Subarna Roy

বাংলার জনজাতির ঐতিহ্যময় সংস্কৃতি অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের পরিচয় সন্ধান 

🌺

তৈমুর খান 

🌱

 লোকসংস্কৃতি, ইতিহাস ও সেইসঙ্গে বাংলার জনজাতির উৎস ও ঐতিহ্য সন্ধান বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ সংকলন ও সম্পাদনা করেছেন কবি সুবর্ণ রায়:   

বাংলার জনজাতির ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি

 অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের প্রাসঙ্গিকতা’ (প্রথম প্রকাশ জানুয়ারি ২০২২)। বাংলার আদিম অধিবাসীদের প্রাক্-দ্রাবিড় গোষ্ঠীর লোক ভাবা হলেও কীভাবে তারা আদি অস্ত্রাল অর্থাৎ অস্ট্রেলিয়ার অধিবাসীদের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে ওঠে তার সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। ৩০ হাজার বছর পূর্বে অস্ট্রেলিয়া পাড়ি দেওয়া কতটা সম্ভব ছিল সে বিষয়ে সংশয় আছে। তবে বেশিরভাগ পুরাতাত্ত্বিক ও নৃতাত্ত্বিকদের অনুমান প্রোটো-অস্ট্রালয়েডরাই ভারতবর্ষের আদি বাসিন্দা।

যাইহোক বর্তমান বাংলায় ৩৮টি মূলবাসী জনজাতি বা তফসিলিভুক্ত আদিবাসী রয়েছে। এদের বর্ণগত, ভাষাগত, এবং সংস্কৃতিগত দুটি প্রধান ধারা লক্ষ করা যায়—হিমালয় ও হিমালয়ের পাদদেশস্থিত আদিবাসী এবং সমতলভূমির আদিবাসী। প্রথম অংশে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসকারী মঙ্গোলীয় অথবা অ্যাংলো-মঙ্গোলয়েড(গারো, মেচ, লেপচা, ডুকপা, লিম্বু, টোটো, ওরাওঁ, চাকমা প্রমুখ)-দের দেখা যায়।

দ্বিতীয় ভাগে সমতল ভূমির আদিবাসীরা প্রধানত আদি-দ্রাবিড় ও দ্রাবিড় বর্ণের(ওরাওঁ, মাল,পাহাড়িয়া, সাঁওতাল, মুণ্ডা, ভূমিজ, বীরহোড়, কোড়া প্রমুখ) লোকদের দেখা যায়। বাংলার বিভিন্ন জেলায় এরা ছড়িয়ে পড়ে। এইসব জনজাতির জীবনধারা, সংস্কৃতি ও অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে তথ্য সন্ধানের কাজ করেছেন ৮ জন লেখক—পীযূষকান্তি সরকার, সুব্রত মুখোপাধ্যায়, সৌমেন মণ্ডল, বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়, সুশীলকুমার রাভা, প্রমোদ নাথ, মনোনীতা চক্রবর্তী এবং উদয়শঙ্কর মহান্তি।

   সুবর্ণ রায় গ্রন্থের ‘অনুবন্ধে’ উল্লেখ করেছেন: “এই গ্রন্থের উদ্দেশ্য ইতিহাসের ইতিবৃত্ত শোনানো নয়। সমাজতত্ত্বের আলোচনাও নয়।নয় নৃতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ। বরং বলা যায় গল্প বলা। বাংলার জনজাতির ঐতিহ্যময় সংস্কৃতির টুকরো টুকরো গাথাকে পাঠকের সামনে এনে দেওয়া, নিজেদের অতীতকে খুঁজে ফেরা, নিজেদের জীবনযাত্রাকে দু-চোখের সামনে মেলে ধরা যাতে আগামী সভ্যতার পথ চিনে নিতে দৃষ্টির স্বচ্ছতা আসে।”

এই বক্তব্য থেকেই বিষয়টি পরিষ্কার হয় সম্পাদক এবং লেখকের দায়বদ্ধতা কতখানি, তাঁদের অতীত ঐতিহ্য ও সত্যের প্রতি সদা জাগ্রত একনিষ্ঠতা দেখে। আদিবাসী সাঁওতালদের খাদ্যাভাসের বিভিন্ন ধরনের পরিচয় দিয়েছেন পীযূষকান্তি সরকার। কঠিন জাতীয় খাদ্যের মধ্যে ভাত, শাকসবজি, ডাল, ফলমূল ইত্যাদি। বনজ খাদ্যের মধ্যে গাছের শিকড়-বাকড়, কাণ্ড-শাকপাতা এবং বিভিন্ন ফলমূলের উল্লেখ আছে। ভুট্টাকেও এরা প্রধান খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে থাকে। এছাড়া বিভিন্ন পিঠা, মুড়ি চিঁড়া এদের খাদ্য হিসেবে জনপ্রিয়।

আমিষ খাদ্যের মধ্যে শুকুর, ইঁদুর, ব্যাঙ, শিয়াল, বাঘ-ভালুক এবং পাখিও খুব প্রিয়। এছাড়া পিঁপড়ে ও পিঁপড়ের ডিম এরা খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে। তরল জাতীয় খাদ্যের মধ্যে বিভিন্ন প্রকার মাদক দ্রব্য এরা সেবন করে। এদের বাড়ি-ঘর নির্মাণ কৌশল ও গৃহসামগ্রী এবং বর্তমানে পরিবর্তনের ধারার কথাও লেখক উল্লেখ করেছেন। তাদের পোশাক পরিচ্ছদসহ উৎসব, সৌন্দর্য ভাবনা, বিবাহ সম্পর্ক এবং সেইসঙ্গে সাঁওতালি পরিভাষার এসবের নামকরণগুলিও যথাযথ উল্লেখ করেছেন। সুব্রত মুখোপাধ্যায় সীমান্ত বাংলার লোধা-শবর নামক জনজাতির জীবনবীক্ষা তুলে ধরেছেন। ‘লুব্ধক’ থেকে ‘লোধা’ শব্দটি এসেছে। এর অর্থ হলো ‘শিকারি’।

লোধারা আসলেই শিকারিজীবী। ‘শবর’ শব্দটি সংস্কৃত ‘শব’ শব্দ থেকে এসেছে। তবে ক্যানিংহাম মনে করেন ‘শক’ শব্দ থেকে সগরিস—যা কুড়ুলের দ্যোতক, ‘সগর’>’শভর’>’শবর’ শব্দের উৎপত্তি। ‘কুঠার মানুষ’ হিসেবেই অধিক পরিচিত। তাই আজও এদের সঙ্গে কুঠার থাকে। এদের আহার-বাসস্থান, অর্থনৈতিক কাজকর্ম, জন্ম-মৃত্যুর ও বিবাহের সঙ্গে নানা লোকাচারের পরিচয় করিয়েছেন। সৌমেন মণ্ডল মুণ্ডা জনজাতির পরিচয় দিয়েছেন। এরা দক্ষিণ এশিয়ার একটি বড় উপজাতি। পশ্চিমবঙ্গের ঝাড়গ্রাম ও বাঁকুড়া জেলায় এদের দেখা যায়।

এরা কুরকুট বা লাল পিঁপড়ে ও পিঁপড়ের ডিম খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে। এছাড়া হেঁড়িয়া নামক মাদকদ্রব্যেও এদের ভক্তি আছে। বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায় বীরহোড়  জনজাতির সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের অনুসন্ধান করেছেন। ‘বীরহোড়’ কথাটির অর্থ হলো জঙ্গলের মানুষ। সাধারণত এরা যাযাবর হয়। এরাও মুণ্ডা শ্রেণিভুক্ত। পশ্চিমবঙ্গে এদের সংখ্যা ২২০০ জন। শিকারই এদের প্রধান জীবিকা। বিভিন্ন বন্যপ্রাণীই এদের খাদ্য তালিকাভুক্ত। বিভিন্ন প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত করে এদের জীবন-জীবিকায় উৎকর্ষ আনার চেষ্টা চলছে, লেখক তারও পরিচয় দিয়েছেন। সুশীলকুমার রাভা  উত্তরবঙ্গের রাভা জনজাতির পরিচয় তুলে ধরেছেন।

এটিও খুব প্রাচীন একটি জনজাতি। এদের ভাষা সংস্কৃতি, জীবনধারা অন্যান্য জনজাতির থেকে আলাদা। তারা নিজেদের ‘কোচ জাতি’ বলে পরিচয় দেয়। এদের স্বতন্ত্র ভাষাকে বলা হয় ‘কোচা-ক্রৌ’ অর্থাৎ কোচ ভাষা। তেমনি সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও ‘কোচা’ শব্দটি লাগানো হয়। এই কোচা শব্দ থেকেই জেলার নাম কোচবিহার। কোচবিহার থেকেই কুচবেহার এসেছে কামরূপী উপভাষার আঞ্চলিক শব্দ হিসেবে। অতীতের ইতিহাস এবং তথ্য এই লেখাটির মূল উপজীব্য বিষয়। রাভাদের নিজস্ব সংস্কৃতি, বনজ সম্পদের ব্যবহার, পোশাক-পরিচ্ছদে আজও ফুটে ওঠে। এই জনজাতির অনেক অজানা তথ্য এই লেখাটিতে জানা যায়।

প্রমোদ নাথ ডুকপা ও লেপচা সম্প্রদায়কে নিয়ে বিস্তৃত পরিচয় দিয়েছেন।ডুকপারা সাধারণত ভুটানের আদিবাসী। তবে তিব্বতি ভাষায় ‘ড্রুকপা’ শব্দটির অপভ্রংশ ‘ডুকপা’। ‘ড্রুক’-এর অর্থ হলো বজ্রদেবতা ‘ড্রাগন’  এবং ‘পা’ শব্দের অর্থ অধিবাসী। আলিপুরদুয়ার জেলার বক্সা পাহাড়ের প্রায় ৯০% মানুষ ‘ডুকপা’। এদের মাতৃভাষার নাম ‘লোকে’। এই ভাষার কোনো লিপি নেই। এই জনগোষ্ঠীই ভুক্ত বা ভুটিয়া নামেও পরিচিত। এরা ভাত,ডাল,গোমাংস, শুকরের মাংস, লাললঙ্কা, বাটা সস খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে। তবে রুটি-মাখন-ভুট্টা-চা খেতেও অভ্যস্ত।

লেপচা সম্প্রদায়ের লোকেরা সাধারণত সিকিম হিমালয়ের আদি বাসিন্দা। কাঞ্চনজঙ্ঘার দুটি শৃঙ্গকে এরা আদিম মানব-মানবীর প্রতীক হিসেবে বিশ্বাস  করে। এরা মূলত মাংসাহারী। প্রায় সব রকম পশুর মাংসই এরা খায়। তবে ভাত-ডাল-গম-বার্লি মারুয়া-মেঞ্চু-মিলেট, মিষ্টি আলু, কচি বাঁশের শেকড় খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে থাকে। অসুর জনজাতি নিয়ে লিখেছেন মনোনীতা চক্রবর্ত। অসুরদের আরেক নাম ‘খেরওয়াল’। তারা যুগযুগ ধরে বিচ্ছিন্ন একটি জনজাতি অথচ এরাই সবচেয়ে প্রাচীন। মহাভারতের সময়কাল থেকেই এদের উপস্থিতি জানা যায়। এদের বীরত্বের বহু কিংবদন্তির কাহিনি প্রাচীন গ্রন্থগুলিতে উল্লেখ আছে।

মহেঞ্জোদারো এবং হরপ্পাতেও অসুরদের অস্তিত্ব ছিল। এদের জীবনযাত্রা, পোশাক-পরিচ্ছদ, খাদ্য সবকিছুরই উল্লেখ করেছেন লেখিকা। বাঙালি জীবনের সঙ্গে ও খাদ্যাভাসের সঙ্গে এদের প্রচুর মিল। মাছ, কচ্ছপ, কাঁকড়া তারা শিকার করত। পাতা, মূল,ফুল-ফল সংগ্রহ করত। এদের ভাষা ছিল মুণ্ডারি। অস্ট্রো-এশিয়াটিক ভাষা। তারা কিন্তু আসুরি বা অসুরি নামেই উল্লেখ করত।

তাদের জীবনের বিভিন্ন গল্প এবং তাদের ইতিহাস, ধর্মকথা, উৎসব কৌতূহলের বিষয়। এমনকী রাজনৈতিক জীবনেরও পরিচয় তুলে ধরেছেন। উদয়শঙ্কর মহান্তি ভূমিজ উপজাতির খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থানের পরিচয় দিয়েছেন। সমাজের অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষেরা এদের মধ্যেই পড়ে। সাধারণত কৃষিকাজকেই এরা প্রধান পেশা হিসেবে গ্রহণ করে বলেই এদের নাম হয় ভূমিজ অর্থাৎ ভূমির সন্তান অর্থাৎ মাটির ছেলে।

মুণ্ডারিদেরই একটি পরিবর্তিত রূপ এদের মধ্যে দেখা যায়। বাংলায় কৃষক এবং ক্ষেতমজুর এরাই। এদের শুভকর্ম উদযাপনে একজন গুণীন বা মোড়ল থাকেন। তার নির্দেশ মতোই পাত্র পাত্রী নির্বাচন, বিবাহ ইত্যাদি অনুষ্ঠিত হয়। বর্তমানে এদের অবস্থার উন্নতি হয়েছে। পর্ণকুটির থেকে পাকা বাড়ি এবং সমাজে আভিজাত্যেরও উত্তরণ ঘটেছে। তবে বর্ণপ্রথার প্রতি এদের বিশ্বাস এখনো অটল।

 গ্রন্থটি আমাদের কাছে একান্তই অবশ্য পাঠ্য, কারণ আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় যে বৈচিত্র্য, যে ভিন্নতা এবং যে অতীত ঐতিহ্য বর্তমান তা কতখানি আমাদের নিজস্ব এবং কতখানি সেগুলির প্রতি আমরা শ্রদ্ধাশীল তা অবশ্যই জানা যায়। আমাদের বিশ্বাস ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধা একই সঙ্গে দেশপ্রেমও এই জনজীবনের সংস্কৃতি এবং অতীতগাথায় খুঁজে পাওয়া যায়।

 প্রত্যেকটি প্রবন্ধই গবেষণালব্ধ বিষয়। খুব সতর্কতার সঙ্গেই এবং আন্তরিকতার সঙ্গেই লেখকগণ তুলে ধরেছেন। সম্পাদনার ক্ষেত্রেও যথার্থ ভূমিকা পালন করে সুবর্ণ রায়ও আমাদের সমীহ আদায় করে নিয়েছেন। 

🌱

 

web to story

বাংলার জনজাতির ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি

 অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের প্রাসঙ্গিকতা: সংকলন ও সম্পাদনা সুবর্ণ রায়, দি সী বুক এজেন্সি, কলকাতা-৭০০০০৭, প্রচ্ছদ-শান্তনু ব্যানার্জি, মূল্য ২০০ টাকা।
(ছবিতে সুবর্ণ রায়) 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *