Sudip Ghoshal

মহাজীবনের মণিকথা

সুদীপ ঘোষাল

কবি নজরুল বন্ধুদের আড্ডায় ধূমকেতুর মতো আবির্ভূত হতেন আর সুরের অপূর্ব কন্ঠ নিয়ে তিনি মানুষকে আজীবন ভালবেসে গেছেন। যৌবন ধর্মের অতিরেকে সারা দেশটাকে চষে বেড়াতেন আনন্দের হিন্দোলে।বিদ্রোহী কবিতা ও গান লিখে তিনি বিদ্রোহী উপাধি পান দেশের জনগণের কাছে। কবিগুরু যৌবন মূর্তি নজরুলকে অতিশয় স্নেহ করতেন এখন পাঠকসমাজের নয়নতারা স্বরূপ গণ্য হয়েছিলেন। বিদেশি সরকারের রক্তচক্ষু অবহেলা করে দুরন্ত কবি, কবিতা গান ও প্রবন্ধের সাময়িকপত্রে আগুনের ফুলকি ছড়াতে লাগলেন। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড শুরু হতে পারত তার লেখনীর গুণে । এর জন্য কিছু কলকাতায় কারারুদ্ধ থাকতে হয়েছিল বোধ হয় রাজনৈতিক চেতনার ক্ষেত্রে ইদানিং আর কোন কবি ও লেখক এতটা উদ্দীপনার সঞ্চার করতে পারেননি। তাঁর কাব্য ও গানে জাতি সম্প্রদায়ের উপলব্ধি ব্রীটিশ বিদ্বেষী মনোভাব সৃষ্টি করেছে।যে কবিতাসমূহ বিদ্রোহীর অস্থিরতা বোধ করে, সর্ববিধ শাসক, যৌবনকে বরমাল্য দিয়েছে তার সঙ্গে তার কবিতাকে। হিন্দু-মুসলমানের জাত বিচার কে অবহেলা করে উপেক্ষা করে তাদের মিলনের এক ছাতার তলায় এনেছিলেন। কবি নজরুলের অগ্নিবীণা ও হয়তো সেই ভাঙ্গার গান বিষের বাঁশি প্রভৃতি কাব্যসংগ্রহ সংগীত সংকলনের প্রচুর রসের আমদানি করা হয়েছে।বাবু বলে,বিংশ শতাব্দীর বাংলা মননে কাজী নজরুল ইসলামের মর্যাদা ও গুরুত্ব অপরিসীম। তার জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী বিশেষ মর্যাদার সঙ্গে উভয় বাংলাতে প্রতি বৎসর উদযাপিত হয়ে থাকে। আমরা তাঁকে প্রণাম জানাই।এই বলে মাষ্টারমশাই চুপ করলেন।তারপর বিরাজুল আমাদের শোনায় কবির গল্প। কবি নজরুল এক দরিদ্র মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার প্রাথমিক শিক্ষা ছিল ধর্মীয়। কৈশোরে বিভিন্ন লেটো দলের সাথে কাজ করতে যেয়ে তিনি কবিতা এবং সাহিত্য সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞান লাভ করেন। সেনাবিভাগে কিছুদিন কাজ করার পর তিনি সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নেন। এসময় তিনি কলকাতায় থাকতেন। এসময় তিনি ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অবতীর্ণ হন। প্রকাশ করেন বিদ্রোহী এবং ভাঙার গানের মতো কবিতা; ধূমকেতুর মতো সাময়িকী। জেলে বন্দী হলে পর লেখেন জবানবন্দী, এই সব সাহিত্যকর্মে শোষক বিরোধিতা ছিল সুস্পষ্ট। ধার্মিক মুসলিম সমাজ এবং অবহেলিত ভারতীয় জনগণের সাথে তার বিশেষ সম্পর্ক ছিল। তার সাহিত্যকর্মে প্রাধান্য পেয়েছে ভালোবাসা, মুক্তি এবং বিদ্রোহ। ধর্মীয় লিঙ্গভেদের বিরুদ্ধেও তিনি লিখেছেন। ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক লিখলেও তিনি মূলত কবি হিসেবেই বেশি পরিচিত। বাংলা কাব্যে তিনি এক নতুন ধারার জন্ম দেন। গজল, এর পাশাপাশি তিনি অনেক উৎকৃষ্ট মুক্তিগীতিও রচনা করেন। নজরুল গান রচনা এবং অধিকাংশে সুরারোপ করেছেন যেগুলো এখন “নজরুল গীতি” নামে পরিচিত এবং বিশেষ জনপ্রিয়ও পরিচিত হন।চা-রুটির দোকানে চাকরি করার সময় আসানসোলের দারোগা রফিজউল্লার সঙ্গে নজরুলের পরিচয় হয় এবং তাঁর সুবাদেই নজরুল ১৯১৪ সালে ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালের দরিরামপুর স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হন। রমেন আলোচনায় অংশ নেয়। সে বলে, এক বছর পর তিনি পুনরায় নিজের গ্রামে ফিরে যান এবং ১৯১৫ সালে আবার রানীগঞ্জ সিয়ারসোল রাজস্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি হন। এ স্কুলে নজরুল একটানা অষ্টম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশুনা করেন। প্রিটেস্ট পরীক্ষার সময় ১৯১৭ সালের শেষদিকে নজরুল সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ছাত্রজীবনের শেষ বছরগুলিতে নজরুল সিয়ারসোল স্কুলের চারজন শিক্ষক দ্বারা নানাভাবে প্রভাবিত হন। তাঁরা হলেন উচ্চাঙ্গসঙ্গীতে সতীশচন্দ্র কাঞ্জিলাল, বিপ্লবী ভাবধারায় নিবারণচন্দ্র ঘটক, ফারসি সাহিত্যে হাফিজ নুরুন্নবী এবং সাহিত্যচর্চায় নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়।১৯১৭ সালের শেষদিক থেকে ১৯২০ সালের মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত প্রায় আড়াই বছর নজরুলের সামরিক জীবনের পরিধি। এ সময়ের মধ্যে তিনি ৪৯ বেঙ্গলি রেজিমেন্টের একজন সাধারণ সৈনিক থেকে ব্যাটেলিয়ন কোয়ার্টার মাস্টার হাবিলদার পর্যন্ত হয়েছিলেন। রেজিমেন্টের পাঞ্জাবি মৌলবির নিকট তিনি ফারসি ভাষা শেখেন, সঙ্গীতানুরাগী সহসৈনিকদের সঙ্গে দেশি-বিদেশি বাদ্যযন্ত্র সহযোগে সঙ্গীতচর্চা করেন এবং একই সঙ্গে সমভাবে গদ্যে-পদ্যে সাহিত্যচর্চা করেন। করাচি সেনানিবাসে বসে রচিত এবং কলকাতার বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত নজরুলের রচনাবলির মধ্যে রয়েছে ‘বাউন্ডুলের আত্মকাহিনী’ নামক প্রথম গদ্য রচনা, প্রথম প্রকাশিত কবিতা ‘মুক্তি, এবং অন্যান্য রচনা: গল্প ‘হেনা’, ‘ব্যথার দান’, ‘মেহের নেগার’, ‘ঘুমের ঘোরে’; কবিতা ‘আশায়’, ‘কবিতা সমাধি’ প্রভৃতি। উল্লেখযোগ্য যে, করাচি সেনানিবাসে থেকেও তিনি কলকাতার বিভিন্ন সাহিত্যপত্রিকা, যেমন: প্রবাসী, ভারতবর্ষ, ভারতী, মানসী, মর্ম্মবাণী, সবুজপত্র, সওগাত ও বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকার গ্রাহক ছিলেন। তাছাড়া তাঁর কাছে রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, এমনকি ফারসি কবি হাফিজেরও কিছু গ্রন্থ ছিল। প্রকৃতপক্ষে নজরুলের আনুষ্ঠানিক সাহিত্যচর্চার শুরু করাচির সেনানিবাসে থাকাবস্থায়ই। আমরা এখন আলোচনায় মগ্ন জোয়ার সংস্থার নির্দিষ্ট ক্লাবঘরে।এখানে লাইিব্রেরীও আছে।বিশু আবার বলে, প্রথম মহাযুদ্ধ শেষে ১৯২০ সালের মার্চ মাসে নজরুল দেশে ফিরে কলকাতায় সাহিত্যিক-সাংবাদিক জীবন শুরু করেন। কলকাতায় তাঁর প্রথম আশ্রয় ছিল ৩২নং কলেজ স্ট্রীটে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি-র অফিসে সমিতির অন্যতম কর্মকর্তা মুজফ্ফর আহমদের সঙ্গে। শুরুতেই মোসলেম ভারত, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা, উপাসনা প্রভৃতি পত্রিকায় তাঁর সদ্যোরচিত বাঁধন-হারা ও আরও নানা কবিতা প্রকাশিত হলে বাংলা সাহিত্য ক্ষেত্রে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। বাংলা সাহিত্যের এ নবীন প্রতিভার প্রতি সাহিত্যানুরাগীদের দৃষ্টি পড়ে। কবি-সমালোচক মোহিতলাল মজুমদার মোসলেম ভারত পত্রিকায় প্রকাশিত এক পত্রের মাধ্যমে নজরুলের ‘খেয়া-পারের তরণী’ এবং ‘বাদল প্রাতের শরাব’ কবিতাদুটির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন এবং বাংলার সারস্বত সমাজে তাঁকে স্বাগত জানান। নজরুল বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির অফিসে মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক, সমকালীন মুসলমান সাহিত্যিকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হন। অপরদিকে কলকাতার তৎকালীন জমজমাট দুটি সাহিত্যিক আসর ‘গজেনদার আড্ডা’ ও ‘ভারতীয় আড্ডা’য় অতুলপ্রসাদ সেন, দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, ওস্তাদ করমতুল্লা খাঁ, প্রেমাঙ্কুর আতর্থী, শিশিরকুমার ভাদুড়ী, হেমেন্দ্রকুমার রায়, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, নির্মলেন্দু লাহিড়ী, ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ বাংলার সমকালীন শিল্প, সাহিত্য, সঙ্গীত ও নাট্যজগতের দিকপালদের সঙ্গে পরিচিত ও ঘনিষ্ঠ হবার সুযোগ পান। নজরুল ১৯২১ সালের অক্টোবর মাসে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন; তখন থেকে ১৯৪১ পর্যন্ত দু দশক বাংলার দু প্রধান কবির মধ্যে যোগাযোগ ও ঘনিষ্ঠতা অক্ষুণ্ণ ছিল।এ.কে ফজলুল হকের সম্পাদনায় অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ১৯২০ সালের ১২ জুলাই সান্ধ্য দৈনিক নবযুগ প্রকাশিত হলে তার মাধ্যমেই নজরুলের সাংবাদিক জীবনের সূত্রপাত ঘটে। নভেম্বর মাসে নজরুল আবার কুমিল্লা যান। ২১ নভেম্বর ভারতব্যাপী হরতাল ছিল। নজরুল পুনরায় পথে নামেন এবং অসহযোগ মিছিলের সঙ্গে শহর প্রদক্ষিণ করে গাইলেন: ‘ভিক্ষা দাও! ভিক্ষা দাও! ফিরে চাও ওগো পুরবাসী।’ এ সময় তুরস্কে মধ্যযুগীয় সামন্ত শাসন টিকিয়ে রাখার জন্য ভারতে মুসলমানরা খিলাফত আন্দোলন করছিল। মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে অসহযোগ আর মওলানা মোহাম্মদ আলী ও শওকত আলীর নেতৃত্বে খিলাফত আন্দোলনের দর্শনে নজরুল আস্থাশীল ছিলেন না। স্বদেশে সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে স্বরাজ বা স্বাধীনতা অর্জন আর মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের নেতৃত্বে তুরস্কের সালতানাত উচ্ছেদকারী নব্য তুর্কি আন্দোলনের প্রতি নজরুলের সমর্থন ছিল; তথাপি ভারতের হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের সম্মিলিত সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামের জন্যই তিনি ওই দুটি আন্দোলনে যোগদান করেন।বিশু বলে যায়, এবার শোনো সকলে মন দিয়ে কবির গল্প। ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসে কুমিল্লা থেকে কলকাতা ফেরার পর নজরুলের দুটি ঐতিহাসিক ও বৈপ্লবিক সৃষ্টিকর্ম হচ্ছে ‘বিদ্রোহী’ কবিতা ও ‘ভাঙার গান’ সঙ্গীত। এ দুটি রচনা বাংলা কবিতা ও গানের ধারাকে সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছিল; ‘বিদ্রোহী’ কবিতার জন্য নজরুল বিপুল খ্যাতি ও জনপ্রিয়তা অর্জন করেন।১৯২১ সালের শেষদিকে নজরুল আরেকটি বিখ্যাত কবিতা ‘কামাল পাশা’ রচনা করেন, যার মাধ্যমে তাঁর সমকালীন আন্তর্জাতিক ইতিহাস-চেতনা এবং ভারতীয় মুসলমানদের খিলাফত আন্দোলনের অসারতার পরিচয় পাওয়া যায়। নজরুল তাঁর রাষ্ট্রীয় ধ্যান-ধারণায় সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়েছিলেন মোস্তফা কামাল পাশার নেতৃত্ব দ্বারা, কারণ তিনি সামন্ততান্ত্রিক খিলাফত বা তুরস্কের সুলতানকে উচ্ছেদ করে তুরস্ককে একটি আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ প্রজাতন্ত্রে রূপান্তরিত করেছিলেন। তুরস্কের সমাজজীবন থেকে মোস্তফা কামাল যে মৌলবাদ ও পর্দাপ্রথা দূর করেছিলেন, তা নজরুলকে বেশি অনুপ্রাণিত করেছিল। তিনি ভেবেছিলেন, তুরস্কে যা সম্ভবপর, ভারত ও বাংলায় তা সম্ভবপর নয় কেন? বস্ত্তত, গোঁড়ামি, রক্ষণশীলতা, ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার ও আচারসর্বস্বতা থেকে দেশবাসী, বিশেষত স্বধর্মীদের মুক্তির জন্য নজরুল আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। ১৯১৭ সালের রুশ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবও নজরুলকে নানাভাবে প্রভাবিত করেছিল। নজরুলের লাঙল ও গণবাণী পত্রিকায় প্রকাশিত ‘সাম্যবাদী’ ও ‘সর্বহারা’ কবিতাগুচ্ছ এবং কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল-এর অনুবাদ ‘জাগ অনশন বন্দী ওঠ রে যত’ এবং ‘রেড ফ্লাগ’ অবলম্বনে রক্তপতাকার গান এর প্রমাণ।১৯২২ সালে নজরুলের যেসব সাহিত্যকর্ম প্রকাশিত হয় সেসবের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ছিল গল্প-সংকলন ব্যথার দান, কবিতা-সংকলন অগ্নি-বীণা ও প্রবন্ধ-সংকলন যুগবাণী। বাংলা কবিতার পালাবদলকারী কাব্য অগ্নি-বীণা প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে এর প্রথম সংস্করণ শেষ হয়ে যায় এবং পরপর কয়েকটি নতুন সংস্করণ প্রকাশ করতে হয়; কারণ এ কাব্যে নজরুলের ‘প্রলয়োল্লাস’, ‘কামাল পাশা’ প্রভৃতি বাংলা সাহিত্যে সাড়া জাগানো এবং বাংলা কবিতার মোড় ফেরানো কবিতা সংকলিত হয়েছিল। নজরুলের অপর বিপ্লবী উদ্যম হলো ধূমকেতু পত্রিকার প্রকাশ । পত্রিকাটি সপ্তাহে দুবার প্রকাশিত হতো। বিশের দশকে অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলনের ব্যর্থতার পর সশস্ত্র বিপ্লববাদের পুনরাবির্ভাবে ধূমকেতু পত্রিকার তাৎপর্যপূর্ণ অবদান ছিল। এক অর্থে এ পত্রিকা হয়ে উঠেছিল সশস্ত্র বিপ্লবীদের মুখপত্র। পত্রিকাটি প্রকাশিত হতো ‘কাজী নজরুল ইসলাম কল্যাণীয়েষু, আয় চলে আয়রে ধূমকেতু। অাঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু, দুর্দিনের এ দুর্গশিরে উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন।’ রবীন্দ্রনাথের এ আশীর্বাণী শীর্ষে ধারণ করে। ধূমকেতুর ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯২২ সংখ্যায় নজরুলের প্রচ্ছন্ন রাজনৈতিক কবিতা ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ প্রকাশিত হলে ৮ নভেম্বর পত্রিকার ওই সংখ্যাটি নিষিদ্ধ করা হয়। নজরুলের প্রবন্ধগ্রন্থ যুগবাণী বাজেয়াপ্ত হয় ২৩ নভেম্বর ১৯২২সালে তিনি সপরিবারে বাংলাদেশে আসেন। এসময় তাকে বাংলাদেশের জাতীয়তা প্রদান করা হয়। এখানেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।”হিন্দু না ওরা মুসলিম ঐ জিজ্ঞাসে কোন জন কাণ্ডারি বল ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মা’র “তাঁর লেখা এই লাইনে প্রকাশিত হয়েছে মানবপ্রেম। সমস্ত জাতিভেদ ভুলে একতার বাণী শুনিয়ে ছিলেন এই বিদ্রোহী কবি। “ঐ নতুনের কেতন ওড়ে কাল বোশেখির ঝড়।’”আমার কৈফিয়ৎ নামে নজরুলের প্রথম কবিতা ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত হয় ১৯১৯ সালে। এর আগে তিনি তীক্ষ্ম হীরকখণ্ডের মতো ‘বিদ্রোহী’ কবিতা লিখেছেন। ‘খেয়াপারের তরণী’র মতো ইসলাম সম্পৃক্ত কবিতা লিখেছেন, প্রেমের কবিতা লিখেছেন, ‘সর্বনাশের ঘণ্টা’র মতো ক্রুদ্ধ কবিতা লিখেছেন—এতেই বোঝা যায় নজরুল বহুভাবে বিপরীত দিকে ধাবিত হয়েছেন। নজরুলের অনেক কবিতা যেমন-বিদ্রোহী, দারিদ্র্য, আমার কৈফিয়ৎ অনেক গতিশীল কবিতা। প্রথমেই কবি নিজেকে বর্তমানের কবি বলে আখ্যায়িত করেছেন।প্রার্থনা করো যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস,যেন লেখা হয় আমার রক্তে তাদের সর্বনাশ;’কবিতার স্তবকে বর্তমানের কবি কথাটার বিশদ বিবরণ লক্ষণীয়। অন্যায়, অবিচার, অসাম্য, শোষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে চির বিদ্রোহী কবি নজরুলের সমগ্র সাহিত্যে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠেছে। এর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছেন মানবপ্রেমিক নজরুল। মানুষের অফুরন্ত ভালোবাসা, মানুষের বেদনা, যাতনা, পীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। এক কথায় মানবপ্রেম।আমি জানি, নজরুলের ছোটগল্পে এক নতুন ভাবধারা সৃষ্টি হয়েছে। তাঁর ‘বাউন্ডুলের আত্মকাহিনি’ গল্পে যেভাবে নিচতলার জীবনের কথা উঠে এসেছে তেমন রূপায়ণ বাংলা সাহিত্য ছোটগল্পে ছিল না। নজরুলের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস মৃত্যু-ক্ষুধা; বস্তিবাসীর প্রকৃত ছবি এর আগে অন্য কোনো উপন্যাসে পাওয়া যায়নি। নজরুলের উপন্যাসে যে মানবপ্রেমী দৃষ্টিকোণ যুক্ত হয়েছে তা তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতারই ফসল। অসাম্প্রদায়িকতা, হিন্দু মুসলমানের মিলন, সমাজের নিচুতলার মানুষের উত্থান এসবই নজরুলের মানবিকতার অংশ। নজরুল মনে প্রাণে ব্রিটিশের উচ্ছেদ কামনা করেছেন। ইংরেজদের বিরুদ্ধে নজরুলের উচ্চারণে একতিল খাদ ছিল না। নজরুল শেষ পর্যন্ত ইংরেজ নয়-ছিলেন সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে। তিনি লক্ষ্য করেছেন, মানুষ চিরকাল মানুষের ওপর অত্যাচার করে এসেছে, তা পশুদের পক্ষেও অসম্ভব। নজরুল জীবনভর লাঞ্ছিত মানুষেরই জাগরণ কামনা করেছেন।নজরুলের কবিতার ক্ষেত্রে দৃষ্টি দিলে দেখি বহু আয়তনে বিস্তৃত তাঁর কবিতা। ব্যক্তি জীবনের উদার মানবিকতার চর্চাই নজরুলের সাহিত্যিক জীবনে প্রতিফলিত হয়েছিল। ক্রোধ, ধার্মিকতা, আধ্যাত্মিকতা, সমাজ, রাজনীতি, বাস্তব ও স্বপ্ন মিলে কখনো দেখা গেছে গভীর বিষাদে মগ্ন থেকে কবি কাজ করেছেন মাত্র দুই যুগ। সুস্থাবস্থার সময় মাইকেল মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ দাস এই কবিদের চেয়ে অনেক কম পেয়েছেন কবি নজরুল।প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে কবি নজরুল চলে যান করাচিতে। কিন্তু সেখানে বেশি দিন ধরে রাখতে পারেনি করাচির মাটি। তিনি চলে এলেন কলকাতায়, কমরেড মুজাফফর আহমদের সঙ্গে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির অফিসে এক সঙ্গ বাস করতে থাকেন। ১৯২০ সালে নজরুল ইসলাম ও মুজাফফর আহমদ দৈনিক ‘নবযুগ’ প্রকাশ করেন। এ কে ফজলুল হক ছিলেন প্রধান পরিচালক। মুজাফফর আহমদ মার্কসবাদের প্রতি আকৃষ্ট হলে নজরুল সম্পাদিত অর্ধ সাপ্তাহিক ‘ধূমকেতু’ বের করেন। তারপর সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘লাঙল ‘প্রকাশিত হয়। লাঙল পত্রিকার প্রথম সংখ্যাতেই বিদ্রোহী কবির সাম্যবাদী চরিত্র প্রকাশিত হয়। তখনই ঘোষিত হলো মানবতার জয়গান।অপরূপা কবির সম্বন্ধে বলে, ১৯২৫ সালে প্রকাশিত সাম্যবাদী কবিতাগ্রন্থ সমাজতন্ত্রী বাংলা কবিতার দরজা খুলে দিল। ৩০ ও ৪০-এর দশকে সাম্যবাদী কবিতার যে প্রবাহ, তার পথিকৃত কাজী নজরুল ইসলাম। চৌদ্দশো বছরের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে নজরুল ইসলামই হিন্দু মুসলমান মিলনের শ্রেষ্ঠ প্রবক্তা। শত শত বছর ধরে হিন্দু মুসলমান পাশাপাশি বাস করলে ও সাহিত্যে তা আদৌ যথাযথ ভাবে প্রতিফলিত হয়নি। ব্যক্তি জীবনেও নজরুল তাঁর ব্যবধান রাখেননি। বিয়ে করলেন হিন্দু মেয়ে। তাঁর পুত্রদের নাম রাখলেন হিন্দু মুসলিম ঐতিহ্যকে সমান করে। নজরুল হিন্দু ও মুসলমান ধর্মের আচার থেকে অন্তর আত্মা অবধি ব্যবহার করেছেন। শুধু কবিতায় নয় গল্পে, উপন্যাসে, নাটকে, প্রবন্ধে, গানে সব ক্ষেত্রে তাঁর পারদর্শিতার পরিচয় মেলে। পৃথিবীর যেখানে বাংলাভাষী রূপে যারা বাস করেন তিনি তাদের আত্মার আত্মীয়, পরমাত্মীয় এবং স্মরণীয় কবিরূপে সম্মানীত। অপরূপার বক্তব্যের পরে সভার সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়। তারপর নরনারায়ণ ভোজনের ব্যবস্থা করা হয়। সভার পাশে রান্না হত খিচুড়ি, তরকারি আর টক। পূর্ববর্ধমান জেলার লোকেরা টক খুব ভালবাসেন।

 

 

 

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, “ভজন পূজন সাধন আরাধনা সমস্ত থাক পরে, রুদ্ধদ্বারে দেবালয়ের কোণে কেন আছিস ওরে”।
স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, “বহুরূপে সম্মুখে তোমার ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর, জীবে প্রেম করে যেইজন সেইজন সেবিছে ঈশ্বর”।
এখানে দেখা যাচ্ছে দুই মহাপুরুষের একই বক্তব্য। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন ভজন পূজন সাধন আরাধনা বাদ দিয়ে যেখানে সমস্ত শ্রমিক কাজ করছেন তাদের মধ্যেই ঈশ্বরের বাসস্থান। আবারো স্বামীজী বলেছেন শ্রমিক, খেটে খাওয়া মানুষের মাঝে ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে।বহুরূপে, মানুষের মাঝে ঈশ্বরের অস্তিত্ব বিদ্যমান। ধর্ম জীবনেরই অংশ বলা হয়ে থাকে। অবশ্য পাশ্চাত্ত্য দেশে ধর্ম শব্দটি দ্বারা বর্তমানে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মচর্চার বাইরের অনেক কিছুকে বোঝানো হয়ে থাকে। যেমন, ‘ধ্যান’ অধ্যাত্মসাধনার অংশ হলেও এর দ্বারা শরীরের সুস্থতার ধারণা যুক্ত হয়েছে।একাগ্রতার কথা বলা হয়েছে। ঈশ্বর বিশ্বাসী কিংবা অবিশ্বাসী যেকোনো ব্যক্তি ধ্যানের মাধ্যমে শরীরের সুস্থতা বজায় রাখতে পারেন। এ ধরনের দৃষ্টিকোণে ধর্ম বিশ্লেষণে গুরুত্ব পায় মানবতাবাদ, প্রেম, সমবেদনা, ধৈর্য, সহিষ্ণুতা, ক্ষমা, পরিতৃপ্তি, দায়িত্ব, সংগতি, অপরের সুবিধা-অসুবিধার প্রতি দৃষ্টি রাখা প্রভৃতি। কেউ অস্বীকার করবে না এই যুগে যুবসমাজ জ্ঞানী ও কর্মে অনেক অগ্রসর। কিন্তু তাদের মূল্যবোধের অভাব নিয়ম-শৃঙ্খলা প্রতি অবজ্ঞা তাদের ভবিষ্যৎ কি অন্ধকার আচ্ছন্ন করে রেখেছে। কে তাদের সতর্ক করে দেবে কেউ দেবে না। কারণ কেউ তাদের আত্মীয় হতে চায় না কি বাড়ির অভিভাবক শিক্ষক সংবাদপত্র কেউ সবাই নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য যুব শক্তিকে কাজে লাগাতে ব্যস্ত। যুব শক্তিকে কাজে লাগানোর জন্য স্বামী বিবেকানন্দের এবং তার কর্মময় জীবন তার প্রমাণ রেখেছে। স্বামীজি দেশপ্রেমিক ছিলেন এটুকু বললে তাকে ছোট করা হবে।। তিনি তো সন্ন্যাসী ছিলেন। সন্ন্যাসী হিসেবে তার আবার দেশকি? সমাজ কি সন্ন্যাসী তো দেশকালের ঊর্ধ্বে বস্তুত তিনি ভালবাসতেন মানুষকে। মানুষের মধ্যেই তিনি ঈশ্বরকে দেখেছিলেন সব দেশের মানুষকে শ্রদ্ধা করতেন যারা দুর্বল অক্ষম নিপীড়িত তারাই ছিল তার বিশেষ প্রীতিভাজন। যে দেশের মানুষ তারা হোক। নিগ্রো মনে করে আমেরিকার এক হোটেলে তাঁকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। কিন্তু তিনি বলেন নি যে তিনি নিগ্রো নন। প্রতিটি নিগ্রো, কালো, অসুন্দর মানুষ তার ভাই। মিশরের তথা বিশ্বের না খেতে পাওয়া,কষ্ট পাওয়া প্রতিটি পতিতা তার বোন। অনেকে মনে করেন এসব বিবেচনা কোনো ঐশ্বরিক বা স্বর্গীয় ধারণার সঙ্গে যুক্ত নয়, বরং পৃথিবীর প্রতিদিনকার বাস্তবতার সঙ্গে সম্পৃক্ত। পৃথিবীতে বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম করতে হচ্ছে।মানুষকে খেটে খেতে হয়।নানা ঝামেলার মাঝে প্রতিদিনের কাজের সঙ্গে প্রার্থনা ও ধ্যানের মাধ্যমে ঈশ্বরকে স্মরণ করছি আমরা মানুষ। যে বিশ্বে আমরা বাস করি তার আশ্চর্য ক্রিয়াকাণ্ড দেখে অভিভূত হই। আমরা কেন এখানে কিংবা আমাদের মৃত্যুর পরে কী হবে, এসব ভাবনাই অধ্যাত্মতত্ত্বের অংশ। আমরা তখনই আধ্যাত্মিক মানুষ হিসেবে পরিচিত হই যখন সুন্দর, প্রেম অথবা সৃষ্টিশীলতায় নিজেকে খুঁজে পাই।বাস্তব পৃথিবীতে জীবন পরিচালনায় আমাদের প্রত্যাশা প্রকাশিত হয় সূক্ষ্ম সম্পর্কের সুতোয়। সেই সম্পর্কের মধ্যে পরমার্থ-জীবন আমাদের প্রশান্তি দান করে। আধ্যাত্মিক জীবনের পথ বিচিত্র। ঈশ্বরের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য নিজেকে তৈরি করা, নিজের জ্ঞান ও বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে সৃষ্টি জগতের সঙ্গে মিলতে চাওয়ার জন্য সুশৃঙ্খলভাবে ধ্যান, প্রার্থনা, নৈতিকতার উন্নতি সাধন, ধর্মীয় গ্রন্থে নিমগ্ন হওয়াকে চিহ্নিত করা হয় এর অন্যতম পথ হিসেবে। এসবই অনেক সময় একজন ধর্মতাত্ত্বিকের মাধ্যমেও সম্পন্ন হতে পারে। আধ্যাত্মিকতার লক্ষ্য হচ্ছে ভেতরের জীবন ও বাইরের জীবনের উন্নতি। প্রেম ও করুণা ধারায় সিক্ত হলে আধ্যাত্মিক জীবনের উন্নতি ঘটে।
ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতার যোগাযোগটা কী রকমের? পরমের সন্ধানে নিয়োজিত আধ্যাত্মিকতার উদ্দেশ্য পরমের সন্ধান। তবে আমাদের মতে আধ্যাত্মিকতা ধর্মেরই একটি অংশ। ধর্মের বাইরে একজন ব্যক্তি তার আধ্যাত্মিক জীবন খুঁজে পেতে পারেন। শূদ্রের সেবার জন্য এক লক্ষ যুবককে স্বামীজি চেয়ে ছিলেন। তারা সমস্ত শক্তি নিয়ে দেশের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে এই ছিল তার আশা। কিন্তু সর্বাগ্রে চেয়েছিলেন তারা মানুষের মত মানুষ হবে, বুদ্ধির উদয় কর্মশক্তি এবং তার সঙ্গে নিঃস্বার্থ সেবার মনোভাব নিয়ে তারা কুটিরে কুটিরে গিয়ে মানুষকে উজ্জীবিত করবে। এই সেবা পেতে নিশ্চিতভাবে, শিবজ্ঞানে জীব সেবা বলে অভিহিত করেছেন।তিনি বলেছেন এই হচ্ছে যুগধর্ম এর মধ্যে আমি নেই। তুমি শুধু তুমি আছো। অর্থাৎ ঈশ্বরের প্রতি শ্রদ্ধা ও প্রীতি, স্মৃতি নিয়ে সেবা। সেবা বুদ্ধি না থাকলে ক্ষমতার অপব্যবহার অবশ্যম্ভাবী। তাই বারবার বলেছিলেন দেশ স্বাধীন হবেই। কিন্তু জাতি স্বার্থান্বেষীরা ক্ষমতার অপব্যবহার করতে না পারে সেজন্য আমাদের কর্তব্য, ধর্মের উচ্চতম চিন্তা দিয়ে সে সময় একটা প্লাবন ঘটানো উচিত এতে চিন্তার একটা প্রভাব পড়বে। কিন্তু যিশু খ্রিস্টের জীবনের প্রসঙ্গ আলোচনা করলে ধর্ম ও মানবতা একই জিনিস মনে হওয়াই স্বাভাবিক। অপরের জন্য নিজেকে আত্মোৎসর্গ করা, নিজের শান্তি, নিজের তৃপ্তি, সুখী হওয়ার প্রচেষ্টায় দান-ধ্যান-প্রার্থনায় নিয়োজিত থাকা এসবই আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে বিজড়িত থাকলে নিজের ভালো লাগে।এ ক্ষেত্রে নিজের অন্তরের উপলব্ধি গুরুত্বপূর্ণ। মানসিক স্বাস্থ্যের সঙ্গেও জড়িত অপরের উপকার প্রসঙ্গ।সমাজবিজ্ঞানীরা বলেছেন অন্তরের আকুতি ও নিবেদিত নৈবেদ্যের মধ্যে সেই ভালোলাগা লুকিয়ে থাকতে পারে। অন্যদিকে সার্বজনীন চেতনার সঙ্গে জড়িত রয়েছে সামাজিক উপকারের বিষয়টি। সর্বধর্মের দৃষ্টিতে সমগ্র মানব সমাজ এবং সৃষ্টির সব কিছু ঈশ্বরের সঙ্গে সম্পৃক্ত।তিনি সকল মানুষের প্রতিপালক। তিনি সকলকে ভালোবাসেন। মানবতার দিশারি হিসেবে ভগবান বুদ্ধ, যিশু, রসুল আল্লা আমাদের পরিত্রাণকর্তা। মানবাত্মা সম্পর্কে ধারণা একটি মানবিক ধারণা। বিশ্বজুড়ে মানুষে মানুষে সাংস্কৃতিক ভিন্নতা, বহুত্ববাদী সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আধ্যাত্মিক সত্যকে বারবার প্রশ্নবিদ্ধ করছে। এসব থেকে মুক্তির জন্য সার্বজনীন চেতনার গুরুত্ব অপরিসীম। মানুষে মানুষে মৈত্রী, সাম্য, ঐক্য ও পারস্পরিক বিশ্বাস এই চেতনার প্রধান দিক। স্বামী বিবেকানন্দ শুধু বাঙালির জীবনের এক আদর্শ মহামানবই নন, তিনি যুগাবতার। তাঁর দেখানো আদর্শের রাস্তা যুক্তিবোধের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায় মানুষকে। আধ্যত্মকে এক অন্য পর্যায়ে উন্নতি করে স্বামীজী সকলের জীবনকে আরও বেশি করে আলোর দিকে ঠেলে দিয়েছেন। নেতিবাচক ভাবনার অন্ধকার দিকটির পর্দা সরিয়ে তিনি বাঙালির জীবনবোধকে আরও বেশি করে অনুপ্রাণিত করেছেন। উদ্বুদ্ধ হয়েছে যুব সমাজ, আর সেজন্যই তার জন্মদিন ১২ই জানুয়ারি যুব দিবস বলে খ্যাত। স্বামীজির কিছু অমর বাণী মনে দাগ কাটে। স্বামী বিবেকানন্দ বলতেন তোমরা হৃদয়বান হও প্রেমিক হও। তোমরা কি প্রাণে প্রাণে বুঝেছ যে কোটি কোটি দেবর্ষি র বংশধর পশুর মত হয়ে দাঁড়িয়েছে। তোমরা কি প্রাণে প্রাণে অনুভব করেছো, কোটি কোটি লোক অনাহারে মরছে। কোটি কোটি লোক শতাব্দী ধরে অনেক আছে, তোমরা কি মনে প্রাণে বুঝেছ অজ্ঞতার কালোমেঘ ভারতবর্ষকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। এই সব ভাবনা কি তোমাদের অস্থির করে তুলেছে তোমাদের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। তিনি বলেছেন আমি বিশ্বাস রাখি আধুনিক যুব সমাজের উপর আমার কর্মীরা তাদের মধ্য থেকেই আসবে। সিংহের মত যে তারা দেশের সব সমস্যাগুলির সমাধান করবে। গীতা পড়ার থেকে ফুটবল খেললে ঈশ্বরের সন্ধান তাড়াতাড়ি পাওয়া যায়।একথা তিনি বলেছেন যুবদের। তিনি বলতেন তোরা মানুষ হ। তিনি বলতেন আমি এমন মানুষ চাই যাদের মাংস পেশি লোহা দিয়ে তৈরি। আর এই দেহের মধ্যে এমন মন থাকবে যা নরম উপাদানে গঠিত। অনেকে আমিষ, নিরামিষ খাওয়া নিয়ে খুব গর্ব করতেন তিনি বলতেন আমার ছেলেরা যত খুশি আমিষ খাবে।পাপ আমার হোক। কারণ তিনি চাইতেন দেশের ছেলেমেয়েরা বলিষ্ঠ ও দৃঢ় হোক। শুধু দেহ শক্ত হলে হয়না। মন শক্ত হওয়া চাই। সর্বাগ্রে চাই আত্মবিশ্বাস।যাকে তিনি শ্রদ্ধা বলতেন, কে নাস্তিক? স্বামীজি বলতেন পুরোনো মতে যাদের ঈশ্বরে বিশ্বাস নেই তারা নাস্তিক। কিন্তু আধুনিক মতে যাদের নিজেদের উপর বিশ্বাস নেই তাই নাস্তিক। স্বামীজি পাশ্চাত্যে সংঘ শক্তি দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন এই সংঘ শক্তি আমাদের দেশে আসুক আর সঙ্গে সঙ্গে আসুক পাশ্চাত্যের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিদ্যার সহায়তায় আমরা নতুন ভারত গড়ো কিন্তু তা বলে আমাদের আর্থিক সম্পদ হারাবো না সামাজিক নেতৃত্বে আমাদের দেশের তরুণরা নতুন ভারত এগিয়ে আসুক এই আশার আলো জর্জরিত ভারতের জনসাধারণ অপেক্ষা করছে।কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ভারতের প্রাচীন আদর্শ অনুশাসনের প্রতি ছিলেন পরম নিষ্ঠাবান। এমনকি চল্লিশ বছর অবধি তিনি ভারতবর্ষের সনাতন সারল্য, স্নিগ্ধতা ও অনাড়ম্বর পুজোআচরণের প্রতি ছিলেন অনুরক্ত। সংযম, বিশ্বাস, ধ্যান, মৃত্যুভয়হীন, আত্মসমাহিত শক্তি, কোমলতা ও স্বধর্ম রক্ষায় দৃঢ়তা এবং শান্তির মর্মগত বিষয়ে তিনি ছিলেন প্রাচীন বিশ্বাসী। দীর্ঘদিনের প্রথাগত সংস্কার-বিশ্বাস ও শিক্ষায় বেড়ে ওঠা হিন্দুসমাজে জন্মেছিলেন বলে কবি তার যা কিছু শ্রেষ্ঠ তাকে সমস্ত সমাজের বলে ভেবেছেন। তবে যে ধর্মসমাজে তার জন্ম তার অতিরিক্ত অর্জন আছে তাঁর পরমার্থচেতনায়। জন্মগত আর বংশগত ধর্ম তাঁর শিক্ষাদীক্ষা সংস্কৃতি ও চিন্তার ভেতর দিয়ে বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে রূপান্তরিত হয়েছে; পেয়েছে পরিপূর্ণতা। তিনি একসময় হিন্দু সম্প্রদায় ও হিন্দু আদর্শ নিয়ে প্রশস্তি গেয়েছেন (যেমন, ১৩২৪ সালে ‘আত্মপরিচয়’ রচনায়)। পরে আবার এর বিপরীত কথাও বলেছেন (যেমন, ১৩৩৯ সালে ‘কালান্তর’ গ্রন্থে)। হয়ে উঠেছেন ‘গোরা’ উপন্যাসের গোরা চরিত্রের মতো ভারতবর্ষের দেবতার পূজারি।

রবীন্দ্রনাথ উদার বিশ্বমানবিকতার কবি। বিশ্বমানব ও বিশ্বপ্রকৃতির প্রতি তাঁর অনুরাগ ছিল সংস্কারমুক্ত ও ভেদাভেদশূন্য। প্রথমদিকে সমাজ ও ধর্মের সংস্কার ও বিশ্বাসের বেড়াজাল সৃষ্টি হলেও সেই উচ্ছ্বাস ও আবেগ থেকে তিনি মুক্ত হয়ে মানবিক সত্যের মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়েছেন। তিনি যেমন ব্রাহ্মণের মিথ্যা গরিমাকে ধূলায় মিশিয়ে দিয়েছেন তেমনি হিন্দুদের দ্বারা কথিত ম্লেচ্ছ মুসলমানকে সম্মান করেছেন। কাহিনী কাব্যের ‘সতী’ কবিতায় আছে :
‘বৃথা আচার বিচার। সমাজের চেয়ে
হৃদয়ের নিত্য ধর্ম সত্য চিরদিন।’ মানুষের জয়গান ছত্রে-ছত্রে। সংস্কারমুক্ত কবি সাম্প্রদায়িক জাতিভেদের ভেদবুদ্ধিকে পরিহার করেছেন। জাতপাতের বিরুদ্ধে উঠে তাঁর কণ্ঠস্বর তীব্র হয়েছে। পত্রপুট কাব্যের পনের সংখ্যক কবিতায়। যেখানে গরীব,সমাজের নিচুতলার পক্ষে কবির চেতনা। তিনি সহজ ভক্তির আলোকে দেবতাকে পেতে চেয়েছেন। আচার সংস্কার মন্ত্র ও মন্দিরের ভেতরে নয়। এ জন্য গীতাঞ্জলির অসংখ্য কবিতায় দেখা যায় দেবতা বদ্ধ ঘরে নেই, তিনি আছেন রৌদ্র ধূলায় চাষা আর শ্রমিকের মাঝে। অবজ্ঞাত, হীন, পতিত অন্ত্যজের মধ্যে কবি দেবতা খুঁজেছেন। গীতাঞ্জলির কবিতায় কবি সব হারাদের মাঝে দেবতাকে পেয়েছেন আমরা দেখতে পাই। “যেথায় থাকে সবার অধম দীনের হতে দীন

সেইখানে যে চরণ তোমার বাজে

সবার পিছে, সবার নিচে

সব হারাদের মাঝে।”

কবিগুরু সকল গণ্ডি, সমস্ত সম্প্রদায় বিভেদ বৈষম্যের ঊর্ধ্বে মানুষের ঈশ্বরের সাধনা করেছেন, আরাধনা করেছেন। মানুষের মাঝে দেবতাকে পেয়েছেন। ‘মানুষের ধর্ম’ প্রবন্ধে নিজের সাধনা সম্পর্কে বলেছেন, ‘আমার মন যে সাধনাকে স্বীকার করে তার কথাটা হচ্ছে এই যে, আপনাকে ত্যাগ না করে আপনার মধ্যেই সেই মহান পুরুষকে উপলব্ধি করবার ক্ষেত্র আছে, তিনি নিখিল মানবের আত্মা। এই বিশ্ব মানবের আত্মাকে উপলব্ধি করার সাধনাই কবির ধর্মসাধনার পরিণাম। মানবের আত্মার স্বরূপ হচ্ছে সর্বজনীন মানব বা পরম পুরুষ। যিনি সব মানুষের হৃদয়ে সন্নিবিষ্ট থেকে মহত্ত্বের শ্রেয়োবোধের প্রেরণা দিচ্ছেন। চিত্রার ‘এবার ফিরাও মোরে’ কবিতায় তার পরিচয় আছে।
‘কে সে? জানি না কে? চিনি নাই তারে
শুধু এইটুকু জানি— তারি লাগি রাত্রি-অন্ধকারে
চলেছে মানবযাত্রী যুগ হতে যুগান্তর-পানে
ঝড়ঝঞ্ঝা বজ্রপাতে জ্বালায়ে ধরিয়া সাবধানে
অন্তরপ্রদীপখানি।… মানুষের অন্তরে এক মহামানবত্বের প্রেরণা, যা তাকে অনুপ্রাণিত করে মহত্ত্বের পথে নিয়ে যায় তাকে অনুভব করেন কবি। তবে মহামানবের কর্ণে তার আহ্বান পৌঁছায় সবার আগে। তাঁরা সংসারের সীমা ছেড়ে ছুটে আসেন। নতুন নতুন ত্যাগ ও দুঃখ বোধ প্রকাশিত হয়। মানুষের অন্তর্নিবিষ্ট মহামানবই কবির ‘সদা জনানাং হৃদয়ে আছে। মহামানবকে লাভ করার সাধনাই কবির ধর্ম সাধনা। এর নাম মানবধর্ম। কবিগুরুর আত্মদর্শন বিভিন্ন কবিতায় রূপায়িত হয়েছে। গীতমাল্যের কবিতায় মহামানবকে লাভ করার জন্য ত্যাগ ও দুঃখবরণ করে মানবাত্মার অভিসারের কথা বলা হয়েছে। দুঃখকে আত্মসাৎ করার আনন্দের কথা ‘আত্মপরিচয়ে’ বলেছেন তিনি। দুঃখের মধ্য দিয়ে সুন্দরের পরমসত্তার আবির্ভাব ঘটে। মানবাত্মা পরিশুদ্ধ হয়। গীতবিতানের পূজা পর্যায়ের গানে আছে, “দুঃখ যদি না পাবে তো দুঃখ তোমার ঘুচবে কবে। / বিষকে বিষের দাহ দিয়ে দহন করে মারতে হবে। …মরতে মরতে মরণটারে শেষ করে দে একেবারে/ তার পরে সেই জীবন এসে আপন আসন আপনি লবে।” কবির দেবতা রুদ্র, শান্ত, শিবম। দুঃখ আঘাতে তাঁকে পাওয়া যায়। খেয়ার ‘আগমন’-এ আছে সেই রুদ্র রূপ। ‘এই করেছ ভালো নিঠুর’/ কিংবা ‘আরো কি বাণ তোমার তুণে আছে’- দুঃখকে আহ্বান করার গান। দুঃখ ও কঠোর অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে মহামানবের সাধনা পূর্ণ হয়। তবে তাঁর সাহচর্য কখনো কখনো আনন্দময়। বিভিন্ন কবিতায় ব্যক্ত ‘খেলার সঙ্গিনী’, ‘নর্মসহচরী’, ‘মানসসুন্দরী’ কবির জীবনের নিয়ন্ত্রণকর্ত্রী জীবনদেবতায় পরিণত। চিত্রা কাব্যের জীবনদেবতা, রাজা, অরূপরতন নাটকের রাজা এবং খেয়া কাব্যের দুঃখরাতের রাজা ও রাজার দুলাল একই সত্তার ভিন্ন রূপ। একই দেবতা বিচিত্র রূপে কবির কাছে দেখা দিয়েছে। গীতাঞ্জলির গানে আছে প্রকৃতির নিবিড় সাহচর্যে কবি তার অমৃত স্পর্শ লাভ করেছেন। হৃদয়দেবতার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বভুবনের প্রতি কবির ছিল বিস্ময়। গীতাঞ্জলির গানে আছে ‘সীমার মাঝে অসীম তুমি/ বাজাও আপন সুর/ আমার মধ্যে তোমার প্রকাশ/ তাই এত মধুর।’ জগতের সামান্য বস্তুর মধ্যেও অপরিমেয়তার অশেষ ব্যঞ্জনা আছে। কবি বিশ্বপ্রকৃতিতে নিসর্গ সৌন্দর্যে মানব সম্বন্ধের মধ্য দিয়ে সীমাহীন অনির্বচনীয়তা লক্ষ্য করেছেন। অনন্ত অসীম পরম রহস্যময় প্রকাশ, ‘যা দেখেছি যা পেয়েছি তুলনা তার নাই।’ গীতাঞ্জলির ৩০ নম্বরে সৃষ্টির সকল আনন্দময় প্রকাশ আছে। অন্তর অনুভূতির গভীর আকুতি মিশেে আছেে,

“এই তো তোমার প্রেম ওগো

হৃদয় হরণ

এই যে পাতায় আলো নাচে

সোনার বরণ।।
এই যে মধুর আলস বরে
মেঘ ভেসে যায় আকাশ পরে
এই যে বাতাস দেহে করে
অমৃত ক্ষরণ।। ” মানুষ ও মানব সংসারের মধ্য দিয়ে কবি তাঁর পরমেশ্বরের আনন্দরূপ দেখেছেন। কবিতায় তিনি অমৃতময় ভূমাকে পরমানন্দময় জীবনদেবতাকে লাভ করেছেন।

‘এই বসুধার
মৃত্তিকার পাত্রখানি ভরি বারম্বার
তোমার অমৃত ঢালি দিবে অবিরত
নানাবর্ণগন্ধময়।…
যে-কিছু আনন্দ আছে দৃশ্যে গন্ধে গানে
তোমার আনন্দ রবে তার মাঝখানে।’

“তিনি গেছেন সেথায়, যেথায় করছে চাষা চাষ পাথর ভেঙে কাটছে যারা পথ খাটছে বারোমাস, রৌদ্রে জলে আছেন সবার সাথে ধুলা তাহার লেগেছে দুই হাতে, তারি মতন শুচি বসন ছাড়ি, আয়রে ধুলার ‘পরে “।

আবার তিনি বলেছেন কবিতায়,” মুক্তি ওরে মুক্তি কোথায় পাবি, মুক্তি কোথায় আছে, আপনি প্রভু সৃষ্টি বাঁধন ‘পরে বাঁধা সবার কাছে”।

আবার স্বামী বিবেকান্দ বলেছেন, ‘কেবল শারীরিক সাহায্য দ্বারা জগতের দুঃখ দূর করা যায় না। যতদিন না মানুষের প্রকৃতি পরিবর্তিত হইতেছে, ততদিন এই শারীরিক অভাবগুলি সর্বদাই আসিবে এবং দুঃখ অনুভূত হইবেই হইবে। যতই শারীরিক সাহায্য কর না কেন, কোনমতেই দুঃখ একেবারে দূর হইবে না। জগতের এই দুঃখ-সমস্যার একমাত্র সমাধান মানবজাতিকে শুদ্ধ ও পবিত্র করা। আমরা জগতে যাহা কিছু দুঃখকষ্ট ও অশুভ দেখিতে পাই, সবই অজ্ঞান বা অবিদ্যা হইতে প্রসূত। মানুষকে জ্ঞানালোক দাও, সকল মানুষ পবিত্র আধ্যাত্মিক-বলসম্পন্ন ও শিক্ষিত হউক, কেবল তখনই জগৎ হইতে দুঃখ নিবৃত্ত হইবে, তাহার পূর্বে নয়। দেশে প্রত্যেকটি গৃহকে আমরা দাতব্য আশ্রমে পরিণত করিতে পারি, হাসপাতালে দেশ ছাইয়া ফেলিতে পারি, কিন্তু যতদিন না মানুষের স্বভাব বদলাইতেছে, ততদিন দুঃখ-কষ্ট থাকিবেই থাকিবে।’

স্বামীজি বলতেন ভারতের জাতীয় অপরাধ সে তার জনসাধারণকে অবজ্ঞা করে এসেছে। এই পাপের ফলে ভারত এত দুর্বল। বার বার বিদেশি শক্তির কাছে পদানত হয়েছে। জনসাধারণের বৃহত্তর অংশ হচ্ছে শূদ্র। খেটে খাওয়া মানুষ যারা মাঠে চাষ করে কলকারখানায় হাতুড়ি পেটায়। এরা দেশ গড়ে কিন্তু এরা সে ধন থেকে বঞ্চিত। আবার কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একই কথা বলেছেন তিনি বলেছেন যারা মাঠে ঘাটে খাটে তারাই তো আসল দেবতা। তাদের মধ্যেই দেবতা বিরাজ করে। তুমি রুদ্ধদ্বারে দেবালয়ের কোণে কেন ভগবানকে খোঁজো। সেখানে ঈশ্বর নেই। সেখানে ঈশ্বর নেই, যেখানে শুধু ধর্মের আড়ালে ক্ষমতার বড়াই করে গরীবের ঘাম কেড়ে খাওয়া লোভি হায়েনার দল। তাহলে দেখা যাচ্ছে, গ্রেট মেন থিংকস আ্যালাইক।যারা বিদ্বজ্জন যারা মহাপুরুষ, জ্ঞানী তারা একই রকম চিন্তা করে থাকেন এটাই আমাদের প্রবন্ধের মূল বক্তব্য। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর স্বামী বিবেকানন্দের মধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে একই সুরে সুর মিলে যায়। তারা মানুষের জয়গান করেছেন চিরকাল। মানুষের জয়গান করেছেন ভগবান যিশু, বুদ্ধ সকলে। আমরা তো সামান্য লোক।তাই তাঁদের পথ ধরে চিরকাল অনুসরণ করে যাই আলোপথ।কবির ভাষায় বলি, ” মহাজ্ঞানী মহাজন, যে পথে করে গমন, হয়েছেন চিরস্মরণীয়, সেই পথ লক্ষ্য করে স্বীয় কীর্তি ধ্বজা ধরে আমরাও হব বরণীয় “।

 

নানা প্রতিকূলতার মধ্যে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী এমন ভূমি তৈরি করেছিলেন যে ভূমিতে পরপর তৈরি হয়েছে নানান সাহিত্যিক। তখনকার দিনে ছাপাখানা অত সহজ ছিলনা উপেন্দ্রকিশোর নানা বাধা অতিক্রম করে এই ছাপাখানা বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করেন এবং তিনি নিজের হাতেই প্রচ্ছদ নির্মাণ এবং এর যাবতীয় ছবি আঁকা সবকিছু নিজের হাতেই করতেন ।

একটা চারা গাছ রোপন করে তাকে যত্ন করে তার যোগ্য মাটিতে থাকে পথে তাকে সার দিয়ে বড় করতে হয় তবেই সে বড় হয় এবং ফল-ফুল প্রদান করে। তেমনি একটি সন্তান সুন্দর পরিবেশে সুন্দর পরিবারে জন্মগ্রহণ করে যদি যথোপযুক্ত মাধ্যমে মানুষ হয় সে পৃথিবীতে আপন স্থান করে নেয় স্বমহিমায়।এমনই একটা যোগ্য পরিবার রায় পরিবার যেখানে সন্তানদের মানুষ হবার মতো বিখ্যাত সকল পরিবেশ বিদ্যমান এবং তাদের সেই লড়াকু মনোভাব ও বিদ্যমান।

প্রসিদ্ধ শিশুসাহিত্যিক, চিত্রশিল্পী, বাংলা মুদ্রণশিল্পের অন্যতম রূপকার, ১৮৬৩ সালের ১০ মে ময়মনসিংহ জেলার মসুয়া গ্রামে উপেন্দ্রকিশোর জন্মগ্রহণ করেন। পিতামাতার আট সন্তানের মধ্যে উপেন্দ্রকিশোর ছিলেন তৃতীয় সন্তান। তাঁর পিতৃদত্ত নাম ছিল কামদারঞ্জন। পাঁচ বছর বয়সের সময় তাঁর পিতা কালীনাথ রায় ওরফে শ্যামসুন্দর মুন্সীর কাছ থেকে নিকট আত্মীয় ময়মনসিংহের জমিদার হরিকিশোর চৌধুরী তাঁকে পোষ্যপুত্র হিসেবে গ্রহণ করে নতুন নাম রাখেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। সুপন্ডিত জমিদার হরিকিশোর রায়চৌধুরীর পৃষ্ঠপোষকতায় উপেন্দ্রকিশোরের শিক্ষাজীবন শুরু হয় এবং ময়মনসিংহ জিলা স্কুল থেকে ১৮৮০ সালে বৃত্তি নিয়ে প্রবেশিকা পরীক্ষা পাস করেন। স্কুল জীবনেই তিনি চিত্রাঙ্কনে দক্ষতা অর্জন করেন। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে কিছুকাল অধ্যয়নের পর কলকাতা মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউটে ভর্তি হন এবং ১৮৮৪ সালে সেখান থেকে বিএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এ সময় তিনি ব্রাহ্মসমাজে যোগ দেন এবং প্রখ্যাত সমাজসেবী দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের জ্যেষ্ঠ কন্যা বিধুমুখীর সঙ্গে বিবাহ হয়।

কোনো বাধা কোনো বিপত্তি উপেন্দ্রকিশোরের সামনে দাঁড়াতে পারেনি। সকলকে সকল বাধাকে তুচ্ছ জ্ঞান করে তিনি এগিয়ে চলেছেন সদর্পে। পরিবারকে তিনি এমন এক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন যেখানে যে কোন সন্তান জন্ম নিলে সে বড় হবেই এমন একটা পরিবেশ গড়ে তোলা একজনের পক্ষে কতটা কঠিন সে যে করেছে সেই জানে। তারপরে কি হয়েছে, উপেন্দ্রকিশোরে পরবর্তী সন্তান সুকুমার রায় সাহিত্য জগতে এক নক্ষত্র হয়েছেন। তারপর সুকুমার রায় সত্যজিৎ রায় ও নক্ষত্র হয়েছেন এবং সত্যজিৎ রায়ের পুত্র সন্দীপ রায় সাহিত্য আকাশে নক্ষত্র স্থান অধিকার করেছেন তারপরও হয়তো তোকে দেখে যাবেন কোন হীরের টুকরো দেখে যাবেন তার বংশে।

কিশোর বয়সেই উপেন্দ্রকিশোরের সাহিত্যসৃষ্টির হাতেখড়ি ঘটে এবং তখনকার কিশোরপত্রিকা সখা, বালক, সাথী, সখা ও সাথী, মুকুল ইত্যাদির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৮৮৩ সালে ছাত্রাবস্থায় সখা পত্রিকায় তাঁর প্রথম রচনা প্রকাশিত হয়। তাঁর সমগ্র জীবনেই তিনি নিরবচ্ছিন্নভাবে সাহিত্যচর্চা অব্যাহত রাখেন। শিশুকিশোর সাহিত্যের প্রায় সকল শাখায় বিচরণ করে তিনি বাংলা শিশুসাহিত্যের দিকনির্দেশকের ভূমিকা পালন করেন। চমকপ্রদ নানা চিত্র সংযোজন উপেন্দ্রকিশোরের প্রকাশনার এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল। অপূর্ব দক্ষতায় শিল্পী রায়চৌধুরীর সম্পাদনা করেন ১৯১৩ সালে বিখ্যাত মাসিক পত্রিকা সন্দেশ। প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯১৩ সালে। আজও কলকাতা থেকে প্রকাশিত একটি জনপ্রিয় শিশুকিশোর সাহিত্য পত্রিকা হল সন্দেশ । দেশবিদেশের গল্প, হাস্যকৌতুক, জ্ঞান বিজ্ঞানের কথা ইত্যাদি লেখার পাশাপাশি নিজের নানা বুদ্ধিদীপ্ত ছবি সংযোজনের মাধ্যমে সন্দেশকে তিনি কিশোর পত্রিকা হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন।

উপেন্দ্রকিশোর কিশোরদের জন্য বহু সাহিত্য পুস্তক রচনা করেছেন, এর মধ্যে উলে­খযোগ্য গ্রন্থ,ছোটদের রামায়ণ, ছোটদের মহাভারত, সেকালের কথা, মহাভারতের গল্প, ছোট্ট রামায়ণ, টুনটুনির বই এবং গুপী গাইন বাঘা বাইন। বইগুলির প্রচ্ছদ এবং ভেতরের ছবিও তিনি নিজেই অঙ্কন করেন। এ ছাড়া বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়-এর উপন্যাসের ইংরেজি অনুবাদ এবং রবীন্দ্রনাথের ‘নদী’ কবিতার সঙ্গে সংযোজিত তাঁর অঙ্কন বিশেষ প্রশংসা লাভ করে। চিত্রাঙ্কনে তিনি সচরাচর পাশ্চাত্য প্রথায় তেলরঙ ও কালিকলম ব্যবহার করতেন। জলরঙের ছবিতেও তিনি কুশলী ছিলেন। ‘বলরামের দেহত্যাগ’ তাঁর অঙ্কিত একটি বিখ্যাত চিত্র।উপেন্দ্রকিশোর তাঁর প্রথম বই ছোটদের রামায়ণ।

বিশ্বে তখন রঙীন ছবি প্রযুক্তি প্রারম্ভিক পর্যায়ে মাত্র। গণিতে গভীর ব্যুৎপত্তি এবং সূক্ষ্ম বৈজ্ঞানিক দৃষ্টির সাহায্যে উপেন্দ্রকিশোর এদেশে বসেই এ বিষয়ে অনেক নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। নানা ধরনের ডায়াফ্রাম তৈরি, রে-স্ক্রিন অ্যাডজাস্টার যন্ত্র নির্মাণ, ব্লক নির্মাণের ডায়োটাইপ ও রি-প্রিন্ট পদ্ধতির উদ্ভাবন তাঁর মৌলিক অবদান। পশ্চিমা দেশে তাঁর উদ্ভাবিত প্রযুক্তি ও মুদ্রণ প্রণালীসমূহ বেশ প্রশংসিত হয়। লন্ডন থেকে প্রকাশিত পেনরোজেজ পিকটোরিয়াল অ্যানুয়াল পত্রিকার বিভিন্ন সংখ্যায় এ প্রসঙ্গে তাঁর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধও প্রকাশিত হয়। উপেন্দ্রকিশোর প্রতিষ্ঠিত ‘ইউ রায় অ্যান্ড সন্স’ কোম্পানির মাধ্যমেই ভারতবর্ষে প্রসেস-মুদ্রণ শিল্প বিকাশের সূত্রপাত ঘটে।

বাল্যকাল থেকেই উপেন্দ্রকিশোর সঙ্গীতচর্চার প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। তিনি পাখোয়াজ, হারমোনিয়াম, সেতার, বাঁশি, বেহালা ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র বাদনে দক্ষতা অর্জন করেন। তবে বেহালাই ছিল তাঁর বিশেষ প্রিয়। আদি ব্রাহ্মসমাজের উৎসবসমূহে সঙ্গীতের সঙ্গে তাঁর বেহালার বাজনা ছিল একটি বড় আকর্ষণ। পাশ্চাত্য সঙ্গীত সম্পর্কেও তিনি গভীর জ্ঞান অর্জন করেন। বেহালা শিক্ষা এবং হার্মোনিয়াম শিক্ষা নামে তাঁর দুটি বই বিখ্যাত। তাঁর পুত্র সুকুমার রায়ের জন্ম ১৮৮৭ সালের ৩০শে অক্টোবর, কলকাতার এক ব্রাহ্ম পরিবারে। সুকুমারের মা বিধুমুখী দেবী ছিলেন ব্রাহ্মসমাজের দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের মেয়ে। সুবিনয় রায় ও সুবিমল রায় তাঁর দুই ভাই। এ ছাড়াও তাঁর ছিল তিন বোন।

সব রকমের সুবিধা নিয়ে সুন্দর পরিবেশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন উপেন্দ্রকিশোরের সন্তান সুকুমার রায়। উপেন্দ্রকিশোরের তৈরী জমিতে তার সন্তান জন্মেছিলেন। তার ফলে সাহিত্য আকাশে বড় হতে তার খুব বেশি বিলম্ব হয়নি।

সুকুমার রায় জন্মেছিলেন বাঙালি নবজাগরণের স্বর্ণযুগে। তাঁর পারিবারিক পরিবেশ ছিল সাহিত্যনুরাগী, যা তাঁর মধ্যকার সাহিত্যিক প্রতিভা বিকাশে সহায়ক হয়। পিতা উপেন্দ্রকিশোর ছিলেন শিশুতোষ গল্প ও জনপ্রিয়-বিজ্ঞান লেখক, চিত্রশিল্পী, সুরকার ও শৌখিন জ্যোতির্বিদ। উপেন্দ্রকিশোরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, যিনি সুকুমারকে সরাসরি প্রভাবিত করেছিলেন। এ ছাড়াও রায় পরিবারের সাথে জগদীশ চন্দ্র বসু, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় প্রমুখের সম্পর্ক ছিল। উপেন্দ্রকিশোর ছাপার ব্লক তৈরির কৌশল নিয়ে গবেষণা করেন, এ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান এবং মানসম্পন্ন ব্লক তৈরির একটি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। মেসার্স ইউ রয় অ্যান্ড সন্স নামে ঐ প্রতিষ্ঠানের সাথে সুকুমার যুক্ত ছিলেন।

কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৯০৬ সালে রসায়ন ও পদার্থবিদ্যায় বি.এসসি.(অনার্স) করার পর সুকুমার মুদ্রণবিদ্যায় উচ্চতর শিক্ষার জন্য ১৯১১ সালে বিলেতে যান। সেখানে তিনি আলোকচিত্র ও মুদ্রণ প্রযুক্তির ওপর পড়াশোনা করেন এবং কালক্রমে তিনি ভারতের অগ্রগামী আলোকচিত্রী ও লিথোগ্রাফার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ১৯১৩ সালে সুকুমার কলকাতাতে ফিরে আসেন। সুকুমার ইংল্যান্ডে পড়াকালীন, উপেন্দ্রকিশোর জমি ক্রয় করে, উন্নত-মানের রঙিন হাফটোন ব্লক তৈরি ও মুদ্রণক্ষম একটি ছাপাখানা স্থাপন করেছিলেন। তিনি ছোটদের একটি মাসিক পত্রিকা, ‘সন্দেশ’, এই সময় প্রকাশনা শুরু করেন। সুকুমারের বিলেত থেকে ফেরার অল্প কিছু দিনের মধ্যেই উপেন্দ্রকিশোরের মৃত্যু হয়। উপেন্দ্রকিশোর জীবিত থাকতে সুকুমার লেখার সংখ্যা কম থাকলেও উপেন্দ্রকিশোরের মৃত্যুর পর সন্দেশ পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্ব সুকুমার নিজের কাঁধে তুলে নেন।সুকুমার রায় ছিলেন উপেন্দ্রকিশোরের পরবর্তী যোগ্য বংশধর। তিনি বাবার সমস্ত ছাপাখানা, প্রচ্ছদ শৈলী আয়ত্ত করেন অল্পসময়ে। নিজেও তিনি সাহিত্য আকাশে এক স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিগণিত হন।

 

শুরু হয় বাংলা শিশুসাহিত্যের এক নতুন অধ্যায়। পিতার মৃত্যুর পর আট বছর ধরে তিনি সন্দেশ ও পারিবারিক ছাপাখানা পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর ছোটভাই এই কাজে তাঁর সহায়ক ছিলেন এবং পরিবারের অনেক সদস্য ‘সন্দেশ’-এর জন্য নানাবিধ রচনা করে তাঁদের পাশে দাড়ান।সুকুমার রায়ের স্বল্পস্থায়ী জীবনে তাঁর প্রতিভার শ্রেষ্ঠ বিকাশ লক্ষ করা যায়। সন্দেশ পত্রিকার সম্পাদক থাকাকালীন সময়ে তাঁর লেখা ছড়া, গল্প ও প্রবন্ধ আজও বাংলা শিশুসাহিত্যে মাইলফলক হয়ে আছে। তাঁর বহুমুখী প্রতিভার অনন্য প্রকাশ তাঁর অসাধারণ ননসেন্স ছড়াগুলোতে। তাঁর প্রথম ও একমাত্র ননসেন্স ছড়ার বই আবোল তাবোল শুধু বাংলা সাহিত্যে নয়, বরং বিশ্বসাহিত্যের অঙ্গনে নিজস্ব জায়গার দাবিদার।প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়বার সময় তিনি ননসেন্স ক্লাব নামে একটি সংঘ গড়ে তুলেছিলেন। এর মুখপাত্র ছিল সাড়ে বত্রিশ ভাজা নামের একটি পত্রিকা। সেখানেই তাঁর আবোল তাবোল ছড়ার চর্চা শুরু। পরবর্তীতে ইংল্যান্ড থেকে ফেরার পর মন্ডা ক্লাব (ইংরেজি ভাষা) নামে একই ধরনের আরেকটি ক্লাব খুলেছিলেন তিনি। মন্ডা ক্লাবের সাপ্তাহিক সমাবেশে সদস্যরা ‘জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ’ পর্যন্ত সব বিষয়েই আলোচনা করতেন। সুকুমার রায় মজার ছড়ার আকারে এই সাপ্তাহিক সভার কয়েকটি আমন্ত্রণপত্র করেছিলেন সেগুলোর বিষয়বস্তু ছিল মুখ্যত উপস্থিতির অনুরোধ এবং বিশেষ সভার ঘোষণা ইত্যাদি। সুকুমার রায়ের মজার ছড়া পড়তে পড়তে কখন যে শিশু কিশোর বেলায় ফিরে যায় মানুষ তা বুঝতেও পারে না। এক অমলিন হাসির আড়ালে কত শিক্ষা যে লুকিয়ে আছে তার ইয়ত্তা নেই। সুকুমার লেখচিত্রী হিসেবে সুনাম অর্জন করেছিলেন। তাঁর প্রযুক্তিবিদের পরিচয় মেলে, নতুন পদ্ধতিতে হাফটোন ব্লক তৈরি আর ইংল্যান্ডের কয়েকটি পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর প্রযুক্তি বিষয়ক রচনাগুলো থেকে।সুকুমার রায়ের সৃষ্টি আজও আমাদের আলোড়িত করে। সেই তালিকায় রয়েছে আবোল তাবোল, পাগলা দাশু, হ য ব র ল, চলচ্চিত্র সহ অসংখ্য মণি। সোনার চামচ মুখে নিয়ে সোনার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন সত্যজিৎ রায়।তাঁর নেশা এবং সাধনা ছিল সিনেমাশিল্প। চলচ্চিত্র পরিচালনায় তাঁর অসাধারণ মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি বাংলা চলচ্চিত্রে একটি নতুন মাত্রা তৈরি করেছিল। এটা বললে ভুল হবে না যে শুধুমাত্র সত্যজিৎ রায়ের কারণেই আজ বাংলা ভাষায় তৈরি চলচ্চিত্র পৃথিবী জুড়ে সম্মানের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়। অনেকেই বলেন সত্যজিৎ রায় তাঁর ছবির মাধ্যমে বাংলার সমাজ ও সংস্কৃতিকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরেছিলেন। অস্কার পেয়েছেন পথের পাঁচালী সিনেমা থেকে।

চলচ্চিত্র নির্মাতা, চিত্রনাট্যকার, শিল্প নির্দেশক, সঙ্গীত পরিচালক এবং লেখক সত্যজিৎ রায় বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র নির্মাতাদের একজন হিসেবে বিশ্বে পরিচিতি লাভ করেছিলেন।

তাঁর পূর্বপুরুষের ভিটা ছিল তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের কিশোরগঞ্জে উপজেলার মসুয়া গ্রামে। সেসময় তিনি ছিলেন ব্রাহ্ম আন্দোলনের অন্যতম একজন নেতা। তাঁর নিজের একটি ছাপাখানাও ছিল। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় ১৮ বৈশাখ ১৩২৮ বঙ্গাব্দে কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম সুকুমার রায়, মাতার নাম সুপ্রভা দেবী। আদি নিবাস ছিল বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জ জেলার মসুয়া গ্রামে।প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন তাঁর মায়ের কাছে। ৮ বৎসর বয়সে সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি হন। বিগত বংশধরদের মতো সত্যজিৎ রায় ও নানা বিষয়ে পারদর্শী ছিলেন। শুধু চলচ্চিত্র পরিচালক নয় তিনি ছিলেন সাহিত্যিক, তিনি ছিলেন শিল্পী তিনি ছিলেন নানা গুণে গুণান্বিত।

 

১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে বিদ্যালয়ের পাঠ শেষে তিনি ভর্তি হন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ প্রেসিডেন্সি কলেজে। পড়াশোনাতে সত্যজিৎ রায় খুব ভালো ছিলেন। তিনি সর্ববিষয়ে জ্ঞান অর্জন করতেন। বই পড়তে তার অনীহা ছিল না সব সময় বই পড়তে ভালো লাগতো। বাইরের বই পড়ে পড়ে তিনি অসংখ্য জ্ঞান অর্জন করেন। এই কলেজে প্রথম দু’ বছর বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করেন। শেষ বছরে বিষয় পাল্টে তিনি অর্থনীতি পড়েন। ফলে তাঁর লেখাপড়ার সময় দীর্ঘতর হয়ে উঠে। এই সময়ে ইনি পাশ্চাত্য চিরায়ত চলচ্চিত্র এবং সঙ্গীত নিয়ে এতটাই আগ্রহী হয়ে উঠেন যে, তাঁর মূল পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটে। শেষ পর্যন্ত তিনি ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বিএ (অনার্স) পাশ করেন।মায়ের উৎসাহে সত্যজিৎ ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে শান্তিনিকেতনে যান এবং সেখানকার কলাভবনে ভর্তি হন। এই সূত্রে তিনি বিখ্যাত চিত্রশিল্পী নন্দলাল বসু এবং বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের কাছে শিক্ষালাভের সুযোগ পান। নিয়মানুযায়ী বিশ্বভারতীতে সত্যজিতের পাঁচ বছর পড়াশোনা করার কথা থাকলেও তার আগেই তিনি শান্তিনিকেতন ছেড়ে কলকাতায় চলে আসেন।

১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে ডি জে কেমার নামক ব্রিটিশ বিজ্ঞাপন সংস্থায় ‘জুনিয়র ভিজুয়ালাইজার’ পদে যোগদান করেন। এখানে তিনি বেতন পেতেন ৮০ টাকা। ইনি প্রথম বিজ্ঞাপনে ভারতীয় ধাঁচের ক্যালিওগ্রাফিক উপাদান ব্যবহার করা শুরু করেন। একই সঙ্গে তিনি অক্ষরশৈলীতে বিশেষ আগ্রাহী হয়ে উঠেন। তাঁর নকশা করা দুটি ফন্ট ‘Ray Roman’ এবং ‘Ray Bizarre’ ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে অনুষ্ঠিত একটি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় পুরস্কার লাভ করেছিল।

তারপর তার চলচ্চিত্র বিষয়ে আগ্রহ আরও বেড়ে যায়।। তিনি চলচ্চিত্র বিষয়ে পড়াশোনা আরম্ভ করেন। বিভিন্ন দেশ-বিদেশের বই পড়তে শুরু করেন এবং সঙ্গে সঙ্গে বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালী রুপোর কাজ শুরু করেন।

এই সময় থেকে খুব আগ্রহ নিয়ে চলচ্চিত্র দেখা শুরু করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি কলকাতায় অবস্থানরত মার্কিন সেনাদের সাথে যোগাযোগ করে নতুন মার্কিন চলচ্চিত্রগুলোর বিষয়ে খবর নিতেন। বিশেষ করে নরম্যান ক্লেয়ার নামের রয়্যাল এয়ারফোর্সের এক কর্মচারী এ বিষয়ে তাঁকে বিশেষ ভাবে সাহায্য করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে কলকাতার প্রেক্ষাগৃহগুলোতে হলিউডে নির্মিত প্রচুর ছবি দেখানো হতো। এই সূত্রে হলিউডের চলচ্চিত্রগুলো কলকাতার চলচ্চিত্র প্রেমিকদের কাছে প্রধান আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠেছিল। ১৯৪৭ সালে সত্যজিৎ এবং বংশী চন্দ্রগুপ্ত কলকাতা ফিল্ম সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন। এই সোসাইটিতে চলচ্চিত্র দেখানো হতো এবং এই বিষয়ে পরে ঘরোয়াভাবে আলোচনার ব্যবস্থা করা হতো। উল্লেখ্য এই সমিতি প্রথম প্রদর্শন করেছিল ‘ব্যাটেলশিপ পটেমকিন’। ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে তৈরি নির্বাক চলচ্চিত্র। পরিচালক ছিলেন সোভিয়েত রাশিয়ার সেরগেই আইজেনস্টাইন।সত্যজিৎ রায়ের সুপুত্র সন্দীপ রায় এখন সন্দেশ পত্রিকার সম্পাদক। সন্দীপ রায়ের পরিচালনায় গুপি বাঘা ফিরে এল, চলচ্চিত্র দর্শকমহলে সমাদৃত হয়েছে। সন্দীপ রায় হয়ত আবার রেখে যাবেন কোন হীরের টুকরো, রায় পরিবারের যোগ্য উত্তরসূরী।

বর্তমান পূর্ববর্ধমান জেলা অনেক কবি সাহিত্যিকের পীঠস্থান। কবি কাশীরাম দাস থেকে শুরু করে কবিশেখর কালিদাস রায়, কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিক ইত্যাদি। আজ আমি কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিকের জীবনী ও সাহিত্য সম্পর্কে দু চার কথা বলব। উনবিংশ শতকে সমগ্র বাংলা সাহিত্য জগত যখন কবি গুরু রবীন্দ্রনাথের কাব্যগাথার ছটায় উদ্ভাসিত , ঠিক সেই সময় নিজের স্বতন্ত্র লেখনী প্রতিভা নিয়ে কাব্য জগতে আবির্ভূত হলেন কবি কুমুদ রঞ্জন মল্লিক। তিনি ১৮৮৩ সনের ৩রা মার্চ অবিভক্ত বাংলার, বর্ধমান জেলার কোগ্রাম নামক গ্রামে এক বৈদ্য ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ছাত্র হিসাবে তিনি খুবই মেধাবী ছিলেন। ১৯০৫ সনে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হন এবং বঙ্কিম চন্দ্র স্বর্ণ পদকে ভূষিত হন।

পরবর্তীকালে বর্ধমানের মাথ্রন নবীনচন্দ্র বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার কাজে যোগ দেন এবং এই বিদ্যালয়ের শিক্ষার আলোকেই পরবর্তীকালে বাংলার আর এক স্বনামধন্য কবি বিদ্রোহী কবি রূপে আত্মপ্রকাশ করেন ।কথিত আছে তাঁর গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া অজয় ও কুনুর নদীই তাঁর কবিতার মুখ্য প্রেরণা। তাঁর কবিতা মুখ্যত বৈষ্ণব ভাবনায় সম্পৃক্ত হলেও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও গ্রাম বাংলার প্রতি ভালবাসা তাঁর কবিতাগুলিকে করেছে এক অনবদ্য সৃষ্টির আধার। তাঁর কবিতায় ধর্মের উপস্থিতি থাকলেও তা ছিল ধর্মীয় সংকীর্ণতার উরদ্ধে। তাঁর রচিতউল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলি হল উজানী (১৯১১), বনতুলসী (১৯১১), অজয়(১৯২৭), স্বর্ণ সন্ধ্যা (১৯৪৮) প্রভৃতি। তবে তিনি তাঁর সাহিত্যকর্মকে কাব্য জগতে আবদ্ধ না রেখে নাট্য রচনার দিকেও প্রসারিত করেছিলেন। তাঁর রচিত উল্লেখযোগ্য নাটক হল দ্বারাবতী (১৯২০)। তিনি জগত্তারিণী স্বর্ণ পদক এবং স্বাধীনতার পর ভারত সরকার দ্বারা পদ্মশ্রী পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন |
কুমুদরঞ্জন ১৯০১ সালে এন্ট্রান্স, ১৯০৩ সালে রিপন কলেজ থেকে এফএ এবং ১৯০৫ সালে বঙ্গবাসী কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। পরে বর্ধমানের মাথরুন উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন এবং সেখান থেকেই ১৯৩৮ সালে প্রধান শিক্ষকরূপে অবসর গ্রহণ করেন। উল্লেখ্য যে, কাজী নজরুল ইসলাম ওই স্কুলে তাঁর ছাত্র ছিলেন। কুমুদরঞ্জনের কবিত্বশক্তির বিকাশ ঘটে বাল্যকালেই। পল্লীর মানুষ ও প্রকৃতি তাঁর কাব্যের প্রধান বিষয়। তাঁর কবিতায় নির্জন গ্রামজীবনের সহজ-সরল রূপ চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। পল্লী-প্রবণতার সঙ্গে বৈষ্ণবভাবুকতা যুক্ত হয়ে তাঁর কবিতার ভাব ও ভাষাকে স্নিগ্ধতা ও মাধুর্য দান করেছে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘কুমুদরঞ্জনের কবিতা পড়লে বাঙলার গ্রামের তুলসীমঞ্চ, সন্ধ্যাপ্রদীপ, মঙ্গলশঙ্খের কথা মনে পড়ে।’ তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনা: উজানী (১৯১১), বনতুলসী (১৯১১), শতদল (১৯১১), একতারা (১৯১৪), বনমল্লিকা (১৯১৮), নূপুর (১৯২০), রজনীগন্ধা (১৯২১), অজয় (১৯২৭), তূণীর (১৯২৮), স্বর্ণসন্ধ্যা (১৯৪৮) ইত্যাদি।শিক্ষাবিদ, কবি। ১৮৮৩ সালের ১ মার্চ পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার কোগ্রামে মাতুলালয়ে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস একই জেলার শ্রীখন্ড গ্রামে। পিতা পূর্ণচন্দ্র মল্লিক ছিলেন কাশ্মীর রাজসরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা।কুমুদরঞ্জন ১৯০১ সালে এন্ট্রান্স, ১৯০৩ সালে রিপন কলেজ থেকে এফএ এবং ১৯০৫ সালে বঙ্গবাসী কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। পরে বর্ধমানের মাথরুন উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন এবং সেখান থেকেই ১৯৩৮ সালে প্রধান শিক্ষকরূপে অবসর গ্রহণ করেন। উল্লেখ্য যে, কবি নজরুল ওই স্কুলে তাঁর ছাত্র ছিলেন। কুমুদরঞ্জনের কবিত্বশক্তির বিকাশ ঘটে বাল্যকালেই। পল্লীর মানুষ ও প্রকৃতি তাঁর কাব্যের প্রধান বিষয়। তাঁর কবিতায় নির্জন গ্রামজীবনের সহজ-সরল রূপ চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। পল্লী-প্রবণতার সঙ্গে বৈষ্ণবভাবুকতা যুক্ত হয়ে তাঁর কবিতার ভাব ও ভাষাকে স্নিগ্ধতা ও মাধুর্য দান করেছে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘কুমুদরঞ্জনের কবিতা পড়লে বাঙলার গ্রামের তুলসীমঞ্চ, সন্ধ্যাপ্রদীপ, মঙ্গলশঙ্খের কথা মনে পড়ে।’ তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনা: উজানী (১৯১১), বনতুলসী (১৯১১), শতদল (১৯১১), একতারা (১৯১৪), বনমল্লিকা (১৯১৮), নূপুর (১৯২০), রজনীগন্ধা (১৯২১), অজয় (১৯২৭), তূণীর (১৯২৮), স্বর্ণসন্ধ্যা (১৯৪৮) ইত্যাদি। কুমুদরঞ্জন বাংলার কবি-সাহিত্যিকদের প্রতিষ্ঠান সাহিত্যতীর্থের ‘তীর্থপতি’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। সাহিত্যে অবদানের জন্য তিনি কলকাতা ইউনিভার্সিটি কর্তৃক ‘বঙ্কিমচন্দ্র স্বর্ণপদক’ (১৯০৫) ও ‘জগত্তারিণী স্বর্ণপদক’ এবং ভারত সরকার কর্তৃক ‘পদ্মশ্রী’ উপাধিতে ভূষিত হন। ১৯৭০ সালের ১৪ ডিসেম্বর তাঁর মৃত্যু হয়। বর্ধমান জেলার মাথরুন নবীনচন্দ্র বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকরূপে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দে অবসর গ্রহণ করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখনীয় এই যে, বাংলার বিদ্রোহী কবি নজরুল ওই স্কুলে তাঁর ছাত্র ছিলেন।

 

কোলকাতার কালীঘাট অঞ্চলের ৪৩ নং মহিম হালদার স্ট্রীট।জনপূর্ণ এলাকা। সবাই ব্যস্ত। সুনীতি দেবী এসেছেন বাপের বাড়ি। তিনি সন্তানসম্ভবা।দ্বিতীয় সন্তান হবে। তখনকার দিনে বাড়িতে ধাত্রীমাতা আসতেন বাড়িতে। তিনি এসে বললেন, আর দেরী নেই। রাতের মধ্যেই বাচ্চা প্রসব হবে। তখন ফোন এত ছিল না। অফিসে আদালতে ফোন থাকত।এদিকে সুনীতির স্বামী চিন্তায় মগ্ন। ফরিদপুরে উনশিয়া গ্রামে থাকেন। কোলকাতা থেকে অনেকদূর।বড়ছেলেকে নিয়ে খুব চিন্তায় আছেন। তারপর মাসখানেক পরে খবর পেলেন আবার পুত্রসন্তান প্রসব করেছেন তার স্ত্রী।নিবারণ ভট্টাচার্য গ্রামের সকলকে মিষ্টিমুখ করালেন। তার রানীদি ভাইয়ের নাম দিলেন সুকান্ত। তখন ১৯২৬ সাল। পরাধীন ভারতবর্ষে ব্রিটিশ রাজ চলছে।অত্যাচার আর অবিচারে বিপ্লবীদের ফাঁসি দিচ্ছে সরকার একের পর এক।সুনীতি দেবির মোট সন্তান ছিল ছয়জন। তিনি স্বামীকে বললেন, আর নয়। এবার ছেলেদের মানুষের মত মানুষ করতে হবে।তারপর ফরিদপুরে স্কুলে ভরতি হলেন সুকান্ত।তাঁর ছয় ভাইয়ের মধ্যে ছিলেন দ্বিতীয় | তাঁর ভাইদের নাম যথাক্রমে- মনমোহন, সুশীল, প্রশান্ত, বিভাষ, অশোক এবং অমীয় ছিলো | তিনি তাঁর বড় দাদা মনমোহন এবং বৌদি সরজু দেবীর বড় আদরের ছিলেন | তাঁর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একজন মানুষ ছিলেন রানীদি | সেইসময়ের বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক মনিন্দ্রলাল বসুর “সুকান্ত” গল্পটি পড়ে, তিনি তাঁর নাম রেখেছিলেন সুকান্ত |জানা যায়, তাঁর প্রিয় রানীদির জন্যই নাকি তিনি সাহিত্যকর্মের প্রতি আকৃষ্ট হন | রানীদি বললেন, তোর খাতায় লেখা কবিতা আমি দেখেছি। তুই কবিতা লেখ। একদিন তুই অনেক বড় হবি। তোর নাম ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়বে।সুকান্ত বললেন, তুমি কি করে জানলে আমি বড় কবি হব। ও কথা বোলো না। আমার লজ্জা লাগে দিদি।রানীদি বললেন, আমার কথা ফেলিস না ভাই।সুকান্ত বলেছিল, চেষ্টা করব তোমার কথা মেনে চলার। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তাঁর রানীদি তাঁর কোনো সাহিত্যকর্মই দেখে যেতে পারেননি, এর প্রধান কারণ তিনি খুব তাড়াতাড়ি মারা যান | তারপর দিদির মারা যাওয়ার কিছুদিন পরেই আবার তাঁর মা সুনীতি দেবীও পরলোক গমন করেন |পরপর চোখের সামনে দুটো মৃত্যু, সুকান্তকে ভীষন শোকাহত এবং মর্মাহত করে তোলে, যারফলে তাঁর মানসিক অবস্থা পুরোপুরি বিদ্ধস্ত হয়ে যায় বেশ কিছুদিন | এই চরম শোকের মূহুর্তেই তিনি রচনা করে অনেক কবিতা | নিঃসঙ্গতার সময় সেইসব কবিতাই ছিলো তাঁর একমাত্র সঙ্গী |কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের বাল্যশিক্ষা শুরু হয় কোলকাতার কমলা বিদ্যামন্দির থেকে | এখানেই তাঁর লেখা প্রথম ছোটগল্প প্রকাশিত হয় স্কুলেরই নিজেস্ব পত্রিকা “সঞ্চয়ে” | সেই স্কুলে তিনি বেশ কিছুবছর পড়াশোনা করেন, এবং তারপর তিনি ভর্তি হন বেলেঘাটা দেশবন্ধু হাইস্কুলে | এরপর ১৯৪৫ সালে তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষা দেন কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তিনি সেই পরীক্ষায় ফেল করেন |বাড়িতে তার বাবা বললেন, ফেল করেছিস তো কি হয়েছে। মনে রাখবি এটা সাফল্যের এক একটা স্তম্ভ।সুকান্ত বলল, আমার স্কুলে যেতে লজ্জা করছে।তার বাবা বললেন, স্কুলে তুমি যাও। এবার দেখ তুমি পাশ করবে। স্কুলে পড়ার সময় থেকেই কবি সুকান্ত বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকান্ডের সাথে যুক্ত ছিলেন | এই সময় ছাত্র আন্দোলন ও বামপন্থী রাজনৈতিক কাজের সাথে যুক্ত হওয়ায জন্য, তাঁর পড়াশোনার পরিসমাপ্তি ঘটে ।ফ্যাসিবাদী আগ্রাসন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও অনৈতিক ব্রিটিশ শাসন প্রভৃতির বিরুদ্ধে তিনি ও তাঁর দল ভীষনভাবে সোচ্চার হন |তিনি তাঁর সীমিত জীবনকালে যা কিছু সাহিত্যসৃষ্টি করে গেছেন তা সত্যিই এক কথায় অনবদ্য | তিনি মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, মন্বন্তর, ফ্যাসিবাদ আগ্রাসন ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রভৃতির বিরুদ্ধে সেইসময় কলম ধরেছিলেন | তাঁর সমস্ত সাহিত্য কর্ম আজও প্রত্যেক বাঙালী পাঠকদের সমানভাবে মাতিয়ে রাখে।স্কুলে পড়ার সময় থেকেই কবি সুকান্ত বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকান্ডের সাথে যুক্ত ছিলেন | এই সময় ছাত্র আন্দোলন ও বামপন্থী রাজনৈতিক কাজের সাথে যুক্ত হওয়ায জন্য, তাঁর পড়াশোনার পরিসমাপ্তি ঘটে । ফ্যাসিবাদী আগ্রাসন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও অনৈতিক ব্রিটিশ শাসন প্রভৃতির বিরুদ্ধে তিনি ও তাঁর দল ভীষনভাবে সোচ্চার হন |১৯৪৪ সালে তিনি এরপর ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হন | সেই বছরই “আকাল” নামক একটি সংকলনগ্রন্থ তিনি সম্পাদনাও করেন এবং সেখানেই শোষিত মানুষের কর্ম জীবন, ভবিষ্যৎ পৃথিবীর জন্য সংগ্রাম, সমাজের দুর্দশাজনিত বেদনা এবং শোষণ মুক্ত স্বাধীন সমাজের স্বপ্ন প্রভৃতি বিষয় নিয়ে কবিতা লিখতে থাকেন |তাঁর সেই কবিতা সংকলন মানুষকে ভীষনভাবে সাহস ও অনুপ্রেরণা যোগায় রাজনৈতিক কর্মকান্ডে লিপ্ত হওয়ার জন্য ১৯৪১ সালে সুকান্ত ভট্টাচার্য কোলকাতা রেডিও আয়জিত “গল্পদাদুর আসর” নামক এক অনুষ্ঠানে যোগদান করেন |

 

সেখানে তিনি প্রথমে রবীন্দ্রনাথের কবিতা আবৃত্তি করতেন | যখন রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু হয়, তখন সেই আসরেই তিনি নিজের লেখা কবিতা পাঠ করে তাঁকে শ্রদ্ধাও জানান | মঞ্চে এক প্রাবন্ধিক তার বক্তব্যে বলেছিলেন, তুমি যদি এটা ভেবে থাকো যে সুকান্ত ভট্টাচার্য শুধু একজন কবি ছাড়া আর কিছুই ছিলেন না, তাহলে তোমার সেই ভাবনা একেবারে ভুল | কারণ তিনি কবিতা লেখার সাথেই সাথেই বিভিন্ন গান, গল্প, নাটক এবং প্রবন্ধও রচনা করেছিলেন। মাত্র এগারো বছর বয়সে তিনি “রাখাল ছেলে” নামে একটি গীতি নাট্য রচনা করেছিলেন, যেটা পরে “হরতাল” নামক বইতে সংকলিত হয়েছিলো |তাঁর সমস্ত রচনাবলীর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো- ছাড়পত্র (১৯৪৭), গীতিগুচ্ছ (১৯৬৫), পূর্বাভাস (১৯৫০), মিঠেকড়া (১৯৫১), অভিযান (১৯৫৩), ঘুম নেই (১৯৫৪), হরতাল (১৯৬২), প্রভৃতি । পরবর্তীকালে উভয় বাংলা থেকেই “সুকান্ত সমগ্র” নামে তাঁর রচনাবলী প্রকাশিত হয়। জীবনের প্রতিটি অংশেই সুকান্ত যেন অনিয়মকেই তাঁর জীবনের অঙ্গ করে তুলেছিলেন | কবি সুকান্ত তার বন্ধুদের বলতেন, আমার যেমন পার্টির কাজ, তেমনই অন্যদিকে সাহিত্যকর্ম, অভাব ও অনটন। এইসব কিছুর ধকল আমার শীর্ণ শরীর আর মানতে পারছে না।বন্ধুরা তাকে সাহায্য করতেন অর্থ দিয়ে। তারা বলতেন, শরীরের যত্ন নে। তা নাহলে তোর বিপদ হবে। তবুও কবি লিখে যেতেন কষ্ট করে।অত্যধিক পরিশ্রমের ফলে নিজের শরীরের উপর যে অত্যাচারটুকু তিনি করেন তাতে তাঁর শরীরে প্রথমে ম্যালেরিয়া ও পরে দুরারোগ্য যক্ষারোগ এসে হানা দেয় |বন্ধুরা তাঁকে দেখতে আসতেন আর সাবধানবাণী শোনাতেন। কবি মুচকি হেসে বলতেন, দেখবি একদিন পালিয়ে যাব ফাঁকি দিয়ে। এই ম্যালেরিয়া আর যক্ষার আদরে আমি জর্জরিত।এক কবিসভায় কোনো এক কবিবন্ধু তাঁকে পাল্কি করে নিয়ে গেছিলেন। সেই সভায় বন্ধুটি কবির সম্বন্ধে দু চার কথা লিখেছিলেন। তিনি কবির সামনেই সেই লেখা পাঠ করেছিলেন। তিনি সভায় সকলকে উদ্দেশ্য করে বলেন,আট-নয় বছর বয়স থেকেই সুকান্ত লিখতে শুরু করেন। তিনি আমার বন্ধুসম। তাঁর কাছেই শোনা কথাগুলি আমি বর্ণনা করছি।কবি তো প্রস্তুত ছিলেন না। তিনি বললেন আমাকে আগে এই কথা বললে না। আমার সামনে আমারই স্তুতি নিবেদন করবে তুমি। এ যে ভীষণ লজ্জার।বন্ধু বলেছিলেন, আগে বললে উনি তো অনুমতি দিতেন না ভাই। তাই বলছি। আমাকে ক্ষমা কোরো। সমবেত সকলে হাততালি দিয়ে জয়ধ্বনি করলেন। তারপর তাঁর বন্ধু বলতে শুরু করলেন , আমি আমার বন্ধুর সাহিত্যকর্ম বিষয়ে কয়েকটি সংবাদ পরিবেশন করব। স্কুলের হাতে লেখা পত্রিকা ‘সঞ্চয়ে’ একটি ছোট্ট হাসির গল্প লিখে আত্মপ্রকাশ করেন। তার দিনকতক পরে বিজন গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘শিখা’ কাগজে প্রথম ছাপার মুখ দেখে তার লেখা বিবেকান্দের জীবনী। মাত্র এগার বছর বয়সে ‘রাখাল ছেলে’ নামে একটি গীতি নাট্য রচনা করেন। এটি পরে তার ‘হরতাল’ বইতে সংকলিত হয়। বলে রাখা ভালো, পাঠশালাতে পড়বার কালেই ‘ধ্রুব’ নাটিকার নাম ভূমিকাতে অভিনয় করেছিলেন সুকান্ত। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় বাল্য বন্ধু লেখক অরুণাচল বসুর সঙ্গে মিলে আরেকটি হাতে লেখা কাগজ ‘সপ্তমিকা’ সম্পাদনা করেন। অরুণাচল তার আমৃত্যু বন্ধু ছিলেন। মার্কসবাদী চেতনায় আস্থাশীল কবি হিসেবে সুকান্ত কবিতা লিখে বাংলা সাহিত্যে স্বতন্ত্র স্থান করে নেন। সুকান্তকে বলা হয় গণমানুষের কবি। অসহায়-নিপীড়িত সর্বহারা মানুষের সুখ, দুঃখ তার কবিতার প্রধান বিষয়। অবহেলিত মানুষের অধিকার আদায়ের স্বার্থে ধনী মহাজন অত্যাচারী প্রভুদের বিরুদ্ধে নজরুলের মতো সুকান্তও ছিলেন সক্রিয়। যাবতীয় শোষণ-বঞ্চনার বিপক্ষে সুকান্তের ছিল দৃঢ় অবস্থান। তিনি তার কবিতার নিপুণ কর্মে দূর করতে চেয়েছেন শ্রেণী বৈষম্য। মানবতার জয়ের জন্য তিনি লড়াকু ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। অসুস্থতা অর্থাভাব তাকে কখনো দমিয়ে দেয়নি। মানুষের কল্যাণের জন্য সুকান্ত নিরন্তর নিবেদিত থেকেছেন। তিনি মানবিক চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে বিদ্রোহের ডাক দিয়েছেন। তার অগ্নিদীপ্ত সৃষ্টি প্রণোদনা দিয়ে সব ধরনের প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করতে প্রয়াসী ছিলেন। মানবিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য বাংলা কাব্যধারার প্রচলিত প্রেক্ষাপটকে আমূল বদলে দিতে পেরেছিলেন। সুকান্ত কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকা দৈনিক স্বাধীনতার (১৯৪৫) ‘কিশোর সভা’ বিভাগ সম্পাদনা করতেন। মার্কসবাদী চেতনায় আস্থাশীল কবি হিসেবে সুকান্ত কবিতা লিখে বাংলা সাহিত্যে স্বতন্ত্র স্থান করে নেন।তার কবিতায় অনাচার ও বৈষ্যমের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদ পাঠকদের সংকচিত করে তোলে। গণমানুষের প্রতি গভীর মমতায় প্রকাশ ঘটেছে তার কবিতায়। তার রচনাবলির মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো: পূর্বাভাস (১৯৫০), মিঠেকড়া (১৯৫১), অভিযান (১৯৫৩), ঘুম নেই (১৯৫৪), হরতাল (১৯৬২), গীতিগুচ্ছ (১৯৬৫) প্রভৃতি। পরবর্তীকালে উভয় বাংলা থেকে সুকান্ত সমগ্র নামে তার রচনাবলি প্রকাশিত হয়। সুকান্ত ফ্যাসিবাদবিরোধী লেখক ও শিল্পিসঙ্ঘের পক্ষে আকাল (১৯৪৪) নামে একটি কাব্যগ্রন্থ সম্পাদনা করেন।সুকান্তের কবিতা বিষয়বৈচিত্র্যে ও লৈখিক দক্ষতায় অনন্য। সাধারণ বস্তুকেও সুকান্ত কবিতার বিষয় করেছেন। বাড়ির রেলিং ভাঙা সিঁড়ি উঠে এসেছে তার কবিতায়। সুকান্তের কবিতা সব ধরনের বাধা-বিপত্তিকে জয় করতে শেখায়। যাপিত জীবনের দুঃখ-যন্ত্রণাকে মোকাবেলা করার সাহস সুকান্তের কবিতা থেকে পাওয়া যায়। তারুণ্যের শক্তি দিয়ে উন্নত শিরে মানুষের মর্যাদার জন্য মানুষকে প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান সুকান্তের কবিতায় লক্ষণীয়। সুকান্তের কবিতা সাহসী করে, উদ্দীপ্ত করে। তার বক্তব্যপ্রধান সাম্যবাদী রচনা মানুষকে জীবনের সন্ধান বলে দেয়। স্বল্প সময়ের জীবনে তিনি বাংলা সাহিত্যকে অনেক কিছু দিয়ে গেছেন। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, দিজেন্দ্রলাল রায়, জীবনানন্দ দাশসহ সে সময়ের বড় বড় কবির ভিড়ে তিনি হারিয়ে যাননি। নিজের যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখে গেছেন নিজ প্রতিভা, মেধা ও মননে। সুকান্ত তার বয়সিক সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করেছেন তার পরিণত ভাবনায়। ভাবনাগত দিকে সুকান্ত তার বয়স থেকে অনেক বেশি এগিয়ে ছিলেন। এখন তিনি ম্যালেরিয়া ও যক্ষা রোগে আক্রান্ত।আপনাদের সাহায্য চাই।সকলের সমবেত প্ররচেষ্টায় প্রিয় কবিকে রেড এড কিওর হোমে ভরতি করা হয়। কিন্তু তখন অনেক দেরী হয়ে গেছে। যারফলে ১৯৪৭ সালের ১৩ই মে তারিখে কোলকাতার ১১৯ নম্বর লাউডট ট্রিষ্ট্রের অন্তর্গত “রেড এড কিওর হোমে” তিনি অবশেষে মৃত্যুবরণ করেন | মৃত্যুর সময় তার বয়স ছিল মাত্র একুশ। স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেও তিনি স্বাধীন দেশের আনন্দ আস্বাদন করার সুযোগ পাননি। আদি শঙ্কর বাংলার রাজ্যের এক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি সারা ভারত পর্যটন করে অন্যান্য দার্শনিকদের সঙ্গে আলোচনা ও বিতর্কে অংশগ্রহণের মাধ্যমে নিজের দার্শনিক মতটি প্রচার করেন। তিনি চারটি মঠ প্রতিষ্ঠা করেন। এই মঠগুলি অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনের ঐতিহাসিক বিকাশ, পুনর্জাগরণ ও প্রসারের জন্য বহুলাংশে দায়ী। শঙ্কর নিজে অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনের প্রধান প্রবক্তা হিসেবে খ্যাত। এছাড়া তিনি হিন্দু সন্ন্যাসীদের ও হিন্দুদের পূজার নামক পদ্ধতির প্রবর্তক।সংস্কৃতে লেখা আদি শঙ্করের রচনাবলির প্রধান লক্ষ্য ছিল তত্ত্বের প্রতিষ্ঠা। সেযুগে হিন্দু দর্শনের শাখাটি অতিরিক্ত আনুষ্ঠানিকতার উপর জোর দিত এবং সন্ন্যাসের আদর্শকে উপহাস করত। আদি শঙ্কর পুরোনো তত্ত্ব অবলম্বনে সন্ন্যাসের গুরুত্ব তুলে ধরেন। তিনি উপনিষদ্‌, ব্রহ্মসূত্র ও ভাষ্যও রচনা করেন। এই সব বইতে তিনি তার প্রধান প্রতিপক্ষ মীমাংসা শাখার পাশাপাশি হিন্দু দর্শনের শাখা ও বৌদ্ধ দর্শনের মতও খণ্ডন করেন। তিনি একটি গ্রন্থ রচনা করেন তালপাতায়। পরে পুস্তকরূেপে আত্মপ্রকাশ করে।এরপর আর এক সাধু, বারানসীর পঞ্চগঙ্গার প্রাচীনঘাটের নিকটে মহাকায় উলঙ্গ সাধু পদ্মাসনে চোখ বন্ধ করে বসে আছেন। তার সামনে হাজার নর-নারী সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে। একজন একজন করে সাধুর পায়ে মাথা ঠেকিয়ে স্থান ত্যাগ করছে। তারা বিভিন্ন বর চাইছে।এরা সবাই সন্ধ্যাকালীন স্নান শেষে সাধুকে প্রণাম করে হৃষ্ট মনে আপন নিবাসে ফেরত যাচ্ছে। কিন্তু নির্বিকার ধ্যানগম্ভীর সাধুর এতে কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই।বারানসির আপামর জনতার কাছে উলঙ্গ, মৌন সাধক তৈলঙ্গস্বামী নামে পরিচিত। ভক্তরা তাকে ভালবেসে বাবা মহাদেব বলেও সম্ভাষণ করেন।শ্রীতৈলঙ্গনাথ স্বামীজির জন্মসাল নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। তবে সপ্তদশ শতকের প্রথম দিকেই তার জন্ম বলে বেশিরভাগ ইতিহাসবিদের দাবি। প্রচলিত আছে, অন্ধ্রদেশের ভিজিয়ানা গ্রামের হোলিয়া নামক অঞ্চলে তার জন্ম। তার জন্মদাতার নাম নরসিংহ রাও এবং মাতার নাম বিদ্যাবতী রাও। নরসিংহ রাও এ অঞ্চলে ধনবান ব্যক্তি ছিলেন। ধার্মিকতা আর সততার জন্য জনপ্রিয় ছিলেন হোলিয়া জনগণের কাছে। তার স্ত্রী বিদ্যাবতীরও ভক্তিমতী, সাধিকা হিসেবে সুনাম ছিল যথেষ্ট। নরসিংহ রাও তার স্ত্রী বিদ্যাবতীর সাথে অনেকদিন যাবত ঘর করার পরেও সন্তানসুখ লাভ করছিলেন না। বংশরক্ষার তাগিদে নরসিংহ রাও পুনরায় বিয়ে করতে বাধ্য হন। কিন্তু কয়েকমাসের মধ্যে বিদ্যাবতী সবাইকে অবাক করে অন্তঃসত্ত্বা হন। প্রচলিত আছে, তিনি রাতদিন নিজ গৃহে প্রতিষ্ঠিত শিবলিঙ্গের পূজাতেই মগ্ন থাকতেন এবং অসুস্থ অসহায় মানুষের সেবাতে নিজেকে নিয়োজিত করেন। তার ভক্তি আর সেবার গুণে মুগ্ধ হয়ে দেবাধিদেব তার ওপর কৃপাধারা বর্ষিত করেন। মহাযোগী শ্রীশ্রী তৈলঙ্গস্বামী ২৬শে ডিসেম্বর আসেন নশ্বর জগতেে। একশত পঞ্চাশ বছরের বারাণসী নিবাসী একদিন গঙ্গা থেকে জল বিহার করে সুস্থ দেহে ফিরে আসেন ৮০ বৎসরের আবাসস্থল মঙ্গল দাস ঠাকুরের বাড়ীতে। তখন মঙ্গল দাস ঠাকুর ও অন্যান্য আরো কয়েকজন ভক্ত উপস্থিত ছিল। তিনি ভক্তদেরকে ডেকে বলেন এবার তোরা আমায় বিদায় দে। আমি ঠিক করেছি সমাধিযোগে আজই দেহত্যাগ করবো। ভক্তরা কথাটি শুনে কান্নায় ভেঙ্গে পরেন। শেষ পর্যন্ত ভক্তদের বিশেষ অনুরোধে আশ্রমে মূর্তি নির্মাণ সহ ভক্তদের অন্যান্য ইচ্ছা পূরণের জন্য তিনি দেহরক্ষার দিন এক মাস পিছিয়ে মহা-সমাধির দিন ধার্য করে দেন। সেই অনুসারে তিনি ২৬শে ডিসেম্বর ১৮৮৭ সালে সোমবার পৌষ মাসের শুক্লা একাদশীর বিকেলে মহা-যোগে বারাণসীর পঞ্চগঙ্গা ঘাটের নিকটে মঙ্গল দাসের বাড়ীতে দেহরক্ষা করেন। তাঁর ইচ্ছে তাঁর দেহটি যেন একটি কাঠের বাক্সে ঢুকিয়ে তালাবদ্ধ করে রাখা হয়। অসি ঘাট থেকে যাত্রা করে বরণা পর্যন্ত পরিক্রম শেষে পঞ্চগঙ্গা ঘাটের অদূরে গঙ্গায় বিসর্জন দেওয়া হয়। সেই অনুসারে ভক্তগণ একটি চন্দনকাঠের বাক্স তৈরী করেন। বাক্সের মধ্যে বিছানা পাতা হয়। মহাযোগীর মহাপ্রয়ানের পর দেহটি সেই বাক্সে ঢুকিয়ে সেটি তালাবদ্ধ করা হয়। ঘাট থেকে বরণা ঘাট পর্যন্ত পরিক্রমা শেষে বাক্সটি পঞ্চগঙ্গা ঘাটের অদূরে গঙ্গায় বিসর্জন দেওয়া হয়। বিসর্জনের পর বাক্সটি না ডুবে ভাসতে থাকে। বাক্সটি মাঝ গঙ্গায় গেলে এর ভিতর থেকে এক জ্যোতির্ময় রশ্মি বাহির হয়ে আসে। ভাসতে ভাসতে বাক্সটি উজানের দিকে চলে যায়। লক্ষ লক্ষ মানুষ ঐদিন গঙ্গার পাড়ে উপস্থিত থেকে তাঁর সমাধির দৃশ্য অবলোকন করেন। তাঁর দেহটি একটি চন্দন কাঠের বাক্সে ঢুকিয়ে তালাবদ্ধ করে একটি নৌকায় তোলা হয়। অসি ঘাট থেকে যাত্রা করে বরনা ঘাট পর্যন্ত পরিক্রম শেষে পঞ্চগঙ্গা ঘাটের অদূরে গঙ্গায় বিসর্জন দেওয়া হয়।এবার গুরুকে বাদ দিয়ে তাঁরা দু’জনে পদযাত্রায় আবার দেশভ্রমণ শুরু করেন। প্রথমে আফগানিস্তান, পারস্য, আরব, মক্কা-মদীনা, মক্কেশ্বর তীর্থস্থান, তুরস্ক, ইতালি, গ্রিস, সুইজারল্যান্ড, ফ্রান্স, ইউরোপ-সহ বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করে দেশে ফিরে আসেন এবং পরে দেশের ভিতর হরিদ্বার, হিমালয় তীর্থ, বদ্রীনাথ, সুমেরু পর্বত, কাশিধাম ও কাবুল পরিদর্শন করেন। দিনে দিনে গুরুর বয়স একশ বছর ও শিষ্যদের বয়স পঞ্চাশ বছর হলো। গুরুদেব ভগবান গাঙ্গুলী শিষ্য দু’জনকে শ্রী তৈলঙ্গস্বামীর (হিতলাল নামে যিনি পরিচিত) হাতে তুলে দিয়ে পরলোক গমন করেন।একবার নারায়ণগঞ্জের বারদীর জমিদার নাগ মহাশয় লোকনাথের কথা শুনে তাঁর জন্য জমি দান করেন এবং সেখানে মহা ধুম-ধামের সঙ্গে আশ্রম স্থাপন করা হয়। লোকনাথ ব্রহ্মচারীর আশ্রমের কথা শুনে দেশ-দেশান্তর হতে বহু ভক্ত এসে ভিড় জমাতে থাকেন। অল্প সময়ের ব্যবধানেই বাবার আশ্রম তীর্থভূমিতে পরিণত হয়। কোনো এক সময় ভাওয়ালের মহারাজ তাঁর ফটো তুলে রাখেন। যে ফটো বর্তমানে ঘরে ঘরে পূজিত হয়। সেদিন ছিল ১৯শে জৈষ্ঠ, রবিবার। বাবা নিজেই বললেন তার প্রয়াণের কথা। বহু মানুষ আসেন তাঁকে শেষ দর্শন করার জন্য। কথিত আছে একসময় লোকনাথ মহাযোগে বসেন। সবাই নির্বাক হয়ে অশ্রুসজল চোখে এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকেন কখন বাবার মহাযোগ ভাঙ্গবে। কিন্তু ঐ মহাযোগ আর ভাঙেনি। শেষ পর্যন্ত ১১.৪৫ মিনিটে দেহ স্পর্শ করা হলে দেহ মাটিতে পড়ে যায়। ত্রিকালদর্শী বাবা লোকনাথ বলেছেন, ‘প্রতিদিন রাতে শোবার সময় সারাদিনের কাজের হিসাব-নিকাশ করবি অর্থাত্ ভাল কাজ কী কী করেছিস আর খারাপ কাজ কী কী করেছিস? যে সকল কাজ খারাপ বলে বিবেচনা করলি সে সকল কাজ আর যাতে না করতে হয় সেদিকে খেয়াল রাখবি।’ আবার তিনি বলেছেন, ‘সূর্য উঠলে যেমন আঁধার পালিয়ে যায়। গৃহস্থের ঘুম ভেঙে গেলে যেমন চোর পালিয়ে যায়, ঠিক তেমনি বার-বার বিচার করলে খারাপ কাজ করবার প্রবৃত্তি পালিয়ে যাবে।’ ক্রমে তিনি তারাপীঠের প্রধান ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠেন। ভক্তরা বিশ্বাস করত তার অলৌকিক ক্ষমতা আছে। তাই তারা রোগারোগ্য ও অন্যান্য প্রয়োজনে তার কাছে আসত। তাঁর ভক্তরা তাঁঁর জীবনীগ্রন্থ রচনা করেন।শোনা যায় বাবার শরীর পরিবর্তন করতে পারতেন তিনি একবার বাঘরূপে প্রকাশিত হয়েছিলেন। একবার কুকুর রূপে প্রকাশিত হয়েছিলেন।

বামাক্ষ্যাপা মন্দিরের নিয়মকানুন মানতেন না। এমনকি দেবতার থালা থেকেই নৈবেদ্য তুলে খেয়ে নিতেন। কথিত আছে, মহারানীকে স্বপ্নে দেবী তারার প্রত্যাদেশ পান যে, দেবীপুত্র বলে বামাক্ষ্যাপাকে যেন আগে খাওয়ানো হয়। এরপর থেকে মন্দিরে পূজার আগেই বামাক্ষ্যাপাকে নৈবেদ্য প্রদান এবং তাকে অবাধে মন্দিরে বিচরণ করতে দেওয়া হত।আরও কথিত আছে, দেবী তারা ভয়ংকর বেশে বামাক্ষ্যাপাকে দর্শন দিয়েছিলেন এবং পরে মাতৃবেশে কোলে তুলে নিয়েছিলেন। তারাপীঠ শ্মশানে ও দুমকা জেলার মালুটি গ্রামের তার স্মৃতিমন্দির আছে। রামকৃষ্ণ পরমহংস গ্রামীণ পশ্চিমবঙ্গের এক দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পৌরোহিত্য গ্রহণের পর বঙ্গীয় তথা ভারতীয় শক্তিবাদের প্রভাবে তিনি আরাধনা শুরু করেন।তার প্রথম গুরু তন্ত্র ও বৈষ্ণবীয় ভক্তিতত্ত্বজ্ঞা এক সাধিকা। পরবর্তীকালে মতে সাধনা করে লাভ করেন রামকৃষ্ণ। অন্যান্য ধর্মীয় মতে, বিশেষত ও মতে সাধনা তাকে “যত মত, তত পথ” উপলব্ধির জগতে উন্নীত করে।পশ্চিমবঙ্গের আঞ্চলিক গ্রামীণ উপভাষায় ছোটো ছোটো গল্পের মাধ্যমে প্রদত্ত তার ধর্মীয় শিক্ষা সাধারণ জনমানসে বিরাট প্রভাব বিস্তার করে। প্রথাগত দৃষ্টিভঙ্গিতে অশিক্ষিত হলেও রামকৃষ্ণ বাঙালি বিদ্বজ্জন সমাজ ও শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের সম্ভ্রম অর্জনে সক্ষম হয়েছিলেন। ১৮৭০-এর দশকের মধ্যভাগ থেকে পাশ্চাত্যশিক্ষায় শিক্ষিত বুদ্ধিজীবীদের নিকট তিনি হয়ে ওঠেন হিন্দু পুনর্জাগরণের কেন্দ্রীয় চরিত্র। তৎসঙ্গে সংগঠিত করেন একদল অনুগামী। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভূ ১৪৮৬ খৃষ্টাব্দে ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমায় নবদ্বীপে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম জগন্নাথ মিশ্র এবং মাতার নাম শচীদেবী। জগন্নাথ মিশ্র পূর্বে শ্রীহট্টে বাস করতেন। পরে তিনি গঙ্গাবাসের উদ্দেশ্যে নবদ্বীপে বাস করা শুরম্ন করেন। অল্প বয়সেই চৈতন্যদেব পিতাকে হারান। তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা বিশ্বরূপ পিতার মৃত্যুর পূর্বেই সন্ন্যাস গ্রহণ করে গৃহত্যাগ করেন। শ্রীচৈতন্যবাল্যে নিমাই নামে পরিচিত ছিলেন।নিমাই গঙ্গাদাস পণ্ডিতের পাঠশালায় কৃষ্ণানন্দ, কমলাকান্ত, মুরারী গুপ্ত প্রভৃতি সহপাঠীদের সাথে শিক্ষা অর্জন করেন। তিনি নবদ্বীপের বিশিষ্ট ব্রাহ্মণ বল্লভাচার্যের মেয়ে লক্ষ্মীদেবীকে বিয়ে করেন। তিনি বুদ্ধি ও স্মৃতিশক্তির জোড়ে ক্রমান্বয়ে নবদ্বীপের শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত হয়ে ওঠেন এবং নবদ্বীপে অধ্যাপনা শুরু করেন। নিমাই পিতা জগন্নাথ মিশ্রের পিতৃভূমি পূর্ববঙ্গের শ্রীহট্ট ভ্রমণকালে তাঁর স্ত্রী সর্পদংশনে মৃত্যুবরণ করেন। তারপর তাঁকে রাজপণ্ডিত সনাতনের মেয়ে বিষ্ণুপ্রিয়ার সাথে বিবাহ দেয়া হয়। গয়ায় পিতৃদেবের পিণ্ড দিতে গিয়ে মাধবেন্দ্রপুরির শিষ্য ঈশ্বরপুরির নিকট দীক্ষাগ্রহণ করে ফিরে আসেন। দীক্ষাগ্রহণের পর থেকে নিমাইয়ের অনেক পরবর্তন লক্ষ্য করা গেল। ধীরে ধীরে নিমাই টোলের অধ্যাপক থেকে কৃষ্ণপ্রেমীক হতে শুরু করলেন। ২৪ বছর বয়সে নিমাই মাতা ও স্ত্রীকে ত্যাগ করে কাঠোয়াতে এসে সন্ন্যাসী কেশব ভারতীর নিকট সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। তখন তার নাম হয় শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য। সন্নাস নেয়ার পর চৈতন্যদেব একবার নবদ্বীপের কাছে শান্তিপুরে অদ্বৈতের বাড়িতে এসেছিলেন। সেখানে তিনি মাতা শচীদেবীর সাথে সাক্ষাৎ করেন। কিন্তু সন্ন্যাসীদের স্ত্রী-সাক্ষৎ নিষিদ্ধ বলে বিষ্ণুপ্রিয়া চৈতন্যদেবকে দর্শন করতে পারেন নি। শান্তিপুর থেকে চৈতন্যদেব পুরীতে গমন করেন। পরেও আরেক বার তিনি নবদ্বীপে এসে মায়ের সাথে দেখা করেছিলেন এবং তখন বিষ্ণুপ্রিয়াকে পাদুকা দান করেছিলেন। কাটোয়ায় মস্তক মুন্ডন করেন। এরপর তিনি বৃন্দাবন, প্রয়াগ, কাশী প্রভৃতি তীর্থ ভ্রমণ করেন। নিত্যানন্দ, অদ্বৈত, গদাধর, শ্রীনিবাস, রামানন্দ, হরিদাস, পভৃতি বৈষ্ণবগণ ছিল তাঁর প্রিয় অদ্বৈত ও নিত্যানন্দকে চৈতন্যের দুই অঙ্গ স্বরূপ কল্পনা করা হয়। নিত্যানন্দ চৈতন্যের খুবই প্রিয়ভাজন ছিলেন। নিত্যানন্দ একবার জগাই ও মাধাই নামক নদীয়ার দুই পাপিষ্ঠ ব্রাহ্মণকুমারকে উদ্ধার করতে চাইলেন। সে লক্ষ্যে তিনি অনেক ভক্তদের সাথে নিয়ে নাম-কীর্তন করতে করতে জগাই-মাধাইয়ের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। জগাই-মাধাই মদ পান করে ঘুমাচ্ছিলেন। নাম-কীর্তন শুনে তাদের ঘুম ভাঙায় তারা খুব বিরক্ত হলেন। নিত্যানন্দ বারংবার তাদের হরিনাম করার অনুরোধ করলেন। মাধাই তখন ক্রোধান্বিত হয়ে নিকটস্থ একটি ভাঙ্গা কলসির টুকরা দ্বারা নিত্যানন্দকে আঘাত করল। ফলে নিত্যানন্দের কপাল কেটে রক্ত ঝরতে লাগল। চৈতন্যদেব খবর পেয়ে ঐ স্থানে ছুটে আসলেন। তিনি জগাই-মাধাই শাস্তি দেয়ার জন্য সুদর্শন চক্রকে স্মরণ করলেন। কিন্তু নিত্যানন্দ তাঁকে নিরস্ত করলেন। শত্রু কর্তৃক আঘাত পেয়েও শত্রুকে ক্ষমা করার মত উদারতা আর কি হতে পারে? নিত্যানন্দের উদারতা ও মহত্ব দেখে জগাই-মাধাইয়ের বোধোদয় হয়। অবশেষে গৌর-নিতাইয়ের পরশে জগাই-মাধাই শুদ্ধ বৈষ্ণবভক্তে পরিণত হয়। বৈষ্ণবদের মতে শ্রীচৈতন্য রাধা ও কৃষ্ণের মিলিত রূপ, নিত্যানন্দ বলরাম, অদ্বৈত সদাশিব, শচীদেবী যশোদা এবং জগন্নাথ মিশ্র নন্দ। চৈতন্যদেবের অনুসারী ছয় জন গোস্বামী ছিলেন যারা অনেক বৈষ্ণবশাস্ত্র রচনা করে গিয়েছেন। সে ছয় জন গোস্বামী হলেন রূপ, সনাতন, জীব, রঘুনাথ ভট্ট, রাঘনাথ দাস এবং গোপাল ভট্ট। এছাড়াও চৈতন্যদেবের অনুসারী আটজন কবিরাজ ও চৌষট্টিজন মহন্ত ছিলেন। সন্ন্যাস নেবার পর চৈতন্যদেব ছয় বছর মথুরায় অবস্থান করেন। তিনি পুরুষোত্তম ক্ষেত্র সহ নানা স্থান পর্যটন করে বৈষ্ণব মত প্রচার করেন এবং শিষ্য সংগ্রহ করেন। তারপর তিনি রূপ ও সনাতনকে মথুরায় এবং অদ্বৈত ও নিত্যানন্দকে বাংলায় প্রচারকার্যে নিযুক্ত করে নীলাচলে গমন করেন। নীলাচলে মহাপ্রভূ জীবনের শেষ ১৮ বছর জগন্নাথের সেবায় রত ছিলেন। শেষদিকে তিনি ভাবে উন্মত্ত হয়ে থাকতেন। কথিত আছে যে, তিনি সমুদ্রকে যমুনা ভেবে এবং শ্রীকৃষ্ণ সে যমুনার জলে গোপীকাদের সাথে ক্রিড়া করছেন এমন উপলব্ধি করে ঐ সমুদ্রের জলে সেখানে ঝাপ দিয়েছিলেন। এটাই প্রেমভক্তির চূড়ান্ত স্তর। ভাবের এ চূড়ামত্ম সত্মরে উপনীত হলে সর্বত্রই প্রেমাস্পদের দর্শন মেলে। মহাপ্রভূ ১৫৩৪ খৃষ্টাদে ইহলীলা সংবরণ করেন। মহাপ্রভূ শিষ্যদের উপদেশ দিয়েছেন , তৃণ হতেও নীচ (নম্র) হবে, তরু হতেও সহিষ্ণু হবে, অহংকারশূন্য হয়ে সকলকে সম্মান করবে এবং সব সময় হরিনাম করবে। চৈতন্যদেব ভক্তদের শিক্ষার জন্য আটটি শ্লোক রচনা করে গিয়েছিলেন যা শিক্ষাষ্টক নামে পরিচিত।সাধক তুলসীদাস ছিলেন একজন রামভক্ত। তিনি গৃহস্থ-আশ্রমে থাকাকালে স্ত্রীকে খুব ভালবাসতেন। একদিন তিনি গৃহের বাইরে থাকাকালে তাঁর স্ত্রী পিতৃ-গৃহে গমন করেন। তিনি গৃহে ফিরে স্ত্রীকে দেখতে না পেয়ে প্রণয়বশত শ্বশুর বাড়ি গিয়ে স্ত্রীর নিকট উপস্থিত হন। স্ত্রী তাঁর এ নির্লজ্জ স্বভাবের জন্য তাঁকে তিরষ্কার করেন। স্ত্রীর ভৎর্সনা শুনে তাঁর মনে তীব্র বৈরাগ্য আসে এবং তিনি গৃহ ত্যাগ করে শ্রীরামচন্দ্রের উপাসনা শুরু করেন। কথিত আছে তিনি চিত্রকুটে হনুমানজীর দর্শন পান। তাঁর হিন্দী ভাষায় অনুদিত রামায়ণের নাম রামচরিতমানস। এ রামচরিতমানস গ্রন্থই তাঁর অমর কীর্তি।
রামকৃষ্ণের প্রয়াণের পর সন্ন্যাস গ্রহণ করে তার কাজ চালিয়ে যান। এঁদেরই নেতা ছিলেন বিবেকানন্দজী। ১৮৯৩ সালে বিবেকানন্দ তার ধর্মীয় চিন্তাধারাকে পাশ্চাত্যের জনসমক্ষে উপনীত করেন। বিবেকানন্দ যে বিশ্বমানবতাবাদের বার্তা প্রেরণ করে তা সর্বত্র সমাদৃত হয় এবং তিনিও সকল সমাজের সমর্থন অর্জন করেন। হিন্দু দর্শনের সার্বজনীন সত্য প্রচারের উদ্দেশ্যে তিনি এরপর মঠ প্রতিষ্ঠা করেন এবং ভারতে রামকৃষ্ণের ধর্মীয় সমন্বয়বাদ ও “শিবজ্ঞানে জীবসেবা”র আদর্শ বাস্তবায়িত করার জন্য স্থাপনা করেন নামে একটি ধর্মীয় সংস্থা। রামকৃষ্ণ আন্দোলন ভারতের অন্যতম নবজাগরণ আন্দোলনরূপে বিবেচিত হয়।২০০৮ সালে ভারত ও বহির্ভারতে রামকৃষ্ণ মিশনের মোট ১৬৬টি শাখাকেন্দ্র বিদ্যমান। এই সংস্থার প্রধান কার্যালয় পশ্চিমবঙ্গের অবস্থিত।স্বামী বিবেকানন্দ এক উচ্চবিত্ত হিন্দু পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ছোটোবেলা থেকেই আধ্যাত্মিকতার প্রতি তিনি আকর্ষিত হতেন। তার গুরু রামকৃষ্ণ দেবের কাছ থেকে তিনি শেখেন, সকল জীবই ঈশ্বরের প্রতিভূ; তাই মানুষের সেবা করলেই ঈশ্বরের সেবা করা হয়। রামকৃষ্ণের মৃত্যুর পর বিবেকানন্দ ভারত ভালোভাবে ঘুরে আর্থ-সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে প্রত্যক্ষ জ্ঞান অর্জন করেন। পরে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে ১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দের বিশ্ব ধর্ম মহাসভায় ভারত ও হিন্দুধর্মের প্রতিনিধিত্ব করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ও তিনি বিভিন্ন দিক সম্পর্কে অসংখ্য সাধারণ ও ঘরোয়া বক্তৃতা দিয়েছিলেন এবং ক্লাস নিয়েছিলেন। তার রচিত গ্রন্থগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য চিকাগো বক্তৃতা, ইত্যাদি। বিবেকানন্দ ছিলেন সংগীতজ্ঞ ও গায়ক। তার রচিত কয়েকটি বিখ্যাত কবিতা। “সখার প্রতি” কবিতার অন্তিম দুইটি চরণ– “বহুরূপে সম্মুখে তোমার ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর? / জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।” – বিবেকানন্দের সর্বাধিক উদ্ধৃত একটি উক্তি।ভারতে বিবেকানন্দকে বীর সন্ন্যাসী নামে অভিহিত করা হয় এবং তার জন্মদিনটি ভারতে যুব দিবস হিসেবে পালিত হয়।

সময়টা সপ্তদশ শতক। সেই শতকে বাংলা প্রত্যক্ষ করছে বর্গীহান

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *