SOUMYA GHOSH.

STORY AND ARTICLE:

শ্রদ্ধায় বিভূতিভূষণ:
================

১২ই সেপ্টেম্বর বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্মতিথি উপলক্ষে ” Story and Article”-এর শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন :

|| প্রকৃতিপ্রেমিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ||
“”””””””””””””””””””””””””””””””””””””””””””””””””””
সৌম্য ঘোষ
“”””””””””””””””””””””””””””””””””””””””””””””””””””

১৯২২ সালে “প্রবাসী” পত্রিকার ‘মাঘ সংখ্যায়’ প্রকাশিত হয় বিভূতিভূষণের প্রথম গল্প ” উপেক্ষিতা” । গল্পটি পড়ে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় একটি চিঠিতে বিভূতিভূষণকে লেখেন , —— “তোমার গল্পটি বড়ই মনোরম হইয়াছে। রচনা যেমন সুললিত, তেমনি প্রাঞ্জল ।”। বিভূতিভূষণের প্রথম গল্পগ্রন্থ ” মেঘমল্লার”। বিশ- ত্রিশ দশকে বাংলা সাহিত্যের মধ্যগগনে বিরাজ করছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় । তাদের সৃষ্টিতে পাঠককুল মুগ্ধ । সেই সময় ” কল্লোল গোষ্ঠী” বিপরীত ভাবনা ও শৈলী নিয়ে উপস্থিত । ঠিক এমনই সময় দুই বিপরীত ভাবনা ও রীতি র বাইরে গিয়ে সম্পূর্ণ নিজস্ব ভঙ্গিতে মানুষ, প্রকৃতি ও ঐশ্বর ভাবনাকে একত্রিত করে সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে নূতন রীতিতে আবির্ভূত হলেন ——- বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় । সভ্যতা ও সংস্কৃতির এক অস্থির , সংকটময় সময় অবস্থান করেও জগৎ ও জীবনের আনন্দময় রূপকে অনুভব করেছেন তিনি । তিনি বলেছিলেন, ” জীবনকে যারা দুঃখময় বলেছে , তারা জীবনের কিছুই জানেনা । জগৎটাকে দুঃখময় মনে করা নাস্তিকতা । ”
বিভূতিভূষণের আদি বাড়ি উত্তর 24 পরগনার পানিতর গ্রামে । পৈত্রিক বাসস্থান ব্যারাকপুর । মামা বাড়ি নদীয়ার ঘোষপাড়ার মুরাতিপুর গ্রামে জন্ম ।১২ই সেপ্টেম্বর, ১৯৯৪ সালে । পিতা মহানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মাতা মৃণালিনী দেবী । ১৯১৮ সালে শিয়ালদহের রিপন কলেজ ( অধুনা, সুরেন্দ্রনাথ কলেজ) থেকে ডিস্টিংশন নিয়ে বি. এ. পাশ করেন ।
“পথের পাঁচালী” র অমর রূপকার বিভূতিভূষণের রচনায় দৃশ্য, ঘ্রাণ, শ্রুতি, স্বাদ , প্রকৃতি প্রায় প্রতিটি উপযোগই সঘন । চিরায়ত গ্রামীণ জীবনের সঙ্গে প্রকৃতির নিবিড় সংরাগ আর দ্বান্দ্বিক সৌন্দর্য ও রসবোধ পাঠককুলকে মুগ্ধ করে । জীবনের মূল ধারাকেই বিভূতিভূষণ তাঁর রচনাকর্মের আধার হিসেবে বিবেচনা করেছেন । প্রকৃতির সৌন্দর্য এবং গ্রাম বাংলার সাধারণ মানুষের জীবন চারণের সজীব নিখুঁত চিত্র তাঁর কথাশিল্পে পাই ।
সাহিত্য সমালোচকগণ বলছেন, বিভূতিভূষণ যে মানবজগৎ সৃষ্টি করেছিলেন তা সারল্যে অসাধারণ। সনাতন গ্রামবাংলার জনজীবনের চিরায়ত ছবি তিনি এঁকেছেন নিপুণ, দক্ষ শিল্পকুশলতায়। গভীর মমতায়, শ্রমে তিনি এই কীর্তি স্থাপন করে গেছেন। কথাশিল্পী হিসেবে আশ্চর্যরকম সফল তিনি। গ্রামীণ জীবনের শান্ত, সরল, স্নিগ্ধ ও বিশ্বস্ত ছবি ফুটে ওঠে তাঁর নিরাসক্ত কথকতা ও বয়ানে, চুম্বকের মতো টেনে নেয় পাঠককে। মুগ্ধ করে, বিস্মিত করে। অথচ পথের পাঁচালী, অপরাজিত, আরণ্যক, ইছামতির মতো অসামান্য সব উপন্যাসের রচয়িতা বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখালেখির জীবন ছিল স্বল্প। মাত্র আঠাশ বছর। এই লেখকের আয়ু ছিল মাত্র ৫৬ বছর। তাঁর রচনাসম্ভারের