প্রেমে ও প্রজ্ঞায়—’তুমি’ ও ‘আমি’র শূন্যতা নির্মাণের কাব্য
তৈমুর খান
প্রেম কী তা সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। অধরা স্বপ্নের নারী, নাকি একই বালিশে পাশাপাশি শুয়ে থাকা নারী, নাকি কোনো কিছুই নয় মনের এক শূন্যতা? যেখানে পাওয়ার মধ্যেও না পাওয়া, যেখানে না পাওয়ার মধ্যেও পাওয়া প্রেমের বিষয়, সেখানে প্রেম যে পরস্পরবিরোধী ধারণা তা বলাই বাহুল্য। রবীন্দ্রনাথ এই প্রেমের উপলব্ধিকেই সুর দিয়েছিলেন:
“তোমরা যে বলো দিবস-রজনী ‘ভালোবাসা’ ‘ভালোবাসা’—
সুখী, ভালোবাসা কারে কয়! সে কি কেবলই যাতনাময়।”
শুধু এই টুকুই নয় প্রেমের মৃত্যু যে মিলনে অর্থাৎ বিবাহে তাও রবীন্দ্রনাথ বুঝেছিলেন। জীবনানন্দ দাশ এই প্রেমকেই উপলব্ধি করে লিখেছিলেন:
“জীবন হয়েছে এক প্রার্থনার গানের মতন
তুমি আছ ব’লে প্রেম,- গানের ছন্দের মতো মন
আলো আর অন্ধকারে দুলে ওঠে তুমি আছ ব’লে!
হৃদয় গন্ধের মতো–হৃদয় ধূপের মতো জ্ব’লে
ধোঁয়ার চামর তুলে তোমারে যে করিছে ব্যজন!
ওগো প্রেম ,-বাতাসের মতো যেই দিকে যাও চ’লে
আমারে উড়ায়ে লও আগুনের মতন তখন !
আমি শেষ হব শুধু ,ওগো প্রেম, তুমি শেষ হলে !”
তখন বোঝা যায়, প্রেম শুধু শরীরে নয়, ভোগ্য বস্তুতে নয়, সমর্পণে, ত্যাগে, বেঁচে থাকার প্রেরণায়, সৃষ্টির উৎসাহে, সাধনার প্রজ্ঞায় অবস্থান করে। তখন শরীরকে ছাপিয়ে যায় অতলান্ত অনুভূতির পরম আয়ু নিয়ে। প্রেম তখন প্রাণ। এই কারণেই ব্রাজিলীয় ঔপন্যাসিক এবং গীতিকার পাওলো কোয়েলহো(১৯৪৭)বলেছেন: “Love is an untamed force. When we try to control it, it destroys us. When we try to imprison it, it enslaves us. When we try to understand it, it leaves us feeling lost and confused.”
অর্থাৎ ভালোবাসা একটি অদম্য শক্তি। আমরা যখন এটি নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করি, এটি আমাদের ধ্বংস করে। যখন আমরা এটিকে বন্দি করার চেষ্টা করি, এটি আমাদের দাসত্ব করে। যখন আমরা এটি বোঝার চেষ্টা করি, তখন এটি আমাদের হারিয়ে যাওয়া এবং বিভ্রান্তি বোধ করে। সুতরাং প্রেম যে মুক্তির দিশারী, ভোগে-চরিতার্থে-কামনায়-হিসেবে-লাভে তাকে পাওয়া যায় না তা বলাই বাহুল্য। সুবর্ণ রায়ের কবিতায় বারবার প্রেমের এই দর্শনই জেগে উঠেছে।
কোন্ ক্যাটালগে লিখব নহবৎ থেকে লোনা দেয়ালে রূপকথা, কিংবা মেষপালকের গান যা দ্রাঘিমা ছুঁয়ে যায় এপিটাফ থেকে চাপা ফসিলের স্বীকারোক্তি এবং বৃষ্টির অক্ষর ধরে আঁধারে মোমের আলো জ্বেলে—কবিকে নির্মোহ অভিনিবেশে লিখতে হয় এই প্রেমকে। দুঃখ জাগানিয়া রাতে নিজের আত্মোৎসর্গের বিনীত বিন্যাস এভাবেই পথ খোঁজে। লেখা হয় ‘প্রেমের কবিতা’(প্রথম প্রকাশ মে ২০২২)।
এক সহজিয়া জীবনের মর্ম সঞ্চারি আলোক সত্তা কবিতাগুলিকে চালিত করেছে। যৌনতা বা দেহবাদ কখনো সীমানা হয়ে আসেনি। তাই জীবন ও প্রকৃতির অনন্ত প্রজ্ঞায় তার ধ্বনিময় উপস্থিতি আবহমানকালের অভিজ্ঞান বহন করে চলেছে। কবি জীবনকে অনন্তের পথে চালিত করেছেন। পার্থিবতার মালিন্য, রোগ-শোক জীর্ণতাকে ছেড়ে মহামহিম এক দিব্য সম্মোহনে উত্তরণ ঘটিয়েছেন:
“কী সে ব্যাখ্যা যার অপেক্ষা অনন্তকাল আনন্দদায়ক নিপুণতার সাথে শব্দবদ্ধতা খুঁজে ফেরে হেঁয়ালি উদ্বেগে আর অন্তহীন রাস্তা পথ পেতে রাখে আশাহীন গোধূলির দিকে!”
কবি দুরধিগম্যের সন্ধান করেন তার ব্যাখ্যা নিজেও করতে পারেন না। অনন্ত আর আকাশ সাধনায় সেই শক্তির অনুবর্তী হয়ে বিনির্মাণে অগ্রসর হন। সেখানে ‘আশা’ অর্থাৎ মোহটান একেবারেই থাকে না। অলৌকিক ঘরের জানালা জুড়ে বৃষ্টির ছাঁট আসে। অলৌকিক মেঘ রঙ মেখে দুর্বোধ্যতায় অবগাহন করে। এই অনন্তগামী রহস্যচারিতায় কবি ডুবে যান। পুরুষগন্ধ বিজ্ঞাপনের মুগ্ধতাও সেখানে থাকে না। আত্মশ্লাঘা সম্পূর্ণভাবেই অন্তর্হিত হয়। কবি তখনই লিখতে পারেন:
“একদেহ আগাছা আর বুনো ফুলের গন্ধ নিয়ে
জঙ্গল সাজিয়ে রাখি এক ঘন্টা বৃষ্টিপাতে
সম্মোহিত নির্জন দুপুরে!”
নিজেকেও প্রকৃতি করে তোলেন। কখনো বৃষ্টিতে, কখনো রোদে; কখনো আগাছায়, কখনো উদ্ভিদে-ঘাসে চেতনা সঞ্চারিত হয়। দুঃখ জাগানিয়া রাতে প্রেমকে তবু অনন্ত লুব্ধক এর মতো মনে হয়। তিনি দূরত্বের নাবিক হয়ে ভেসে চলেন।
কিন্তু সায়াহ্নে জমাট মেঘের আড়ালে এক পশলা রিমঝিম বৃষ্টির অপেক্ষা করেন। নিজেকে তখন শ্রান্ত পথিক মনে হয়। ভেজা মাটির গন্ধ আর কোথাও ফুল ফোটার সুবাস টের পান। তখনই বুঝতে পারেন তার বুকেও অভিমান আছে। যে অভিমান বৃষ্টির মতো শব্দ হয়ে কবিতায় নামে। অভিমান বাউলের একতারায়, সাঁজের শুকতারায়, অভিমান কবিতার খাতায়ও। তারপর এপিটাফ হয়ে যায় সেসব কবিতা। কবিও রোগপোষা কবি। একাকিত্ব আর গভীর অভিনিবেশে তখন উপলব্ধি করেন:
“বিষাদ চুম্বন আর বিফল দাঁড়িয়ে থাকা।
নৈঃশব্দ্যের জমে ওঠা আর বোবা নক্ষত্ররাশি।
কালো পাইনের ছায়া আর শব্দহীন দুর্বোধ্যতা।
বিলম্বিত লয় আর এক নুড়ির বেজে যাওয়া।
অতঃপর, ফসিলের প্রাচীন মাটিতে
ছড়িয়ে পড়ে নানা বর্ণের নতুন সব ফুল।”
তখন কবিতার কাছে আমরাও নির্বাক হয়ে বসি। স্তব্ধতার ব্রহ্মাণ্ড রচনা করে নিরুচ্চারিত আলাপচারিতায় কথাহীন কথার স্রোতে কবি আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে যান। সবই শূন্যতা সম্পৃক্ত বর্ণমালা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই নাথিংনেস্ই এসে কড়া নাড়ে। কবির হৃদয়ে বসতি চায়। তখন কবিও লিখতে পারেন:
“যন্ত্রণার সীমানা ছুঁয়ে যায় যতিহীন
নতুন শব্দের ভণিতা, কবিতার করিডোর;
তুমি নেই জেনেও দরজা খুলে রাখা
বাড়ি নেই আমার, আমি থাকি তবু…”
এই জগৎটাই কবির কাছে আশ্রয়হীন জগৎ। ক্লান্ত বিধ্বস্ত জীবনের ভার বইতে বইতে নিজেকেও প্রবাসী মনে হয়। কিছু নেই, কেউ নেই, এই অনন্তের একাকিত্ব গ্রাস করে। দার্শনিক আর্থার শোপেনহাওয়ার এই কারণেই বলেছেন:”We can regard our life as a uselessly disturbing episode in the blissful repose of nothingness.”
অর্থাৎ আমরা আমাদের জীবনকে শূন্যতার আনন্দময় বিশ্রামে একটি অকেজো বিরক্তিকর পর্ব হিসাবে বিবেচনা করতে পারি।
এই দার্শনিক বোধ সুবর্ণ রায়ের মধ্যেও জেগে উঠেছে। তাই চিরাচরিত ধারণার প্রেমের কবিতা তিনি লিখতে পারেননি, অথবা লিখতেও চাননি। কবিতায় যে ‘তুমি’ উচ্চারিত হয়েছে, তা সহজিয়া জীবনসত্তারই এক ছায়ামায়া রূপ। কখনো তাকে নারী, কখনো তাকে স্ত্রী, কখনো তাকে দেবী, আবার নিছক আত্মগত আনন্দের স্বরূপ বলে মনে হয়েছে। বহুমুখী প্রজ্ঞার সম্মোহন থেকেই এই উচ্চারণ। কাব্যের শেষ কবিতায় তাই বলেছেন:
“সত্তার ভিতরদেশে
স্বপ্নের অনেক গভীরে
দুটি শব্দের মাঝামাঝি
অক্ষর থেকে অক্ষরের দূরত্বে
কলম আর পৃষ্ঠার মধ্যবর্তিতায় আছো”
কবিতাটির নাম ‘তুমি আছো’ বলেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে কবির একান্ত আত্মগত চেতনার মধ্যেই যে সত্তা বিরাজ করছে তারই সম্মোধন। যে ‘তুমি’ অনন্তের, যে ‘তুমি’ সমস্ত মানবের, যে ‘তুমি’ শাশ্বত কালের। আবার সেই ‘তুমি’ ব্যক্তির মধ্যেও তুমুল নির্দেশ। সমস্ত শূন্যতা জুড়েই বিরাজমান।
‘মিথ্যে কথার স্বর্গ’(প্রথম প্রকাশ নভেম্বর ২০২১ -এপ্রিল ২০২২) নাথিংনেস থেকেই কবির যে বোধের যাত্রা এই কাব্যেই তার তীব্র প্রতিফলন ঘটেছে। কেউ নেই কিছু নেই, যা আছে তা শুধু কথার পিঠে কথা। মিথ্যে কথার স্বর্গে আমাদের বসবাস। কবিতায় বলেছেন:
“এ এক মায়াবী অভিজ্ঞান—
নিজের নিজেকে দেওয়া শ্রেষ্ঠ স্মারক!
বাঁচার পরাজয়কে মেনে নিয়ে
ছায়ার ঘনত্ব আঁকড়ে বসে থাকি।”
আত্মপ্রবঞ্চনার মধ্য দিয়ে নিজেকে মোহাবিষ্ট করা। অন্তঃসারশূন্য জীবনমহিমার আসক্তিতে কেবল শূন্যতাকেই আঁকড়ে ধরা। এই কারণেই জার্মান চিত্রশিল্পী ও ভাস্কর আনসেলম কিফার(১৯৪৫) বলেছেন:
“Life is an illusion. I am held together in the nothingness by art.”
অর্থাৎ জীবন একটা মায়া। আমি শিল্পের দ্বারা শূন্যতাকে একসঙ্গে রাখি। কবিতার মতো শিল্পও শূন্যতাকেই সিদ্ধির চূড়ান্ত পর্যায় হিসেবে দেখেছেন কবি। তাই ‘নিয়তি’ এসে স্বয়ংপ্রভ হয়ে উঠেছে:
“দেখবে আমরা একই পথে চলেছি একই প্রান্তে
যেখানে জল মিশে যায় আকাশে
আকাশ জলে”
আকাশ ও জলের শূন্যতা যেমন মিশে গেছে। তেমনি আলো-অন্ধকারের শূন্যতাও একীভূত হয়ে গেছে। কবি লিখেছেন:
“অন্ধকার থেকে
দিনের আলোয়
মিলিয়ে যায় কোহলপাত্রে
তাদের বুদবুদের মিথ্যা জীবন”
মিথ্যে জীবনের এই ব্যাপ্তি যে শূন্যতা রচনা করেছে তা এম্পটিনেস্-এরই দোসর। তখনই আমরা আত্মধ্বংসের অপেক্ষা করতে থাকি। ঘুরেফিরে একই ক্ষয় বাজতে থাকে। শোকার্ত স্বর বিষণ্ন শব্দ খুঁজে নেয়। হারাতে হারাতে শুধু শূন্যতার বিষম সংখ্যায় ভরে যায় ক্ষুদ্র জীবনের কাঠামো। তখন:
“চারপাশ নিকষ অন্ধকার
সেই অন্ধকারের চারপাশে
আলোর দীপ্ত দ্যুতিময় বলয়
সেই আলোর রেখার চারপাশে
ফিকে হয়ে যাওয়ার কম্পিত কিনারা
আর সেই কিনারা ছুঁয়ে ফের অন্ধকার…”
স্বয়ংক্রিয় অভিযাপনে এই ধ্বংস প্রক্রিয়া এগিয়ে চলে। প্রহেলিকাটি ঘূর্ণায়মান এবং ক্রমবর্ধমান, যেন সময়। ‘অন্ধকার’,’ক্ষয়’,’ভাঙা’,’অস্বাভাবিক’, ‘প্রহেলিকা’, ‘নিঃশেষ’, ‘ভস্ম’, ‘বিষাদ’, ‘মিথ্যে’ শব্দগুলি বারবার ফিরে আসে। তখন মনে পড়ে যায় চার্লস বুকোস্কির একটি কবিতা:
“darkness falls upon Humanity
and faces become terrible
things
that wanted more than there
was.
all our days are marked with
unexpected
affronts – some
disastrous, others
less so
but the process is
wearing and
continuous.
attrition rules.
most give
way
leaving
empty spaces
where people should
be.
and now
as we ready to self-destruct
there is very little left to
kill
which makes the tragedy
less and more
much much
more.”
(Charles Bukowski, You Get So Alone at Times That it Just Makes Sense)
অর্থাৎ
অন্ধকার মানবতার উপর পড়ে
এবং মুখগুলি ভয়ানক
জিনিস হয়ে ওঠে
যা ছিল তার চেয়ে বেশি চায়।
আমাদের সমস্ত দিন
অপ্রত্যাশিত
অপমান দ্বারা চিহ্নিত—কিছু
বিপর্যয়কর, অন্যগুলি
কম
কিন্তু প্রক্রিয়াটি
পরা এবং
অবিচ্ছিন্ন।
ত্যাগের নিয়ম।
বেশিরভাগই খালি জায়গা ছেড়ে
দেয় যেখানে মানুষ থাকা উচিত। এবং এখন আমরা যখন আত্ম-ধ্বংসের জন্য প্রস্তুত, সেখানে হত্যা করার জন্য খুব কম বাকি আছে যা ট্র্যাজেডিকে কম করে এবং আরও অনেক বেশি করে তোলে।
সুবর্ণ রায়ও এই মুহূর্তটিই যেন ফিরে পেয়েছেন কবিতায়। তাই বিপর্যয়গুলিও ফিরে এসেছে। মিথ্যে কথার স্বর্গে নরকের প্রবাহ দেখা দিয়েছে। ‘তুমি’ এবং ‘আমি’ এখানে সবাই একাকার হয়ে গেছে। মানবসত্তারই প্রতিধ্বনি আবহমান কালের শূন্যতার অসীমের নির্মাণ করে চলেছে।

১)প্রেমের কবিতা :সুবর্ণ রায়, সোপান, ২০৬ বিধান সরণি, কলকাতা ৭০০০০৬, মূল্য ৪০০ টাকা।প্রচ্ছদ দেবাশীষ সাহা।

২) মিথ্যে কথার স্বর্গ: সুবর্ণ রায়, পাঠক, ৩৬-এ কলেজ রো, কলকাতা ৭০০০০৯, মূল্য ২০০ টাকা।প্রচ্ছদ রাজদীপ পুরী।
