#কচু
#সুব্রত_মজুমদার
সংসারে এমন লোকও আছেন যারা নিঃশব্দে তাদের কর্ম করে যান কোনোরকম ফলের আশা না করেই। এরা গীতা না পড়েননি কিন্তু গীতার সেই বিখ্যাত বাণী শিরোধার্য করে বসে আছেন । ‘কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন’ ৷ গাছ লাগাও কিন্তু ফলের আশা করিও না।
উদ্ভিদজগতেও এরকম অনেক উদাহরণ আছে। কচু এদের মধ্যে অন্যতম। গোটা দুনিয়া আলু পটলের এত গুনগান করলেও বেচারা কচুকে ফেলে রেখেছে অপাঙক্তেয় করে। কেউ তার গুণগান করে না।
গুণগান না করলেও তাতে কচুর মর্যাদাহানি হয় না । ঝোল ঝাল টকে অনায়াসে বিচরণ করে সে। গোলআলু বলে যে বস্তুটির সুখ্যাতি সেটি তো ভারতে এসেছিল সপ্তদশ শতাব্দীতে পর্তুগীজদের হাত ধরে। পরে ব্রিটিশরা এর বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করে। আর ততদিন সম্ভবত সম্রাটের মুকুট ছিল কচুর মাথায়।
রাজত্ব গেলেই সম্মান যায়। এ কথা যেমন মানুষের ক্ষেত্রে সত্যি তেমনি সত্যি কচুর ক্ষেত্রেও। সব গিয়েছে কালের স্রোতে।
যতই অনাদর হোক অবজ্ঞা হোক বাঙালির রসনার স্বাদগুটিকাকে আমোদিত করতে কচুর জুড়ি নেই। সে মশলা দিয়ে নেড়েচেড়ে দমই হোক আর ভাজাগুঁড়ি দিয়ে টক বা শুধুই সেদ্ধ করে লবণ-লঙ্কা দিয়ে মেখে খাও, – স্বাদ সেই অমৃত। কচুর ক্ষেত দেখলে যে জীবটি পুলকিত হয় সে যদি এসবের মর্ম বুঝতে তবে কথাই থাকত না।
কচুর কচকচানিতেও ঘটি-বাঙাল কলহ এসে উপস্থিত হয়। ঘটিরা যখন কচুর ঝাল-ঝোল-টক-সেদ্ধ খেয়ে ঢেঁকুর তুলতে তুলতে শীতের রোদে বসে পরনিন্দা পরচর্চায় মনোনিবেশ করে তখন বাঙাল খুঁজে ফেরে কচুর লতি। শুঁটকি মাছ দিয়ে বেশ তরিবত করে খায়। আর সেই শুঁটকির গন্ধে অতীষ্ঠ হয়ে আইনের দ্বারস্থ হতে হয় ঘটি প্রতিবেশীকে । কিন্তু ‘বাঙালকে হাইকোর্ট’ দেখানো অতই কি সহজ !
বাঙাল-ঘটি যতই মারপিট করে মরুক না কেন কচুর তাতে কিছু যায় আসে না, সে পত্র হতে কন্দ পুরোটাই সুস্বাদু। তার স্বাদে মজেনি এমন পাবলিক নেই। কিন্তু ওই যে বলেছি তবুও নাম নেই বস্তুটির। কারোর কিছু অপছন্দ হলেই বলে ‘কচু’। এখানে কচু মানেই নঞর্থক। আর এই ‘ইসে’ ও ‘কচু’ দুটি শব্দের জন্যই বিখ্যাত হয়ে আছে পূর্ববঙ্গ।
কচুর এই অনাদর বিহারিরাও করে থাকেন। কথায় কথায় ‘ঘুঁইয়া’ আর ‘ঘুঁইয়া’ । আরে বাবা সবই যদি ‘ঘুঁইয়া’ আর লহসুন তো আছে টা কি ? তবে সেখানেও বস্তুটি নেহাত ফেলনা নয়, ঘুঁইয়া কি সব্জি, ঘুঁইয়া কি পরাঠা, ঘুঁইয়া কি চাটনি হতে শুরু করে ঘুঁইয়া কি ক্ষীর পর্যন্ত রেঁধে খায় ওরা।
আগেকার লোক বলত ‘খাও কচু তো থাকবে কিছু’। কারন তখন আলু ছিল পাঁচটাকা তো কচু দু’টাকা মতো। আর এখন চৌদ্দ টাকার আলুর পাশাপাশি কুড়ি টাকা কিলো কচু মধ্যবিত্তের কপাল কুঞ্চিত করে। তার উপরে যোগ হয়েছে অম্বল। বাঙালি মধ্যবিত্ত যত না অম্বল রাঁধে তারবেশি অম্বলে কাঁদে। এই অ্যান্টাসিডের যুগে কচু খাওয়া তাই খুব রিস্কি।
সব জিনিসের মতোই কচুও উত্তমরুপে পুড়িয়ে খাওয়া যায় । এই নরদেহ পোড়ালে ছাই হয়ে মিশে যায় পঞ্চভূতে, অপরদিকে ফোসকা পড়া গরম ছাইয়ের ভেতর হতে সাবধানে বের করা হয় কচুপোড়া। তারপর ভালোকরে ধুয়ে তেল-পেঁয়াজ-লঙ্কা-লবণ দিয়ে মাখলে উপাদেয় হয়। এমন একটা উপাদেয় জিনিসকে লোকে কেন যে প্রবাদে নামিয়ে এনেছে তা বুঝলাম কচুর গেঁড়ো (মা-কচু ) পুড়িয়ে খেতে গিয়ে।
এই বস্তুটি সহজেই মোলায়েম হতে চায় না। আরে বাবা যেখানে তোর ছেলেপুলেরা গলে মলম হয়ে যাচ্ছে সেখানে তোর এতো অহঙ্কার কিসের ? চিতাতেই সব শেষ। না, গনগনে আগুনেও বিন্দুমাত্র নম্রস্বভাব আসে না ইনার। বোধহয় সেজন্যই বিদগ্ধেরা ‘কচুপোড়া খা’ বলে প্রবাদ সৃষ্টি করেছেন।
আলুর মতোই কচু জিনিসটাও মাংসের সঙ্গে বেশ মিলেমিশে যায়। কচু দিয়ে মাংসের ঝোল এককথায় অপূর্ব। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে মাংসের সঙ্গে কচুর এই মাখামাখি পূর্ববঙ্গের জলহাওয়ার ফল। ওরা ওলকেও ওলকচু বলে। আর মানকচুর মতো বেয়ারা জিনিসকে জব্দ করতে পারে একমাত্র ওরাই।
কচুর এত প্রশস্তি করতে করতে লালন সাঁইয়ের একটা গান মনে পড়ে গেল। ‘খেয়েছি বেজেতে কচু না বুঝে, এখন তেঁতুল কোথা পাই খুঁজে।’ বেজেতে কচুদের জন্যই দেশি কচুদের এমন হেনস্থা। তাই অভিজ্ঞ লোকেরা বারবার সাবধান করে দেন, – ‘পান পান দেখে কচু নিবি। কালো কচু মোটেই নিবি না। ও কচু জলের কচু, সেদ্ধ হতে চায় না। সব্জিওয়ালাকে বলে রাখবি, কচু না সিজলে পয়সা ফেরত দিতে হবে।”
শেষ করব অঘোরবাবুর একটা ঘটনা দিয়ে। কলকাতার এক মলে গিয়েছিলেন অঘোরবাবু। সেখানে সব্জি বিভাগে কেনাকাটার পর তাকে একটা লাকি কুপন দেওয়া হয়। কুপনটা নিয়ে দৌড়তে দৌড়তে হাজির হলেন আমার কাছে।
-” দেখ তো হে মাষ্টার একটা কি। ”
নেড়েচেড়ে দেখে বললাম,”এটা লাকি কুপন অঘোরবাবু, এই কালো অংশটা স্ক্যাচ করে যে নম্বর পাওয়া যাবে তা ওদের নাম্বারে এসএমএস করলে ওরা প্রাইজ দেবে।”
-“হুম্…. তাই ! দাও ক্যাচ করে।”
নির্দেশিত পদ্ধতি অনুসারে এসএমএস করতেই মেসেজ এল ‘you have won a kilo of arbi’। অঘোরবাবু বসলেন আরবির অর্থ নির্ধারণ করতে।
-“আচ্ছা মশাই, আরবি মানে তো আরবের লোক।”
আমি সংশোধন করে দিয়ে বললাম,”আরবে থাকলেই আরবি। সে লোকই হোক আর ভাষাই হোক আর ডিজেল পেট্রোলই হোক। ”
অঘোরবাবু কি যেন ভেবে বললেন, “ডিজেল পেট্রোল হলেও ক্ষতি নেই, এককেজি পেট্রোলের অনেক দাম। তবে আমার মনে হয় সোনা হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। সোনা খুব সস্তা ওখানে। ”
তিনদিন পর অঘোরবাবু এলেন। হাতে একটা পলিব্যাগ। ওখানা আমার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বললেন,”এই নিন আপনার আরবি। পুরোটাই আছে।”
ক্যাচ মিস হয়ে যেতেই কতগুলো কচু পলিব্যাগ হতে বেরিয়ে গড়িয়ে পড়ল । সেই থেকেই জানলাম আরবে বাস করুক আর না করুক কচুকে আরবি-ই বলে।
—