Subrata Majumdar

 Subrata Majumdar

অশ্বত্থামার অস্ত্র – ৬
সুব্রত মজুমদার

সেখান থেকে হরপ্পা দশ বারো ঘন্টার রাস্তা। দু’জায়গাতেই চলল আমাদের সার্ভে। সিন্ধের প্রধান সার্ভেয়ার আনোয়ার পাশা ছিল আমাদের সঙ্গে। বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল আমাদের।

একদিন নাস্তা করতে করতে আনোয়ার বলল, “তোমাকে একটা জিনিস দেখাব ব্যানার্জি। যাবে আমার সঙ্গে ?”

বললাম, “কোথায় ?”

আনোয়ার বলল, “আজফাবাদ। লাড়কানা হতে কুড়ি মাইল।”

না বলার কোনও কারণই নেই। আনোয়ার যখন দেখাতে চাইছে তখন এলেবেলে জিনিস হবে না। সুতরাং বেরিয়ে পড়লাম আনোয়ারের সঙ্গে। বাহন বলতে ব্রিটিশ আমলের লঝঝড়ে জিপ। সেটা আবার চলেছে খরগোশের মতো ঝাঁপিয়ে ঝাঁপিয়ে। রাস্তা কুড়ি মাইল হলেও পাকিস্তানের রাস্তা বলে কথা, হাড়ের জয়েন্টে জয়েন্টে ব্যাথা ধরে গেল। আজফাবাদ যখন পৌঁছলাম তখন আমি আর আমি নেই।

গাড়ি যেখানে থামল সেটা একটা গ্রাম। বাড়িগুলোর উপর হিন্দু স্থাপত্য। বুঝতে বাকি রইল না যে সাতচল্লিশের আগে এটা একটা হিন্দু গ্রাম ছিল। আজ আর তাদের কোনও চিহ্নই নেই।

আনোয়ার আমাকে নিয়ে গেল গ্রামের শেষে একটা বাবলাঝোপের কাছে। সেই বাবলাঝোপটি যাকে ঘিরে তৈরি হয়েছে সেটা এক মন্দিরের ধ্বংসস্তুপটি । ধ্বংসস্তুপটির পেছনের একটা দেওয়াল অক্ষত। আর সেই দেওয়ালে একটা গর্ত। গর্তটা এতটাই বড় যে একটা মানুষ ঢুকে যাওয়া যায় সহজেই।

গর্ত দিয়ে ঢুকতেই একটা সঙ্কীর্ণ প্যাসেজ। কিছুদূর পর সেই প্যাসেজটিও বন্ধ। তবে ওপারে যে অপার রহস্য আছে সেটা বলাই বাহুল্য। সামনের রাস্তা বন্ধ দেখে ফিরেই আসছিলাম, আর ঠিক তখনই আমার হাত চেপে ধরল আনোয়ার।

বলল, “যে তোমার পথ আটকে দাঁড়িয়ে আছে তাকে তো আদাব জানাও।”

আমি মুখ ফেরাতেই অবাক হয়ে গেলাম। দেখলাম আমাদের সামনে যে দেওয়াল সামনের রাস্তা অবরোধ করে আছে তার মাঝখানে ঝুলছে একটা পাথরের ফলক। ফলকটা দেওয়ালের থেকেও কয়েক হাজার বছরের পুরোনো। ফলকের উপর সিন্ধুলিপি উৎকীর্ণ।

ফলকটার ছবি তুলে ফিরে এলাম। এতবড় একটা খাজানা পেয়েও মন খারাপ। কারন খাজানার চাবি আমার কাছে নেই। সিন্ধু সভ্যতার লিপি পড়া অসম্ভব। পৃথিবীতে হারিয়ে যাওয়া কয়েকটা লিপির অন্যতম এটা।

হতাশমনে দেশে ফিরলাম। কিন্তু একটা অদম্য জেদ আমাকে পেয়ে বসল। কি লেখা আছে ওই লিপিতে তা আমাকে জানতেই হবে।

এভাবে দু’দুটো বছর চলে গেল। এক শরতের সকালে এসে তাবু গাড়লাম গাহাড়ওয়ালের পাহাড়ী এলাকায়। আমাদের যেখানে খননকার্য চলছে তার পাশেই এক সাধুর গুহা। সাধুর সঙ্গে আলাপ হয়ে গেল। দেহ শীর্ণকায়, হাড়গুলো দেখা যাচ্ছে। বয়স নাকি পাঁচ সাতশোরও বেশি।

কথায় কথায় আজফাবাদে দেখা সেই শিলালিপির কথা উঠে এল। ছবিটা দেখালাম উনাকে। উনি হেসে বললেন, “কোত্থাও ছুটতে হবে না। আমি জানি এই শিলালিপিতে কি লেখা আছে।”

-“আপনি জানেন ?”

সাধু বললেন, “হ্যাঁ। তবে এই কথা কোথাও প্রকাশ করবে না। এই কথা জানাজানি হলে প্রাণসংশয় হতে পারে তোমার। এটা একটা সংকেত। এই সংকেত দিয়েছেন কৌরব সেনাপতি অশ্বত্থামা।

এতে লেখা আছে কৌরবদের ধনসম্পদ ও অস্ত্রভাণ্ডারের বিষয়ে। এখানে লেখা আছে, সূর্য যখন কুম্ভ রাশিতে বৃহস্পতি ও শুক্রের সাথে অবস্থান করে তখন এক নৈসর্গিক আলোকসম্পাত সৃষ্টি হয়।

এসময়ই কয়েক মূহুর্তের জন্য দৃশ্যমান হয় ওই অস্ত্রভাণ্ডারের দরজা। পাহাড়ের গুহার মধ্যে সযত্নে রক্ষিত সেইসব দিব্যাস্ত্রের দিকে যে বা যারা লোভার্ত দৃষ্টি দেবে তাদের ইহলোক নরকতুল্য হয়ে যাবে। দুষ্টগ্রহ আরও অশুভ হয়ে মৃত্যুস্থানে অবস্থান করবে।”

-“কিন্তু সেই অস্ত্রভাণ্ডারের সন্ধান পাব কোথায় ? মানে কোথায় রয়েছে সেই পাহাড় ?”

আমার কৌতুহল দেখে সাধু বললেন,”ওই দুরাশা মন থেকে পরিত্যাগ কর। এটাই জানবে যে জীবনে এমনও অনেক সুযোগ আসে যেগুলো পরিত্যাগ করতে হয়।”

না, পারলাম না নিজের অদম্য ইচ্ছাকে দমন করতে। সবকাজ ছেড়ে ওই পাহাড়ের সন্ধানে লেগে পড়লাম। যত দিন যেতে লাগল ততই সব রহস্য আমার কাছে ধরা দিতে লাগল অক্লেশে। এটুকু বুঝলাম যে সিন্ধুসভ্যতা আসলেই মহাভারত সমসাময়িক বৈদিক সভ্যতা।

আর্যরা নাকি লিখতে জানত না। তাই বেদ শুনে শুনে মুখস্থ রাখতে হতো। তাহলে ন-ণ, শ-ষ-স, ই-ঈ, উ-ঊ, ত-ট ইত্যাদি কি কেবল উচ্চারণ নিখুঁত করার জন্য ? পাণিনি বাদই দিলাম, বৈদিক ব্যাকরণ শুধু মৌখিক উচ্চারণের উপরই তৈরি হয়েছিল ? কয়েক হাজার বছর পর তৈরি ব্রাহ্মী-ই কি প্রথম লিপি ?

সিন্ধু সভ্যতার লোক লিখতে পড়তে জানত আর বৈদিক ঋষিরা জানতেন না। যুক্তিটা টেকে না। আমার দৃঢ় বিশ্বাস সিন্ধু-সরস্বতী সভ্যতাই বৈদিক সভ্যতার অংশবিশেষ। আর সিন্ধুলিপি এখনও পর্যন্ত প্রাপ্ত সবচেয়ে প্রাচীন বৈদিক লিপি।

আমি পুরাণ, সংহিতা থেকে শুরু করে পরাশর প্রভৃতির বিভিন্ন জ্যোতিষ গ্রন্থ পড়তে শুরু করলাম। অবশেষে মিলল সেই জায়গার খোঁজ। আর সেই জায়গাতে গিয়েই ঘটল অঘটন।

আমি ঘুণাক্ষরেও জানতাম না যে আমার মতোই আরও কেউ এই অস্ত্রভাণ্ডারের খোঁজে বের হয়েছে। কেউ নয় কারা। মানে একদল লোক। ওরা যেমন শক্তিশালী তেমনি নিষ্ঠুর। সেই গুপ্ত সংগঠনের নজরে পড়লাম। তারপর অনেক ঘটনা। শেষে প্রাণ হাতে করে পালিয়ে আসি।

ওরা এখনও আমার সন্ধান করছে। কারন ওরা চায় না যে ওরা ছাড়া অন্য কেউ ওই অস্ত্রভাণ্ডারের সন্ধান পাক। “

চলবে….

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *