ধারাবাহিক গল্প
সুমনা চক্রবর্তী
মেঘের দেশে ( পর্ব – ৩)
রাতে ঘুম হয়নি আবিরার। ভোর রাতে আলো এসেছিল ঘরে। সেই তখন থেকেই সে জেগে। রাতে ভাত আর দেশি মুরগীর ঝোল খেয়ে শুয়েছিল। কে জানে, সেই জন্যই মনে হয় ঘুম আসেনি। বাড়িতে রাতে সে হালকা খায়। এখানে আর এসব কিছু বলা হয়নি। আর তো এক রাত। কেটে যাবে কোনওভাবে। কান, মাথা ভালো করে ঢেকে দরজা খুলে বাইরে গেল সে। ঠাণ্ডা ভাবটা গায়ে লাগতেই মনটা আবিরাকে ছেড়ে বেপাত্তা হয়ে গেল। সামনে তাকাতেই আবিরা দেখল সোনালি রঙ গায়ে মেখে স্নান করছে কাঞ্চনজঙ্ঘা। কিছুক্ষণের জন্য সবকিছু ভুলে আকণ্ঠ প্রকৃতির এই অপূর্ব দৃশ্য পান করছিল সে। পিছন থেকে তামাংজির গলা পেতেই সে তাড়াতাড়ি ছবি তুলতে শুরু করে দিল। তামাংজি বাগান থেকে শাক তুলতে তুলতে বলল, “ ইতনা সারা তসবীর সে কেয়া কাম ম্যাদামজি। কাল ভি তো বহুত ফটো হুয়া। ইসমে কেয়া হ্যায়?”
একটু হেসে আবিরা উত্তর দিল, “ জান হ্যায়”।
তামাংজি বলেই চলল, “ তব তো আপ কো ইস কে পাসই র্যাহেনা পারেগা। রুখ সাকো গি?”
আবিরা ঢালের দিকে একটু এগিয়ে গিয়ে বলল, “ রুখনা নেহি তামাংজি, চলনা হ্যায়। আব তো উসকে পাস যা করই শান্তি মিলেগি”।
তামাংজি শাক হাতে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “ বহুত খুব কাহা আপনে। হামারে পাস ইয়ে ছোটা সা ঘর, গার্ডেন, থোরা পায়সা হ্যায়। কেয়া ইয়েহি জিন্দেগি হ্যায়? দিল সে কাহু তো কুছ নেহি হ্যায়। আগর ইয়ে পাহাড় নেহি হোতা তো হাম সব জিন্দা নেহি র্যাহেতে ম্যাদামজি। ইয়ে তো হামারা ভাগবান হ্যায়”।
আবিরা একদৃষ্টে তাকিয়েছিল তামাংজির দিকে। সদা হাসিমুখে থাকা এই মানুষটাও কাঞ্চনজঙ্ঘার কাছে নিজেকে সঁপে দিয়েছে। পার্থক্য শুধু একটাই যে, এরা এদের পায়ের বেড়ীটা খুলতে পারবে না। বছরের পর বছর কয়েক প্রজন্ম ধরে এভাবেই এরা এদের শিকড় শক্ত করেছে। শিকড়ের টানটা এদের কাছে অনেক বেশি। তাই ঘরে লুকিয়ে চোখের জল মুছবে তবু ছিন্নমূল হবে না। একদিকে ভালো এই জীবনযাপন। মনের চেয়ে শরীর বেশি প্রাধান্য পায় এখানে। আরে বাবা, খিদে পেলে খাও, ঘুম পেলে ঘুমাও, রাগ হলে দ্যাখাও। খুব সহজ হিসাবে জীবন অঙ্ক মিলে যায়। আর তার মতো যদি মনকে বড় করে দ্যাখা হয়, তাহলে এত সহজে জীবনের অঙ্ক মিলবে না। আবিরার অবশ্য এসবে কিছু যায় আসে না। সে তো অঙ্ক মেলাতে বসেনি। সে জীবনকে দেখতে চায়, জানতে চায়। যত নতুনকে দেখবে, জানবে, তত সে ভেতর থেকে মজবুত হবে। নিজেকে আরও কঠিন করে নিতে পারবে। সে জানে, তার এই ফর্মুলা সকলের জন্য নয়। আর সকলের সহজ হিসেবটাও তাই তার ক্ষেত্রে খাটে না।
রোদ চড়া হচ্ছে দেখে আবিরা নিজের ঘরের বারান্দার দিকে সরে এল। বারান্দা বলতে ঘরের সামনে একটু বাঁধানো খোলা জায়গা। যেখানে বসে থাকলেই সব অসুখ সেরে যাবে। সিমান্দারার শেষ প্রান্ত তামাংজির বাড়ি। আর তারপরই অন্য সীমানা শুরু। এই বারান্দায় বসে ডানদিকে সিকিম, বাঁদিকে দূরে দার্জিলিং আর সামনে সেই পাহাড়, যার মাথার ওপর দিয়ে সিকিম থেকে হুশ করে বিমান উড়ে চলে যেত। তামাংজির কথায় এখন সেই বিমান আর চলে না। কারণ তার জানা নেই, সে জানতে চায়ও না। ঐ সময় তার বাগানে কাজ করলে কাজে দেবে। কিন্তু আবিরার কারণটা জানা খুব দরকার। এমন সুন্দর প্রচেষ্টা বন্ধ হল কেন এটা বলতে পারবে একমাত্র আর্মি। অতএব, আবিরা মনে মনে ঠিক করল আর্মির সাথে যে ভাবেই হোক দ্যাখা করতেই হবে।
তামাংজির রান্নাঘরটা অফিসের মত। একদিকে রান্নার কাজ হয়, একদিকে খাওয়া হয় আর একদিকে কাগজে,কলমে হিসেব করা হয়। রান্না কিন্তু এই ঘরে হয় না। এই ঘরের সাথে লাগোয়া কাঁচা ঘরে মাটির উনুনে রান্না হয়। তামাংজি আর তার স্ত্রী মিলে নিজে হাতে সব রান্না করেন। অতিথি সেবার সুযোগ তারা দুজনেই ছাড়তে চায় না। আবিরা মন দিয়ে চাপাটি আর ঢ্যাঁড়শের তরকারি খেতে লাগল। খিদেটা যেন আরও বেড়ে গেল। একটু বেশি করে জলখাবার খেলেই ভালো। একটু পরেই সে বেরোবে আপার পেদং এর দিকে। পথে ভারী কোনও খাবার পাওয়া যাবে না। তাই পেটটা ভরা থাক। যদি খিদে পায়, তবে বিস্কুট দিয়ে কাজ চালিয়ে নেওয়া যাবে।
আবিরা ছোট ব্যাগটা কাঁধে নিতেই হাসিমুখে মঙ্গল এসে দাঁড়াল। “ চলে ম্যাদামজি?”
আবিরাও হেসে মাথা নাড়ল। তারপর দুজনে ধীর পায়ে সবুজ ঘাসের ঢাল বেয়ে উঠতে লাগল রাস্তায় পৌঁছানোর জন্য। হাঁটতে হাঁটতে আবিরার মনে হল, এই রাস্তায় চলাফেরা করতে হলে আপাতত শরীরটাকে মজবুত করতে হবে। তা না হলে হামাগুড়ি দেওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না।
মঙ্গলের গাড়িতে বসতেই মোবাইল বেজে উঠল। আবিরা দেখল সোমনাথ ফোন করেছে। সে ফোনটা ধরে বলল, “ হ্যাঁ বল”।
ওদিক থেকে সোমনাথ বলল, “ স্যার একটু তোর সাথে কথা বলতে চান”।
কয়েক সেকেন্ডের জন্য আবিরার সবকিছু গুলিয়ে গেল। বাবা কথা বলবে তার সাথে? সে কিছু বলার আগেই ওদিক থেকে ব্যস্ত গলা বলে উঠল, “ শিলিগুড়ির সাথে পাহাড়ের কানেকশন বন্ধ হয়ে গেছে। তুমি বোধহয় খবর পাওনি। এখনই ফেরার চেষ্টা করোনা । সব ঠিক হয়ে গেলে আমি সোমনাথকে বলে দেব কি করতে হবে। আর হ্যাঁ, তোমার লাস্ট প্রোজেক্ট টা আমি দেখেছি। ভালো হয়েছে। টেক কেয়ার”।
ফোনটা ছেড়ে দিয়ে আবিরা চোখ বন্ধ করল। নাহ, তার হিসেব তো মিলে যাওয়ার নয়। তাহলে কি সোমনাথ তার হয়ে কলম ধরল?