Subrata Majumdar

#আধার

#সুব্রত_মজুমদার

‘তৈলাধার পাত্র কি পাত্রাধার তৈল’ এই কচকচিতেই সারাজীবন পেরিয়ে গেল। পরীক্ষা সবসময় শুভফল দেয় না, তাই গল্প শোনার পর আর পাত্র উল্টে পরীক্ষা করে দেখেনি তপেন। তবে আজকাল যা চলছে তাতে নিরাধার থাকা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। আধারিত হতেই হবে। নাহলে দুনিয়া অন্ধকার।

কিন্তু আধার পাওয়া কি চাট্টিখানি কাজ রে বাপ ! এক এক জিনিসের এক এক আধার। যেমন তেজস্ক্রিয় পদার্থ রাখতে হয় সীসার আধারে, কাচের আধারে অ্যাসিড। কিন্তু ভুল করেও হাইড্রোফ্লুরিক অ্যাসিডকে কাঁচের পাত্রে রাখতে যেয়ো না, তাহলে পাত্রমিত্র সব হজম হয়ে যাবে।

মানুষেরও আধার আছে, ভালো পরিবেশ, সৎসঙ্গ, সাধুসঙ্গ এগুলোই মানুষের আধার। এতে মানুষ সুরক্ষিত থাকে। কিন্তু সরকার তা মানে না, বলে- আধার কার্ড চাই। চাইলেই কি আর সব পাওয়া রে বাপ।

-“কেন পাওয়া যায় না ? তোমার মুরোদ নাই সেটাই বলো। চঞ্চল জামাবাবুকে দেখছ, চিঙ্কির বর, ও তো চিঙ্কির তিন তিনটে আধার কার্ড করিয়ে দিয়েছে। আর তুমি ?”

সত্যিই এ যুগে তপেনের মতো লোক বেমানান। চিঙ্কির বর যেখানে চিঙ্কির জন্য তিন তিনটে আধার কার্ড করিয়ে দিয়েছে সেখানে একটাও পারেনি তপেন । নিজের না হলেও যাকে বলে বেটারহাফ তার বেটারটা দেখা তো উচিত ছিল।

চিঙ্কির বরের প্রসঙ্গ আসার পর হতেই পেটের ভেতরটা গুরগুর করছে তপেনের। না, প্রকৃতির ডাক নয়, ভেতরের ইগো নামক বস্তুটির আস্ফালন। অফিসে মন বসল না, মিস করের মোহময় হাঁসিতেও যেন সেই ফিলিংস এলো না।

দেখেশুনে পাশের টেবিলের পরমার্থ বলল, “কি ব্যাপার দাদা, বৌদি ধরে শুটিঁয়েছে ?”

বীরভূমের ছেলে পরমার্থ, কথাবার্তা ওরকমই ডন টাইপের, সবাই সমঝে চলে। তবুও সমস্যার কথা বলল তপেন। শুনে হা-হা করে হেসে পরমার্থ বলল, “ঠিকানা লিখে দিচ্ছি, কালকেই এই ঠিকানায় চলে যান দুজনে আধার হয়ে যাবে। না হলে……”

পরমার্থর দেওয়া ঠিকানায় এসে তপেন বুঝল যে আর যাই হোক তথ্যটা ভুল দেয়নি । বিশাল লম্বা লাইন, তবে মানুষের নয়, – আধলা ইট, ছেঁড়া চপ্পল, নাইলনের ব্যাগ সার দিয়ে দাঁড়িয়ে থুরি শুয়ে আছে। গুনে দেখল মোটমাট ঊনচল্লিশটা। মানে তার নাম্বার চল্লিশ।

কিন্তু লাইনে কি রাখা যায় ? এ নিয়ে ধুন্ধুমার বেঁধে গেল কর্তা-গিন্নিতে। অবশেষে তপেন তার একপাটি জুতো রেখে এল একটা চশমার পেছনে। চশমাওয়ালা বেচারার জন্য মনে দুঃখ হল তপেনের, এও আরেক হতভাগা।

দীর্ঘ তিনঘন্টা পর ডাক এল। ভেতরে ঢুকতেই দেখল একজন ল্যাপটপ নিয়ে বসে আছে। বলল, “ডকুমেন্ট দিন।”

তপেনের বৌ হ্যান্ডব্যাগ হতে একটা কাগজ এগিয়ে দিতেই লোকটা ব্যস্ত হয়ে পড়ল ল্যাপটপ নিয়ে। আরেকটা লোক তপেনের বৌয়ের হাতদুটো ধরে দুটো লাইটজ্বলা কাচের উপর চেপে ধরল। তপেন কি যেন বলতেই যাচ্ছিল কিন্তু ততক্ষণে ছবি তুলে চোখে বাইস্কোপ ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
তপেন রেগে গিয়ে বলল, “আপনারা আমার কথাটা শুনবেন তো !”

লোকটা ঝাঁঝ দেখিয়ে বলল, “অত সময় নেই, লাইনে অনেক লোক। আপনার ডকুমেন্ট দেন।”

কর্তাগিন্নি আধার কার্ডের ছবি তুলে ঘর এল পড়ন্তবেলায়। গিন্নির খুব আনন্দ, তপেনের থুতনিটা ধরে বলল, “সোনুমোনু…. গুলুগুলু…”

মাসখানেক পর কার্ড এল। একজোড়া। প্রথম কার্ডটা তপেনের, মোটা মোটা অক্ষরে লেখা তপেন বটব্যাল, আর নীচে জ্বলজ্বল করছে গিন্নির শ্রীমুখ। দ্বিতীয় কার্ডটিতেও তাই, রচনা বটব্যাল নামের নীচে তপেনের গুম্ফশোভিত চেহারা।

নিজের ছবিযুক্ত কার্ডটাকে নিয়ে বুকের মধ্যে ধরে তপেনগিন্নি বলল, “একটা হলো। এই শোনো, আরও তিনটে কার্ড চাই আমার, – চিঙ্কিকে দেখিয়ে দেব আমার সোনুটাও পারে।”

তপেন বসে পড়ল বিছানার উপর, মাথা আর কাজ করছে না।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *