
অশ্বত্থামার অস্ত্র – ৭
সুব্রত মজুমদার
শান্তনুর কথাগুলো একমনে শুনছিলেন কর্ণেল। কফির কাপটা টেবিলের উপর নামিয়ে রেখে বললেন,”আপনি নিশ্চিন্তে এখানে থাকুন। আপনার নিরাপত্তার সব দায়িত্ব আমার। কোনও চিন্তা করবেন না। চাইলে ছদ্মবেশেও থাকতে পারেন। আপনার যা খুশি।”
শান্তনু বললেন,”অসংখ্য ধন্যবাদ কর্ণেল। এই অসহায়কে আশ্রয় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। খুব প্রয়োজন ছাড়া আমি ঘর থেকে বের হব না। আর বেরোলে রাতের অন্ধকারে ছদ্মবেশে বের হব।”
এদিকে গুরু শাকুনের আশ্রমে হৈহৈ কান্ড রৈরৈ ব্যাপার। বড় মন্ত্রী আসছেন। চারিদিকে কড়া নিরাপত্তা। পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ। সাংবাদিকেরা ক্যামেরা আর বুম নিয়ে হাজির হয়েছে আগেই।
দেখতে দেখতেই ঢুকে পড়ল কনভয়। লালবাতি দেওয়া গোটাকয়েক গাড়ির মাঝখানে মন্ত্রীর গাড়ি । প্যাঁ-পুঁ আওয়াজ করতে করতে কনভয় ঢুখে গেল আশ্রমের ভেতরে। সাংবাদিকদের দল দৌড়তে লাগল পেছন পেছন। নিরাপত্তারক্ষীদের কোনও বাধাই তারা শোনে না।
সদর দরজার সামনে কনভয় দাঁড়াতেই নেমে এলেন মন্ত্রীমশাই।
মন্ত্রীমশাই নামতেই ছেঁকে ধরল সাংবাদিকেরা। বুমগুলো সব এগিয়ে ধরল সামনে। ক্যামেরা সরাসরি তাক করা লাইভ অবস্থায়। চোখা চোখা প্রশ্নবাণ ধেয়ে আসতে লাগল মন্ত্রীমশাইয়ের দিকে।
- “স্যার স্যার, শহরে যে প্রতিদিন হিংসা লেগেই রয়েছে এ বিষয়ে আপনার মতামত কি ? এই অরাজকতার জন্য কি সরকার তার দায়িত্ব অস্বীকার করতে পারে ?”
মন্ত্রীমশাই বিরক্ত হলেন বেজায়। একবার তো বুমগুলোকে ঠেলে ফেলে দিলেন। তারপর নিজের মনে মনেই বললেন, “কুল.. কুল… মন্মথ দাস একদম কুল। এখানে রাগ দেখালে সব গুবলেট হয়ে যাবে। “
এরপর মুখে কপট হাসি এনে বললেন, “সব চক্রান্ত। আমাদের সরকারকে অস্থির করে তোলার চক্রান্ত। তবে এ বিষয়ে আমি এখন কোনও মন্তব্য করব না। এই আশ্রমের শান্ত পরিবেশে নোংরা রাজনৈতিক আলোচনা শোভনীয় নয়। আমি এসেছি গুরুদেবের কাছে শান্তির খোঁজে। প্লিজ… “
-“আর জনগণের শান্তির কি হবে ?…..” প্রশ্ন ধেয়ে এল। মন্ত্রীমশাই কোনও উত্তর না দিয়ে আশ্রমের ভেতরে ঢুকে গেলেন।
সদর দরজা বন্ধ হয়ে যেতেই একদল নিরাপত্তারক্ষী বন্দুক উঁচিয়ে দাঁড়াল। সাংবাদিকরা তখন নিজেদের মতো ব্যাখ্যা দিতে লাগল টিভির চলন্ত অনুষ্ঠানে।
আশ্রমের ভেতরে শান্তি বিরাজ করছে। একটা পাখিও গুরু শাকুনের বিনা অনুমতিতে ডাকার সাহস পায় না। যারা বাইরে থেকে এটাকে আশ্রম বলে মনে করেন তারা যদি কোনোদিন এখানে ঢোকার সুযোগ পান তবে সে ধারণা পাল্টে যাবে অচিরেই।
তবে সবাই সে সুযোগ পান না। কারণ গুরু শাকুন আম ভক্তদের দর্শন দেন আশ্রমের বাইরে কোনও জায়গায়। আশ্রমের ভেতরে ঢোকার অনুমতি কেবল আশ্রমিক আর মন্ত্রী মন্মথ দাসের মতো কিছু স্পেশাল লোকেদের জন্য।
গুরু শাকুনের বসবার ঘরটা বেশ বড়সড়। পশ্চিমের দেওয়াল ঘেঁষে একটা সিংহাসনের মতো চেয়ার, সেই চেয়ারে বসে আছেন গুরু শাকুন স্বয়ং । কাল রাতের বেলায় তাকে যারা দেখেছে তারা তার আজকের রূপের সাথে একটুও মিল খুঁজে পাবেন না।
এখন গুরু শাকুনের কপালে কালো কালি দিয়ে তৈরি বৃত্তের মাঝখানে একটা চোখের চিহ্ন। পরনে পিশাচসাধকদের মতো কালো পোষাক। হাতে একটা সোনা-রূপো ও হীরে বাঁধানো লাঠি। লাঠির মাথাখানা মড়ার খুলির মতো। খুলির চক্ষুকোটরে দুটো রুবি জ্বলজ্বল করে জ্বলছে।
গুরু শাকুনকে প্রণাম করে সামনের জাজিমের উপর বসলেন মন্ত্রীমশাই। মন্ত্রীমশাইকে দেখেই গুরু শাকুন বলে উঠলেন, “কি ব্যাপার মন্মথ, এত চিন্তিত কেন ? তুমি যদি চিন্তার সাগরে ডুবে যাও তাহলে বাকিদের কি হবে ?”
-“আপনি তো সর্বজ্ঞাতা গুরুদেব। যা ঘটছে তা তো আপনার অজ্ঞাত নেই। আমি আর চাপ নিতে পারছি না। যেদিকে হাত বাড়াচ্ছি সেদিকেই বিপর্যয়। শনি আর রাহু যেন একযোগে ঘিরে ধরেছে।” হাত জোড় করে কাতর স্বরে কথাগুলো বললেন মন্ত্রীমশাই।
গুরু শাকুন হেসে বললেন,”যা ঘটার তা ঘটবে। তুমি নিশ্চয়ই জানো যে আমি যেটার খোঁজ করি তা যে কোনও সামান্য জিনিস হয় না। তুমি সেটা আমার কাছে এনে দিতে পারোনি তার দায়িত্ব তোমার। দিন দিন অকেজো হয়ে যাচ্ছ। এজন্যই কি তোমাকে মন্ত্রীর চেয়ারে বসিয়েছিলাম ?”
-“আমি ওই শবাধারটি নিয়ে এসেছি গুরুদেব। ওটা আমার কনভয়েই আছে। এতক্ষণে বোধহয়…. “
মন্ত্রীমশাইয়ের কিছু বলার আগেই কয়েকজন আশ্রমিক একটা আটফুট বাই তিনফুট কিছু একটা লাল কাপড়ে ঢাকা দিয়ে ঘরের মেঝেতে নামিয়ে রাখল।
গুরু শাকুন জিনিসটার দিকে এগিয়ে গেলেন। কাপড়ের ঢাকনা খুলতেই বেরিয়ে এল কারুকার্য করা ধাতব সেই শবাধার যার উপরে আষ্টমাতৃকা, যম আর পিতৃগণের ছবি খোদাই করা আছে।
শবাধারের ঢাকনা খুলতেই দেখতে পাওয়া গেল সেই শবটিকে। গুরু শাকুন গোটা শবাধার আর শবখানা তিনফুট তন্ন তন্ন করে খুঁজলেন। কিন্তু কাঙ্খিত বস্তুটি পেলেন না। হতাশ হয়ে এসে বসে পড়লেন নিজের জায়গায়।
-“সেই দুর্লভ যোগ ব্যর্থ চলে যাবে এবারও। আবার প্রতীক্ষা। সাড়ে পাঁচ হাজার বছরের প্রতীক্ষা কি শেষ হবে না ? হে রাজা দুর্যোধন ! হে সেনাপতি অশ্বত্থামা !….” দীর্ঘশ্বাস ফেললেন গুরু শাকুন।
চলবে…..