#একদা_এক_ছেলের_গলায়
#সুব্রত_মজুমদার
আজ স্কুলে যথেষ্টই হেনস্থা হতে হয়েছে। অঙ্ক হতে ইংরেজি, এমনকি বাংলা ক্লাসেও কানধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে ক্লাসের বাইরে। কেউ ভুলেও এই কর্ণধারের দিকে ফিরেও তাকায়নি। সবাই আড়চোখে দেখে মিচকি হেসেছে।
তা হাসুক, ‘হেসে নাও দুদিন বই তো নয়’। বন্ধুর এমন দুর্দিনে যে হাসতে পারলে এটাই বিস্তর, এমন পারা হাঁসেও পারে না। তারা তো কেবল ডিমই পাড়ে।
হ্যাঁ, যত সমস্যার সূত্রপাত ওই পাড়া হতেই। পাড়ার জন্যই পড়ায় ব্যাঘাত আমার। তা খুলেই বলি ঘটনাটা। গতকাল সকালে উঠে সবেমাত্র বই নিয়ে বসেছি এমনসময় পাশের বাড়ির জগাই এসে বলল, “এই পিন্টু, মহীতোষ জ্যেঠুদের ঘরে কি হয়েছে জানিস ?”
মহীতোষ জ্যেঠুদের নাম শুনেই ভেতরটা হাঁকুপাকু করতে লাগল। ওদের ঘরে যা হয় তা ঘটা করেই হয়। ঘটনার ঘনঘটায় দিন কাবার হয়ে যায়। পড়াশোনা ফেলে বিনিপয়সার এমন তামাশা মেলা ভার। তাই বইগুলোকে তাকে তুলে দিয়ে টক করে বেরিয়ে পড়লাম। আর যেতে যেতেই শুনলাম সেই ঘনঘোর ঘটনা।
মহীতোষ জ্যেঠুর ছোটো ছেলেটা আস্ত একটা বাঁশি খেয়ে ফেলেছে। সেই বাঁশি গলায় আটকে গিয়ে পোঁ পোঁ করে বাজছে।
মহীতোষ জ্যেঠুর ঘরে গিয়ে দেখলাম সেখানে বিশাল ভিড়। সেই ভিড়ের মধ্যমণি হয়ে বসে আছে মহীতোষ জ্যেঠুর ছোটো ছেলে পরিমল। অবাক চোখে চারদিকে তাকাচ্ছে আর মাঝে মাঝে কাঁদবার চেষ্টা করতেই আওয়াজ উঠছে – ‘পোঁ-পোঁ’ ।
-“ওকে ডায়লিউটেড হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড দিন।” বলে উঠল সদ্য কলেজে ওঠা ছোকরা। কেমিস্ট্রিতে অনার্স নিয়ে কেমিস্ট্রির সব মিস্ট্রি এখন করতলগত তার।
কিন্তু সেই করতলগত জ্ঞান বাপের করতল মারফত গালে এসে পড়ল। বাপ দাঁত খিঁচিয়ে বলল, “বিদ্যের জাহাজ হয়েছে ! এই পড়ালেখা শেখা হচ্ছে। কালকেই তোমার হেড অফ দ্য ডিপার্টমেন্টকে গিয়ে ধরব। আজকাল কি শেখাচ্ছে এরা ?”
মানে মানে কেটেপড়ে ছোকরা। আর তখনই দন্তবিকাশ করে মুখ বাড়ায় গজেন স্বর্ণকার। খিকখিক করে হেসে বলে, “এখনকার ছেলেছোকরারা সব যা তা…… ওরা মাথাতেই বেড়েছে। অ্যাসিড লাগে সোনা গলাতে, গলাতে দিলে আর দেখতে হবে না। তবে গলা হতে কিছু বের করতে হলে যেটা সবচেয়ে প্রয়োজনীয় সেটা হল সোহাগা। একটু জলে….”
আর শেষ করতে পারল না গজেন, তাকে চুপ করিয়ে দিয়ে গণেশ বায়েন বলল,”চুপ কর তো হে, সবেতেই সোহাগা । আমাকে সূযোগ দিলে আমি একবার দেখতে পারি। বাখারি ছুলে একটা চিমটে তৈরি করে টুক করে গলা হতে বের করে আনব সেই পোড়া বাঁশি । এ আমার বাঁ হাতের খেল। ”
গণেশ বায়েন বাঁশের কঞ্চি বাখারি দিয়ে ঝুড়ি ধামা তৈরি করে, ‘ক-অক্ষর গোমাংস’ হলেও নিত্যনতুন বুদ্ধি দিতে ওস্তাদ। আর ওর বুদ্ধি নিয়ে বিপদে পড়ার সংখ্যাও কম নয়। স্বয়ং বিঘ্নহর্তাও বাঁচাতে পারেনি তাদের। সুতরাং এ বিষয়ে কেউই তেমন উৎসাহ দেখাল না।
পাড়ার বিরজা ঘোষাল হোমিওপ্যাথিতে কি কি যেন সব, তিনি এসে দেখ বললেন, “কেস তো গুরুতর। সে যাইহোক, হোমিওপ্যাথিতে সব সমস্যারই সমাধান আছে।” এই বলে বাক্স খুলে গ্লুকোজদানার বোতলে কি কি সব ওষুধ ঢেলে বললেন, “জবরদস্ত ওষুধ দিলাম, দিনে তিনবার খাওয়াবে। সাতদিনেই বাঁশি বেরিয়ে যাবে কাশির সঙ্গে।”
সঙ্গে সঙ্গে এলোপ্যাথ গোবিন্দ সাঁতরা ব্যাঙ্গের হাসি হেসে বলল,”বলিহারি ঘোষাল তোমার হোমোপাথির, সাতদিন ধরে ধেনো মদ আর চিনির দানার ঘ্যাঁট খেয়ে যাক ছেলেটা, আর ততদিন কানুর বাঁশি বাজুক। এসব হোমোপাথির কাজ নয় হে, অ্যালাপাথিই পারে এ বাঁশি বাজাতে থুরি বের করতে। ”
-“খুব উপকার হয় ডাক্তারবাবু।” হাত জোড় করে বলল মহীতোষজ্যেঠু। এলোপ্যাথির উপর ভরসা আছে তার।
গোবিন্দ ডাক্তার টর্চ নিয়ে অনেকক্ষণ পরীক্ষা নীরিক্ষা করে বললেন,”কেস জটিল। অস্ত্র করতে হবে, আই মিন সার্জারি। বড় নার্সিংহোমে নিয়ে গেলে লাখদশেক খরচ পড়বে। তবে চিন্তা নেই আমি হাজার তিনেকের ভেতরেই করে দেব।”
সার্জারির কথা শুনে সবাই এ ওর মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে লাগল। মহীতোষ জ্যেঠু তো কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলেন। জ্যেঠিমা ডুকরে কেঁদে উঠলেন,”ও আমার সোনার চাঁদ রে…. তোর গলা কেটে ফেলবে রে…. ”
গোবিন্দ ডাক্তার বললেন,”দুই পর্যন্ত নামতে পারি। ”
গোবিন্দ ডাক্তারের কথায় আমল দিল না কেউ, একটু আস্বস্ত হলেই হাজার পর্যন্ত নামতে। কিন্তু তার আগেই ‘কেটে ফেলে দেখা যাক’ নার্সিংহোমের দালাল এসে হাজির। তার কথায়,” এসব কোয়াকের পাল্লায় পড়বেন না, রোগীর যেকোনও সময় অক্সিজেন লাগতে পারে। আমাদের আইসিইউ রেডি আছে ।”
অ্যাম্বুলেন্সের ড্রাইভার বলল, “কাউকে কিছু বলার দরকার নেই, রোগী নিয়ে চেপে পড়ুন। আমার জানা ভালো একটা নার্সিংহোম আছে। সব টেস্টে তিরিশ শতাংশ ছাড়।”
কাশীনাথ কবিরাজ, বয়স সত্তরের উপর, এতক্ষণ দূর হতে এদের কান্ডকারখানা লক্ষ্য করছিলেন, এগিয়ে এসে বললেন, “ইংরেজ আসার পর হতেই তো জাত গিয়েছে আমাদের, সচরাচর কেউ ডাকে না, তবে অনুমতি দিলে আমি দেখতে পারি। ”
মহীতোষজ্যেঠু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,”সবাই তো দেখল, আর আপনিই কেন বাদ যান, আসুন।”
কবিরাজমশাই এগিয়ে গিয়ে বাঁ হাতে করে পরিমলের মাথাটা ধরে গুঁড়ি কর ডান হাত দিয়ে পিঠে মারলেন চাপড়। খানদুয়েক চাপড় খেয়েই কাশতে লাগল পরিমল। কাশির দমকের সঙ্গে বেরিয়ে এল বাঁশি।
ধন্য ধন্য পড়ে গেল কবিরাজের। গোবিন্দ সাঁতরা আর বিরজা ঘোষাল একসঙ্গে বলে উঠল -“হাঁতুরে।”
একে একে বিদায় নিল সবাই। আমিও ঘরে ফিরে এলাম। কিন্তু পড়ায় মন আর বসল না। ফলশ্রুতিতে কর্ণধার হয়ে ক্লাসের বাইরে। হাসবেন না কিন্তু, এই আমরাই ডাক্তার হয়ে…………
– – –