Sudip Ghoshal

  1. শিক্ষকদিবসের শ্রদ্ধার্ঘ ও ভারতরত্ন ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণাণ।

    সুদীপ ঘোষাল

    তিনি যখন রাষ্ট্রপতি ছিলেন তখন তার কিছু ছাত্র এবং বন্ধু ৫ই সেপ্টেম্বর তাঁর জন্মদিন পালন করার জন্য তাঁকে অনুরোধ করেন। তিনি এর উত্তরে বলেছিলেন, “৫ই সেপ্টেম্বর আমার জন্ম দিবস পালন না করে শিক্ষক দিবস হিসাবে পালন করলে আমি আরও অধিক সম্মানিত বোধ করব।”

    সেই থেকে শুরু হয় শিক্ষক দিবস পালন করা যা এখনো সকল ভারতবাসী তাকে সম্মান জানানোর জন্য পালন করে থাকে।

    একবার শিক্ষকদিবসে শান্তিনিকেতন যাচ্ছি বাসে চড়ে। জানালার ধারে বসতে পেলেই আমি খুুুুশি। ভারি ভাল লাগে। আদিগন্ত সবুজে সবুজে আমার হৃদয় সবুজ হয়ে ওঠে মরচে পড়া জীবনে। হঠাৎ দেখলাম সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণানের মুখোশে সেজে নিয়ে পড়াশোনা করছে কিছু শিশু।

    অপরদিকে বালির গাদায় গর্ত হয়ে জল জমে আছে। শিশুরা খেলা করছে। আমি ভাবলাম, সিজন চেঞ্জের সময় এটা। বর্ষার ফালতু হাওয়ার নাচ। শুধু মন নাচায় রোগ বাধায়। শিশুদের বললাম, ছেলেরা, জল ঘেঁটো না। ঠাণ্ডা লাগবে বাবু। বাসটা থেমে আছে ট্রাফিক জ্যামে। দেখলাম ডঃ রাধাকৃষ্ণাণ এর বেশে ছেলেগুলো শিশুদুটিকে বই দিল,তাদের হাতে।জলে ভিজে  মুখ তুলে চাইল দুটি শিশু। বইটা একবার হাতমুছে নিয়ে আবার মেতে গেল বালির ঘর তৈরির নেশায়। বৃষ্টি হয়েছে খুব গতরাতে।আর বালিগাদাতে গর্ত হয়ে জল প্রায় এক হাত জমেছে।  জলের সঙ্গে সন্ধি করে সই পাতিয়ে বৃষ্টিতে এই বালি নিয়ে ছেলেরা খেলা করছে।শিক্ষকরা, আবার  বলল ঠান্ডা লেগে যাবে।জলে নেমো না।   উঠে যাও তোমরা। এখন গিয়ে পড়াশোনা করো। ছেলেগুলো তবু বালি নিয়ে জলে খেলা করলো। সিজন চেঞ্জের সময় ঠান্ডা লেগে যাবে এই ভয়ে সেজে থাকা ছেলেদুটোর একজন  বললেন,  তোমরা আমাদের কথা শুনছো না কেন?

    আবার বালক শিক্ষকরা বললেন,জল ঘেঁটো না, যাও সরে যাও। তোমাদের ঠান্ডা লেগে যাবে। বাবা মায়ের কষ্ট হবে। তবুও তারা পালিয়ে পালিয়ে আনন্দে বালির ঘর বানাতে লাগল।

    তারপর বইগুলো নিয়ে অই ভিজে যাওয়া ছেলেদের ধরে নিয়ে ছোট্ট  শিক্ষকরা পাশে গিয়ে নামতা পড়াতে শুরু করল।

    ইতিমধ্যে বাস ছেড়ে দিয়েছে।আমি দেখে  শান্তি পেলাম তারা আমার দিকে চেয়ে হাসছে আর নামতা পড়ছে।  শিশুবেলার হারিয়ে যাওয়া খোলা হাওয়ায় ওদের মাঝে নিজেকে খুঁজে পেলাম।

     

    বোলপুরে পৌঁছে বিশ্বভারতীর সামনে বিশাল প্যান্ডেলে এক অধ্যাপকের ভাষণে শুনলাম আমাদের ভারতরত্নের জীবনী।তিনি বলছেন, একাধারে রাজনীতিবিদ, দার্শনিক ও অধ্যাপক এই শান্ত মানুষটি ছাত্রজীবনে অতি মেধাবী ছিলেন। জীবনে কোনও পরীক্ষায় দ্বিতীয় হননি। বিভিন্ন বৃত্তির মাধ্যমে তাঁর ছাত্রজীবন এগিয়ে চলে। ১৯০৫ সালে তিনি মাদ্রাজ খ্রিস্টান কলেজ থেকে দর্শনে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। তার বিষয় ছিল ‘বেদান্ত দর্শনের বিমূর্ত পূর্বকল্পনা’। বিশ্বের দরবারে তিনি অতি জনপ্রিয় দার্শনিক অধ্যাপক হিসাবেও পরিচিত ছিলেন। ১৯৩১ সালে তাঁকে ব্রিটিশ নাইটহুডে সম্মানিত করা হয়। ১৯৫৪-তে ভারতরত্ন সম্মান পান। প্রথম জীবনে তিনি মহীশুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনা করেন (১৯১৮)। এ সময় তিনি বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য পত্রিকায় লিখতেন। সে সময়েই তিনি লেখেন তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘ দ্য ফিলোজফি অফ রবীন্দ্রনাথ টেগোর’। দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘দ্য রেন অফ রিলিজিয়ন ইন কনটেমপোরারি ফিলোজফি’ প্রকাশিত হয় ১৯২০সালে। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়েও অধ্যাপনা করেন। দেশ–বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি বারবার অধ্যাপনার জন্য আমন্ত্রিত হয়েছেন।

    আয়তনের বিচারে তামিলনাড়ু ভারতের একাদশ (এই রাজ্যের আয়তন গ্রিসের সমান) এবং জনসংখ্যার বিচারে সপ্তম বৃহত্তম রাজ্য।অন্যদিকে এই রাজ্য ভারতের জিডিপি-র পঞ্চম বৃহত্তম অবদানকারী এবং ভারতের সর্বাপেক্ষা অধিক পরিমাণ নগরায়িত রাজ্য।ভারতের সর্বাধিক সংখ্যক বাণিজ্যিক সংস্থা (১০.৫৬%) এই রাজ্যে অবস্থিত। যা ৬% জনসংখ্যার ভাগের তুলনায় অনেকটাই বেশি।
    প্রায় ৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ থেকে তামিলনাড়ু ভূখণ্ড তামিল জাতির আবাসস্থল। প্রায় ১৫০০-২০০০ বছর ধরে এই অঞ্চলের ধ্রুপদি ভাষা তামিল বিভিন্ন লেখ ও সাহিত্যে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। তামিলনাড়ু প্রাকৃতিক সম্পদ, দ্রাবিড় স্থাপত্যের বিশালাকার হিন্দু মন্দির, শৈলশহর, সমুদ্র সৈকত, বিভিন্ন ধর্মের তীর্থস্থানে পরিপূর্ণ। এই রাজ্যে আটটি ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান রয়েছে।
    সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণাণ স্বাধীন ভারতের প্রথম উপরাষ্ট্রপতি এবং দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি ছিলেন। তাঁর জন্মদিন ৫ সেপ্টেম্বর দিনটিকে ভারতবর্ষে ‘শিক্ষক দিবস‘ হিসেবে পালন করা হয়ে থাকে। তিনি ছিলেন একজন দার্শনিক, পন্ডিত, অধ্যাপক ও রাজনীতিবিদ। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতি ও যুব সম্প্রদায়কে গড়ে তোলাই তাঁর জীবনে প্রধান লক্ষ্য ছিল।

    ১৮৮৮ সালের ৫ সেপ্টেম্বর তামিলনাডুর তিরুট্টানিতে এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণাণের জন্ম হয়। তাঁর বাবার নাম সর্বেপল্লি  বীরস্বামী স্থানীয় এক জমিদারের অধীনে স্বল্প বেতনের একজন কর্মচারী ছিলেন। তাঁর মায়ের নাম সর্বেপল্লি সীতা। সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণাণের বাবা সংসারে অভাব ছিল নিত্য সঙ্গী।

    রাধাকৃষ্ণাণ ছোট থেকেই অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন। জীবনে কোনও পরীক্ষায় দ্বিতীয় হননি। বিভিন্ন বৃত্তি তাঁর শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে সহায়ক হয়েছিল। স্নাতক স্তরে ভৌতবিজ্ঞান নিয়ে পড়ার ইচ্ছে থাকলেও অর্থাভাবের কারণে পড়তে পারেননি। তাঁর এক তুতো দাদা তখন ওই কলেজ থেকেই দর্শন নিয়ে পাশ করেছেন। তাঁর পুরনো বইগুলি তিনি পেয়েছিলেন। এক প্রকার বাধ্য হয়েই রাধাকৃষ্ণাণ কলেজে ভর্তি হন দর্শন শাস্ত্রের ছাত্র হিসেবে। ১৯০৫ সালে তিনি মাদ্রাজ খ্রিস্টান কলেজ থেকে দর্শনে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল ‘বেদান্ত দর্শনের বিমূর্ত পূর্বকল্পনা’। তিনি মনে করেছিলেন তাঁর  গবেষণামূলক প্রবন্ধ দর্শনের অধ্যাপক বাতিল করে দেবেন। কিন্তু অধ্যাপক অ্যালফ্রেড জর্জ হগ তাঁর প্রবন্ধ পড়ে খুবই খুশি হন। তাঁর ২০ বছর বয়সে এই প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়।

    এমএ পাশ করে রাধাকৃষ্ণাণ মাদ্রাজ প্রাদেশিক শিক্ষা পরিষেবায় যোগ দিয়ে অধ্যাপনার কাজ শুরু করেন মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি কলেজে। ১৯১১ সালে সহকারি অধ্যাপক বা অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর পদে উন্নীত হন। ১৯১৬ সালে তিনি অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন অন্ধ্রপ্রদেশের রাজামুন্দ্রী কলেজে। ১৯১৮ সালের জুলাই মাসে রাধাকৃষ্ণাণ মহীশূরের মহারাজার কলেজে যোগ দেন। তিন বছর পর ১৯২১ সালে স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের আমন্ত্রণে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পঞ্চম জর্জ অধ্যাপক পদে নিযুক্ত হন। এই পদটি ভারতের সর্বোচ্চ সম্মানীয় অধ্যাপকের পদ। এরপর ১৯৩১ সালের ১ মে অন্ধ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য পদে যোগ দেন তিনি।১৯৩৯-৪৮ সাল পর্যন্ত বারাণসী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন তিনি। রাধাকৃষ্ণাণ অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্বাঞ্চলীয় ধর্ম ও নীতিবিদ্যার স্পাল্ডিং অধ্যাপক পদে নিযুক্ত ছিলেন। একজন ভারতীয় হিসেবেে তিনিই প্রথম অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পদে নিযুক্ত হয়েছিলেন। ১৯২৬, ১৯২৯ এবং ১৯৩০ সালে অক্সফোর্ডের ম্যানচেস্টার কলেজের আপটন লেকচারার ছিলেন তিনি। ১৯৩০ সালে তিনি শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক ধর্ম বিভাগে হাস্কেল লেকচারার (Haskell lecturer) পদে নিযুক্ত হন।১৯৩৯ সালে তিনি বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে নিযুক্ত হন। ১৯৪৮ সালের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত তিনি এই পদে নিযুক্ত ছিলেন। এর পর তিনি ১৯৫২-৬২ সাল পর্যন্ত এই ১০ বছর ভারতের উপ-রাষ্ট্রপতি এবং  ১৯৬২-৬৭ সাল পর্যন্ত পর্যন্ত ভারতের রাষ্ট্রপতির পদ অলঙ্কৃত করেছেন।

    তথ্য সংগৃহীত।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *