Sumit Sen

রূপকুন্ডের পথে
ষষ্ঠ পর্ব।
সুমিত সেন।

আজকের (২৮/০৮/৯৬) গন্তব্য বগুয়াবাসা। উচ্চতা ১৪৬৫৫ ফুট। মোটামুটি সকাল সকাল বেড়ানো গেল। আজকের সকাল টা বেশ রৌদ্যকরজ্জ্বল ছিল। বৈদিনীকুন্ডু অতিক্রম করার পর শুরু হল চড়াই। মাটি ভেজা। পথের দু পাশে হলুদ, নীল, লাল পাহাড়ী ফুলের শোভা । পৌঁছলাম ঘোড়া লোটানি। সামনে ঘনকালো পাথরের কালিডাক পর্বত। রজত শুভ্র বরফ ছড়িয়ে রয়েছে তার মাথায়। মেঘের কারণে তা অবাধ দৃশ্যমান নয়। এরপর শুরু হল উৎরাই। দ্রুত নেমে এলাম, হাজির হলাম পাথরনাচুনী তে। উচ্চতা ১২৮০০ফুট। পুরো পথটা ই চড়াই এবং উৎরাই। রাস্তা খুবই খারাপ। বেশ অনেকটা চড়াই পার হয়ে পাথরনাচুনীর টপ। এরপর কৈলুবিনায়ক। উচ্চতা মোটামুটি ১৪২০০ মত। মধ্য দুপুর, খুব জোরে হাওয়া বইছে। চড়াই এবং খুব খাঁড়া রাস্তা। বিশাল ন্যাড়া পাহাড়গুলো পেরিয়ে চলেছি। খুবই ক্লান্ত লাগছে। উচ্চতা জনিত কারণে শ্বাসকষ্ট ও হচ্ছে, আমি ক্রমশ অসুস্থ হয়ে পরছি। এর পর আবার বৃষ্টিও শুরু হয়ে গেল। ক্লান্ত শরীরে অবশেষে পৌঁছানো গেল বগুয়াবাসায়।
আমার শরীর অসম্ভব রকম খারাপ। জ্বর, মাথাব্যথা, পা ছিঁড়ে যাচ্ছে মনে হচ্ছে। একজন কুলি এসে গ্লাস ভরে চা দিয়ে গেল, সঙ্গে ঔষধ ছিল। খেলাম। একজন কুলি এসে জিজ্ঞাসা করল কাল খচ্চর লাগবে কি না। ভীষণ মানে লাগল। এতদূর হেঁটে এসেছি, আর একদিন মাত্র হাঁটতে পারব না? কোনরকমে কিছু খেয়ে শুয়ে পরলাম গাইড কুলিদের রান্না করার জায়গার পাশে। আগুনের তাপ টা খুব আরামদায়ক। বোধহয় শোয়া মাত্রই ঘুমিয়ে পরেছিলাম।

সপ্তম পর্ব।

বেশ ভোরবেলা পাখির কলরবে ঘুম ভাঙল। কুলি- কুক রা রান্নার তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছে ইতিমধ্যেই। এর মধ্যে আমাদের গ্রুপ এর কয়েকজন সদস্য এসে জিজ্ঞাসা করল আমি কেমন আছি, রুপকুন্ড যেতে পারব কিনা, কেউ কেউ আমাকে ট্রেকারস হাটে থেকে যাবার ও পরামর্শ দিল। আমি প্রত্যয়ের সঙ্গেই বললাম যে এখন আমি বেশ সুস্থ বোধ করছি, আমি যেতে পারব।

আজ (২৯/০৮/৯৬) সেই আকাঙ্খিত দিন। বহু আকাঙ্খিত রুপকুন্ড দর্শন এর দিন। তৈরী হয়ে নিলাম তাড়াতাড়ি। বাইরে এসে দাঁড়ালাম। এখন ও অনেকের তৈরি হওয়া বাকি কেননা আমি অনেক আগেই ঘুম থেকে উঠে পরেছিলাম তাই তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে গিয়েছিলাম। বাইরে এসে পায়চারি করতে লাগলাম। অপরূপ দৃশ্য। স্তরে স্তরে তুষারশুভ্র আকাশ ছোঁয়া পাহাড় শিখর, সূর্য ওঠার আগে লাল রং লেগে ঝকমক করছে। আপন মনে গেয়ে উঠলাম ” মহাবিশ্বে মহাকাশে… “।
যাত্রা শুরু করতে করতে প্রায় ৮ টা বেজে গেল। পুরো পথটা ই প্রায় চড়াই। খুব ই কষ্টকর ট্রেকিং। আমার তো মনে হল প্রায় 45 ডিগ্রী এঙ্গেলে খাড়াই। (অত টা না হলেও বেশ কষ্টকর যাত্রা পথ)। খুব কষ্ট হচ্ছিল হাঁটতে। একজন কুলি আমার কোমর জড়িয়ে পাশাপাশি চলতে লাগলো। শুরু থেকেই আমি ছিলাম অনেক পেরিয়ে। আমি প্রায় ১১ টা নাগাদ রুপকুন্ড পৌছালাম। সঙ্গীরা অনেক আগেই (প্রায় আধ ঘন্টা) সেখানে পৌঁছে গিয়েছে। পথে ব্রম্ভকমল, হেমকমল ইত্যাদি অধিক উচ্চতার পাহাড়ী ফুল দেখতে পেয়েছিলাম। রুপকুন্ডের উচ্চতা ষোল হাজার ফুট এর বেশী। চারিদিকে বরফের ঢালে ঘেরা বরফাবৃত রুপকুন্ড। আমি পৌঁছানো মাত্রই আমাদের টিম লিডার বাপীদা আমাকে জড়িয়ে ধরল।

রূপকুন্ডের গল্প টা গাইডের কাছে আবার শুনলাম। বনবিভাগের কর্মচারীদের কথামত অনেক আগেই কঙ্কাল পাওয়া গিয়েছিলো। আমার মনে হল এখানে হয়তো কোন এক সময়ে জনবসতি ছিল, আবহাওয়া বদলের সাথে সাথে নানা ভাবে মানুষ মারা যান। তবু গাইড যখন বললো যে খুলিতে আঘাতের চিহ্নের কথা, তখন মনে হল হয়তো কোন জনগোষ্ঠীর মধ্যে মারামারি হয়েছিল, তাই এমন হয়েছে।
অনেক ছবি তোলা হল, পুজো দেওয়া হল। কঙ্কাল এর হাড়, খুলি, পা – এসব নিয়েও রাজীব অনেক ছবি তুললো। প্রায় ঘন্টা দুয়েক থাকার পর আবার ফিরে এলাম বগুয়াবাসায়।

বগুয়াবাসায় বিকেল টা খুব ভাল ভাবে উপভোগ করলাম। মৌন পাহাড়ের সৌন্দর্য্য অপরূপ। এতদিন মাথা উঁচু করে উপর দিকে তাকিয়ে মেঘ দেখেছি, আজ মাথা নিচু করে নিচের দিকে তাকিয়ে মেঘ দেখলাম। এটাও একটা বিরল অভিজ্ঞতা আমার কাছে। শেষ বিকেলের হালকা নরম রোদ পাহাড়ের গায়ে আর তার সাথে মেঘের রুপবিস্তার, সে এক নয়নাভিরাম দৃশ্য।
সন্ধ্যায় পাহাড়ের আবার অন্য রুপ। যেন মৌন মুনি। আকাশে মেঘ এবং ভীষণ ঠান্ডা থাকাতে তা আর বেশিক্ষণ উপভোগ করা গেল না। ট্রেকারস হাটে ঢুকে পরলাম।

পরদিন বগুয়াবাসা থেকে দিদিনা আর তার পরদিন দিদিনা থেকে গোয়ালদাম এসে পৌঁছেছিলাম। উচ্চতা জনিত কষ্ট ক্রমশ কমতে থাকায় পথ চলায় আর কোন কষ্ট হয়নি।
দিন কয়েক গোয়ালদাম, রাণিক্ষেত, নৈনিতাল এ বিশ্রাম নিয়ে কাঠগুদাম এক্সপ্রেস এ কলকাতা ফিরলাম।

সমাপ্ত।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *