
স্মৃতি তুমি মধুর
সুদীপ ঘোষাল
গণিতের শিক্ষকমশাই মজা করে বলতেন যোগ,বিয়োগ,গুণ,ভাগ জীবনের ক্ষেত্রেও মেনে চলবি। যত দুঃখ,ব্যথা বিয়োগ করবি। আনন্দ যোগ করে খুশি গুণ করবি। আর খাবার ভাগ করে খাবি। একা খেলে,বেশি খেলে রোগ বেড়ে যাবে। মজার মধ্যেও কতবড় শিক্ষা তিনি আমাদের দিয়েছিলেন আজ বুঝতে পারি। আদর্শ শিক্ষক বোধহয় এই রকম হন। ফোচন বললো।ফোচনের বোন ফোড়োনকে মাস্টারমশাই মশলা বলে ডাকতেন। ফোড়োন খুব রেগে যেতো। কারণ বন্ধুরাও তাকে মশলা বলেই ডাকতো। একদিন স্যারের কাছে ফোড়ন বললো,আপনি মশলা নামে ডাকেন বলে সবাই ডাকে। মাস্টারমশাই বলেছিলেন,আদর করে দেওয়া নাম কোনোদিন ফেলবি না। রাগ করবি না। দেখবি একদিন যখন তোর বন্ধু, বান্ধবীরা দূরে চলে যাবে তখন এই নাম তোর মুখে হাসি ফোটাবে। সংসারের সমস্ত দুঃখ ভুলিয়ে দেবে আদরের পরশে। ফোড়োনের জীবনে সত্য হয়েছিলো এই কথা। একদিন বিয়ের পরে রমেশের সঙ্গে দেখা হলো তার। রমেশ বললো,কেমন আছিস ফোড়োন। ফোড়োন বললো,একবার মশলা বলে ডাক। তা না হলে আমি তোর প্রশ্নের উত্তর দেবো না। রমেশ তারপর ওকে মশলা বলে ডেকেছিলো। মশলা সেবার খুশি হয়ে রমেশকে ফুচকা খাইয়েছিলো।
পৌষালা বা পোষলা করতাম পৌষ মাসে। নবগ্রামে অজয় নদী বাঁক নিয়েছে ইংরাজী অক্ষর এসের মতো। সেখানে বন্ধু,বান্ধবীরা একসাথে পোষলা করতে যেতাম শীতকালে পৌষ মাসে। নদীতে চান করতাম। বাড়িতে শুধু নিষেধের বেড়া। বাঁধা গরু ছাড়া পেলে যেমন পাগলের মতো ছুটে ছুটে বেড়ায় স্বাধীনতার আনন্দে। ঠিক তেমনই আমরাও কি করবো ভেবে পেতাম না। শুধু খেলা,ছোটা আর উল্টোপাল্টা চিৎকার, চেঁচামেচিতে নদী উচ্ছল হতো। প্রতিধ্বনি ফিরে ফিরে আসতো বারে বারে। এত খোলা জায়গা,এত আকাশ,নদী,জল আমরা সহজে তো পাই না। তাই মুহূর্তের আনন্দ আজও হৃদয়ে রং ধরায়,চোখ ভেজায় নব আনন্দে। স্মৃতি রোমন্থনেও অনেক সুখ।
রমেন বলছে,আমি শ্মশান গেছি বহুবার,মানুষ খুন হতে দেখেছি অসহায় হয়ে,রেলে কাটা পরা দেখেছি সামনাসামনি,ডাকাতি,পকেটমারি দেখেছি লুকিয়ে,বেশ্যাখানার উলঙ্গরূপ মনে আঘাত দিয়েছে,আদিবাসীদের সাথে বনে রাত কাটিয়েছি। একা ছাদে রাত কাটিয়েছি,ফাঁকা মাঠে রাত পার হয়ে গেছে বহুবার। নদীতীরে পা ডুবিয়ে বসেছি। অনেক নদ নদী নৌকো করে পার হয়েছি। কোলাহলের আনন্দ আশ্রমে শ্যাওলা পরতে দেখেছি। পুরোনো জমিদার বাড়ির ধ্বং সাবশেষের অন্ধকার গলি পার হয়েছি। ধনী মানুষকে ভিকিরি হতে দেখেছি।ভিকিরি মানুষকে ধনী হতে দেখেছি। আপন মানুষকে পাল্টে যেতে দেখেছি। অনাত্মীয়কে পরম বন্ধুরূপে পেয়েছি।
দেবু বেগুনক্ষেতে বসে বেগুন তুলছে। অভিজিৎ পাশ দিয়ে যেতে গিয়ে বন্ধু দেবুকে দেখে বললো,অনেকদিন দেখা হয় নাই। তোর ছেলেমেয়েরা কেমন আছে? দেবু আপন কাজে ব্যস্ত। ভালোভাবে শুনতে পেলো না। আন্দাজ করলো হয়তো বেগুনের ব্যাপারেই খবর নিচ্ছে। দেবু উত্তর দিলো,এই হচে আর পুড়িয়ে মুরিয়ে খেচি।
লিলুয়া শহরে যখন ভাড়াটে হিসাবে ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতাম চার ভাই, তখন আমরা নিজেরাই রান্নাবান্না করে নিতাম। উনুন ধরিয়ে আঁচ দেওয়া,বাসনমাজা সবকিছু নিজেরাই করতাম। খাবার জল আনতে যেতে হত দু কিলমিটার দূরে। বালতি নামাতে,নামাতে আনতাম খাবার জল। কোনদিন আমার পালা পরত। ছোটোবেলা থেকেই এখানে কাটিয়েছি মা, বাবার সঙ্গে। তখন ভাল লাগত। আর এখন মা বাবা এখানে নেই। ভাল লাগত না। মনে হত যাই ছুটে মায়ের কোলে। যেতে পারতাম না। রোজগার করতে হবে। বসে বসে খেলে ত হবে না। বড়দা বলতেন,তোর যখন মন হবে বাড়ি চলে যাবি। মেজদা বলতেন,যা,মায়ের কাছে যা। এখানে তোর ভালো লাগবে না। কিন্তু আমার মনে একটা অপরাধবোধ কাজ করত। বসে বসে খাব। এটা চিন্তা করতেই মন খারাপ হয়ে যেত। তখন গ্রাজুয়েট হয়ে গেছি। বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছাত্র পড়াই। আর ফাঁকা ঘরে আমি একা পড়তাম বিভূতিভূষণ, তারাশঙ্কর,রবীন্দ্রনাথ,মাণিক,শরতচন্দ্র,নিমাই,শীর্ষেন্দু,শঙ্কর ও আরো অনেকের লেখা। মায়ের অভাব, তাদের লেখাই ভুলিয়ে দিতো নিমেষে।
কিন্তু অতিরিক্ত কবিতা,গল্প পড়ার ফলে আমার চাকরী হয় নি ভাল। গোড়া,গৌতম,গোবিন্দ,অসীম আসতো বাসায়। তারা বলত,এই নভেল পড়ে চাকরী পাবি না। এখনো সময় আছে। সাবধান। তাদের সাবধান বাণী আমার কানে ঢুকত না। নভেল পড়া
নেশা ধরিয়ে ছিল মনে।
তারপর রিষড়া ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াতাম। মাসে তিনশ টাকা মাইনে। প্রায় চার বছর পরে আমার এপেন্ডিক্স অপারেশন হল। দাদার কাছ থেকে চলে এলাম মায়ের কাছে ছোটো ভাইয়ের হাত ধরে। শিবলুন স্টেশনে নেমে মাটির গন্ধে আমি আত্মহারা হয়ে গেলাম। মাটির স্পর্শ পেলাম। তারপর বাড়ি গিয়ে মা কে দেখে চোখে জল চলে এল। মায়ের চোখেওজল। তারপর সহজভাবে গ্রাম্য পরিবেশে মিশে গেলাম। ছোটো ছোটো ছেলে মেয়েদের নিয়ে খোলা মাঠে বোসতাম। গল্প শোনাতাম। এদিকে শুরু করলাম তিন ভাই মিলে ধানের ব্যবসা। তারপর আমার বিয়ে হোলো কাশীরাম দাসের জম্মস্থান সিঙ্গি গ্রামে। মনে আছে বন্ধুদের পাল্লায় পরে কাটোয়া এনিস সেলুনে ফেসিয়াল করেছিলাম। ফলে বিয়ের ছবিগুলো খুব সুন্দর হয়েছিল। বিয়ের তিন বছরের মধ্যেই পুত্র সন্তান হোলো। ভাই নাম রাখলো সৈকত।
সুদীপ ঘোষাল নন্দনপাড়া খাজুরডিহি পূর্ব বর্ধমান।