বর্তমানের দোলাচল মুহূর্ত অনবরত তাঁকে ক্লান্ত বিধ্বস্ত করে তুলেছে। সেই ‘নিঃসঙ্গ জীবন’ কবিতায় তিনি এভাবে লিখেছেন:

“নিঃসঙ্গ জীবন

ভেঙে পড়ে ব্যর্থতার

বৈচিত্রহীনতায়

চারিদিকে বিহীনতার ছবি

জীবনটাও অসম্পূর্ণ মনে হয়

রৌদ্রের ক্ষীণ প্রখরতা

রাতের অন্ধকার যেন

নিবিড় দুর্বোধ্য

কুহু পাখি ঠোঁটে করে

বসন্তের আলো নিয়ে হয়েছে উধাও

অতন্দ্র, চেয়ে থাকি স্থির

নিষ্কম্প তারাগুলির দিকে”

যে জীবনে বসন্ত নেই, সেই জীবন তো অসম্পূর্ণই। সেই জীবন তো অর্ধমৃতই। নিঃসঙ্গতা এমনই প্রবল হয়ে উঠেছে যে, বৈশাখকেও কবির বাসনাহীন মনে হয়েছে। খালি বাড়ি, স্তব্ধ সিঁড়ি, চারতলার ছাদেও কেউ নেই, শুধু কয়েকটি শুকনো পাতা। নির্জীব শূন্যতার সঙ্গে কবির সংলাপ। একেতো লকডাউন এর সময়কাল, উপরন্তু অসুস্থ জীবন এক আতঙ্কের পরিবেশে কবিকে অবরুদ্ধ করে দিয়েছে। এর থেকে বেরোবার পথ পাননি। বাসনাহীন নিরাসক্ত নির্জনে জ্যোৎস্নাময়ীর কম্পনে রাত জেগে আনন্দ আহরণ করতে চেয়েছেন। আসলে নিজের প্রাণসত্তাকেই উপলব্ধি করতে চেয়েছেন। আত্মরতির অভিরূপ রচনা করেছেন এভাবেই। আর সেই সত্তার সামনেই মুখোমুখি হয়েছেন। আসলে একাকিত্বের তীব্র বোধেই নিজের খণ্ডিত সত্তার বিভাজনকে প্রজ্ঞার সামীপ্য দান করেছেন। তাই ‘তুমি’ সম্মোধনটিও কবিতায় বারবার ব্যবহৃত হয়েছে। এই ‘তুমি’ যেমন প্রিয়তমা, তেমনি প্রাণপ্রিয়, তেমনি ঐশ্বরিক সত্তার প্রতিরূপও। মাঝে মাঝে বাস্তবের মধ্যেও অতিবাস্তবের চলাচল এই কারণেই সম্ভব হয়েছে। নিজেকে উপলব্ধি করে একান্ত আত্মকথনে লিখেছেন:

“জীবনের শীর্ষ অভিজ্ঞতায় এসে বুঝলাম

আমি একটা এক্সপায়ার্ড ডেটের ওষুধের শিশি

পড়ে আছি তাকের এক কোণে

অভিমানে কান্না গিলি

খোলা ঘর ধুলোবালির পরিচ্ছদে

নিজের সত্তা হারিয়ে যাচ্ছে

অন্য ওষুধের শিশিরা কটাক্ষ করে আমায়

সুসময় যখন ছিল আদর যত্ন পেয়েছি অনেক,

পুরনো কথাগুলি

ভেবে মন বড়ো নিরাসক্ত হয়

আত্মবেদনায় আমার শরীরের

রক্ত পুঁজ হয়ে যাচ্ছে, ক্লিশিত-ক্লিশ্য

নেই কি এমন কোনো মহানুভব

যে আমার এই পচনশীল গলিত নিথর

শরীরটাকে ভাগাড়ে ছুঁড়ে ফেলে দেয়

ভঙ্গুর শরীর আমার খানখান হয়ে যায়

অবজ্ঞার অভিশাপ থেকে পায় মুক্তি

আমি সত্যি বড়ো নিগৃহীত বড়ো নিঃসঙ্গ”

জীবনের এই অভিমান, নিজেকে ধ্বংস করে দেওয়ার প্রগাঢ় ছায়া পড়েছে কবিতাগুলিতে। বিন্দু বিন্দু কান্না জমা হয়েছে শব্দে। আর্তনাদ গুমরে উঠেছে। যদিও তিনি মানুষকে ‘নীলকন্ঠ’ হতে বলেছেন। অস্তিত্ব রক্ষার জন্য সংকটে দাঁড়াতে বলেছেন। দিল্লির যিশুকে দেখেছেন ধৈর্য ধরে অগ্রসর হতে। শঙ্খধ্বনি শুনেছেন। নবযৌবনের সংরাগে উদ্ভাসিত হতে দেখেছেন তরুণ যুবককে। তবু এক শূন্যতা কবিকে গ্রাস করেছে। অনেক রাতে শূন্য রাস্তায় নিজেকে একাই আবিষ্কার করেছেন। কেউ নেই, কিছু নেই। কিন্তু এক গভীর অসীমতা আছে। ছাদের ফাটা আলসের পরে মোহমুগ্ধ জ্যোৎস্না হুমড়ি খেয়ে পড়লে কবি তাকে সাবধান করে বলেন: “ওরে আর ঝুঁকিসনে পড়ে যাবি”। তখনই মনে হয় একাকিত্ব যতই ধ্বংস করুক, একাকিত্ব সম্রাটও করে দিতে পারে। এই কারণেই

আমেরিকান ধর্মতাত্ত্বিক,দার্শনিক ঈশ্বর এবং আধুনিক সংস্কৃতির প্রবক্তা পল জোহানেস টিলিচ (জন্ম ২০আগস্ট, ১৮৮৬,স্টারজেডেল, ব্র্যান্ডেনবার্গ, জার্মানি—মৃত্যু ২২অক্টোবর, ১৯৬৫,শিকাগো,ইলিনয়,মার্কিন) বলেছেন:

“Loneliness expresses the pain of being alone and solitude expresses the glory of being alone.”

অর্থাৎ একাকিত্ব একা থাকার বেদনা প্রকাশ করে এবং একাকিত্ব একা থাকার গৌরবও প্রকাশ করে।

আলোচ্য কাব্যটি এই বেদনা ও গৌরবের যুগপৎ সৃষ্টি, যেখানে মানবিক চেতনার সঙ্গে ঐশী চেতনা, জীবনের সঙ্গে মৃত্যুর সংঘর্ষ বর্ণিত হয়েছে। হয়তো এই গভীর একাকিত্ব না এলে এ কাব্যও লেখা সম্ভব হতো না।

🍁

মাকড়সার জাল: সুপ্রভাত সরকার, আনন্দধারা, ডি-৬৫৬,চিত্তরঞ্জন পার্ক, নিউ দিল্লি – ১১০০১৯,চলভাষ:৭৮৩৮৮৭৮৫৩৩, মূল্য:কবিতার মূল্যায়ন করা যায় না। প্রচ্ছদ : পরিমল পাত্র।

ছবিতে সুপ্রভাত সরকার

সুপ্রভাত সরকার
আলোচক ড. তৈমুর খান

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *