ধারাবাহিক গল্প
সুমনা চক্রবর্তী
মেঘের দেশে(পর্ব – ৪ )
মঙ্গল থাকে তামাংজির বাড়ি থেকে পাঁচ কিলোমিটার নীচে ফুরুন্ত বস্তিতে। ওর বাবা ঐ গ্রামের প্রধান। বাড়িতে ওরা সকলে মিলেমিশে কাজ করে। ওর মা রান্না করলে বাবা পরিবেশন করে। ও নিজে বাসন মাজলে ওর স্ত্রী ঘর পরিষ্কার করে। শুধু ঘরের কাজ নয়। ওরা প্রত্যেকে অন্য অনেক কাজের সাথে যুক্ত। মঙ্গল নিজের গাড়ি চালায়। পর্যটকদের শিলিগুড়ি থেকে তাদের পাহাড়ের নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে দেয়। আবার কেউ আগে থেকে বলে রাখলে কোনও জায়গায় ঘোরাতেও নিয়ে যায়। এই যেমন আবিরার সাথে মঙ্গলের দেখা হয়েছিল দুদিন আগে। কারসিয়াং থেকে মঙ্গলই তাকে সিমান্দারা পৌঁছে দেয়। আর পাঁচটা সাধারণ গাড়িচালক যেমন হয় মঙ্গলও তেমন। আবিরার তাও ওকে সবার থেকে আলাদা মনে হয়েছে। এই পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর একটা রীতি আছে। ওরা সমবেত হয়ে থাকতে চায়। তাই এতদিন শুধু চাষের কাজ, দোকান আর ফাইফরমাশ খাটাই এদের লক্ষ্য ছিল। কিন্তু মঙ্গলের মতো মানুষের জন্য এরা নিজেদের গণ্ডী ছেড়ে বাইরে বেরোতে পারছে।
সোমনাথের ফোনটা পাওয়ার পর থেকে আবিরার কিছু ভালো লাগছিল না। সে জানলার দিকে শূন্য চোখে চেয়ে বসেছিল। গাড়িটা থেমে যেতে তার হুঁশ ফিরল।
পিছনের দরজা খুলে মঙ্গল হাসিমুখে বলল, “ আসুন ম্যাদামজি”।
আবিরা গাড়ি থেকে নেমে এল। গাড়িটা যে বাঁকের কাছে দাঁড়িয়েছে, সেখান থেকে সোজা দুপা হেঁটে আবিরার পা থেমে গেল। তার সামনে অর্ধেক পৃথিবী। কাঞ্চনজঙ্ঘার অনেকখানি এখন সে দেখতে পাচ্ছে। সূর্যের আলো পাহাড়চূড়ার ওপর ছড়িয়ে আছে। এই দৃশ্য ভোলার নয়, এই ছবি ক্যামেরাবন্দি করারও নয়। এ শুধু মনের মণিকোঠায় যত্ন করে রেখে দেওয়ার ছবি। জনমানব শূন্য এই জায়গায় মঙ্গলরা আসে বলেই তো আবিরার মতো মানুষরা প্রকৃতির আরও কাছে চলে আসতে পারে।
গাড়িতে ওঠার সময় আবিরা বলল, “ এখানে গাড়ি থামিয়ে খুব ভালো করেছো । থ্যাংক ইয়ু”।
মঙ্গল গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বলল, “ আপ কলকাতার লোক না অল্পতেই খুশি হয়ে যান। ইস লিয়ে আপ ফাস যাতে হ্যায়”।
আবিরা একটু নড়েচড়ে বসল। “ কেন? আমি তো ঠিক কথাই বলেছি। তুমি একটা ভালো জায়গায় নিয়ে এলে বলে তোমায় থ্যাংকস জানালাম”।
মঙ্গল ঘাড় নেড়ে বলল, “ পাহাড়ে চলতে গিয়ে এরকম অনেক জাগা পাবেন। শুধু চোখটা খোলা রাখবেন। নিজেই তখন সব দেখতে পেয়ে যাবেন। দু, তিন সাল বাদ দেখবেন এই জায়গাও চেঞ্জ হয়ে গেছে। সব বিজনেসের পিছে ছুটছে ম্যাদামজি। কেউ এই জায়গাকে ভালবাসে না। আরে নিজে যদি পাহাড়ের অলিগলি না চিনি, তবে আপনাদের কি বলব? এ তো বেইমানি হয়ে যাবে। আমি তাই সবাইকে বলি সাচ্চা থাকো, সবকুছ এসে যাবে”।
মঙ্গলের কথা আবিরাকে মুগ্ধ করছিল। সে হেসে বলল, “ কিন্তু কতজনকে তুমি বোঝাতে পারবে? সবাই শুনবে?”
মঙ্গল একটু চুপ করে গেল। তারপর বলতে শুরু করল, “ হাম ইয়াহা হাপ্তেমে দো দিন এক জাগা জমা হতে হ্যায়। আপনে আপনে বাঁতে শেয়ার করতে হ্যায়। আপ কি তারা ইয়াহা হোয়াটস আপ নেহি চালতা। হাম খুদ এক দুসরও কে আমনে সামনে বাতচিত করতে হ্যায়। আগার সুলঝানা হ্যায় কোই মুসিবাত তো আয়সেহি সুলঝাতে হ্যায়”।
আবিরা প্রশ্ন করল, “ সবাই শুনবে কেন তোমার কথা?”
মঙ্গল তার স্বভাবসিদ্ধ সরল হাসি হেসে বলল, “ আমি এখানকার ইয়ুথ কমিটির লিডার। তাই আমি যেভাবে বলব ওরা শুনবে। আমি বাড়ি বসে থাকা লিডার নয়। এখানে কেউ কোনও অসুবিধায় পড়লে আমায় ডাকে । ওরাই আমায় জিতিয়েছে”।
আবিরা এবার ধাক্কা খেল। পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর নেতা তাকে গাড়িতে করে ঘোরাচ্ছে । শুধু ঘোরাচ্ছে না তার সাথে নিজেদের কথাও জানাচ্ছে। কলকাতায় এটা সে আশাই করতে পারবে না। আবিরার মাথার জট খুলতে শুরু করেছে। যে কারণে তার মনটা খারাপ হয়েছিল সেটা সে ভুলেই গেল। তার মনে হল, মুখে বলা আর করে দেখানো সহজ কাজ নয়। এরা পাহাড়ের মানুষ বলে এদের কাছে কোনও কাজই কঠিন নয়। আবিরা শিখছে একটু একটু করে কীভাবে নিজেকে উন্নত করা যায়। আসলে শেখার তো কোনও বয়স হয় না।