মধ্যে রয়েছে ১৫টি উপন্যাস, সাতখানা কিশোর উপন্যাস, দুইশ’র বেশি ছোটগল্প। পনেরোটি উপন্যাসের মধ্যে একটি ছিল অসমাপ্ত। শিশু-কিশোর উপন্যাসের মধ্যে তিনটি হলো বয়স্কপাঠ্য উপন্যাসের কিশোর সংস্করণ। এসবের বাইরে অন্যান্য বিষয়েও তিনি লিখে গেছেন। সেগুলোর সংখ্যা নিতান্ত কম নয়। তার মধ্যে রয়েছে ভ্রমণকাহিনী, ডায়েরি, প্রবন্ধ, অনুবাদ। ব্যাকরণ বইও তিনি লিখেছেন। উপন্যাস ও ছোটগল্প, ভ্রমণ-দিনলিপি এবং কিশোরদের উপযোগী রচনা-গদ্য সাহিত্যে এ চারটি কীর্তিস্তম্ভের ওপর বিভূতিভূষণের সাহিত্যিক কৃতিত্ব। এ চারটি কিন্তু একে অপরের থেকে কোনো অর্থেই ভিন্ন নয়। সুরে, বিষয়-নির্বাচনে, প্রশান্ত চিত্তের সহৃদয়তায় এগুলো যেমন সরস তেমনি জীবনরসে পূর্ণ। বিভূতিভূষণের অস্তিত্ব জুড়ে আমৃত্যু-প্রথম আবির্ভাবের পর থেকে শ্রীমান অপু বিরাজিত। তার বিস্ময়ভরা দৃষ্টি দিয়ে বিভূতিভূষণ চারপাশের মানুষকে, প্রকৃতিকে দেখছেন এবং আনন্দিত হয়েছেন। সুখে দুঃখে তার সমান আনন্দ, কারণ বালকের মন সহজে দুঃখের স্মৃতি ভুলে যায়। অভাব-অভিযোগের মধ্যেও একটা সুখের কল্পরাজ্য তৈরি করে নেয়। আবার, বিভূতিভূষণের শিল্পী ব্যক্তিত্বের পরিচয় নিতে গেলে আরো একটি দিকে লক্ষ্য না করে পারা যায় না। একদিকে একান্ত লৌকিক জীবন অতিসাধারণ ও প্রাত্যহিক, পরিচিত প্রকৃতি, বাস্তব অরণ্য-যার ভূগোল আছে, অন্যদিকে আছে অলৌকিক, অতি প্রাকৃতের প্রতি আকর্ষণ। তিনি একালের শিল্পী হয়েও ধর্মে আস্থাবান ছিলেন এবং পরলোক, জ্যোতিষবিদ্যা, মৃত্যুর পরবর্তী অস্তিত্ব এবং অন্যান্য বিবিধ অতিপ্রাকৃতে বিশ্বাস করতেন। এর কারণ হিসেবে তার জীবনী থেকে জানা যায়, যখন ছাত্র ছিলেন, তখন তেইশ বছর বয়সে বিয়ে করেন। বিয়ের বছরখানেক বাদে স্ত্রী গৌরী মারা গেলেন নিউমোনিয়ায়। এর কিছুদিনের মধ্যেই ছোট বোন মণির মৃত্যু ঘটে সন্তান প্রসব করতে গিয়ে। এই দু’টি মর্মান্তিক ঘটনায় তিনি মারাত্মক আঘাত পেলেন মনে। ধারণা করা হয়, তাঁর পরলোকে বিশ্বাস, পরলোকতত্ত্ব বিষয়ে পড়াশোনা এবং চর্চার কারণ ওই দু’টি বিয়োগান্তক ঘটনা। প্রথমা স্ত্রীর মৃত্যুর দীর্ঘ ২২ বছর পরে আবার বিয়ে করেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়।
আপাদমস্তক একজন প্রকৃতিপ্রেমিক। তিনি অরণ্য-জঙ্গল-ঝোপঝাড়ের গাছ-গাছালির মধুর সৌন্দর্য শুধু নিজেই বিমুগ্ধ হয়ে উপভোগ করেননি, পাঠকদের কাছেও সেই সুন্দর মনোহর রূপটি তুলে ধরেছেন। তার উপন্যাস পড়ার পর পাঠক এতটাই অভিভূত ও তৃপ্ত হন যে বিভূতিভূষণের বর্ণিত অপরূপ ছবি নিজের চোখে না দেখলেও তা জীবন্ত হয়ে তাদের মনের পর্দায় ভেসে থাকে। এ কথা যেমন ‘পথের পাঁচালী’র বেলায় সত্য তেমনি সত্য ‘আরণ্যক’ বা ‘ইছামতী’র বেলায়ও। ‘পথের পাঁচালী’ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনন্য কীর্তি। বিশ্বনন্দিত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় এটির চলচ্চিত্রায়ন করেন। ফলে এই উপন্যাসের খ্যাতির পরিধি বহির্বিশ্বেও ছড়িয়ে পড়ে। বিভূতিভূষণ সাহিত্য অঙ্গনে প্রবেশ করেন এই উপন্যাসটির মধ্য দিয়েই। এটিই তাঁর প্রথম উপন্যাস, একই সঙ্গে প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থও। পথের পাঁচালী প্রথমে ধারাবাহিকভাবে বের হয়েছিল মাসিকপত্র ‘বিচিত্রা’য়। এক বছরেরও বেশি সময় লেগেছিল এতে। বই আকারে এটি বের হয় ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে, ১৩৩৬ বঙ্গাব্দের আশ্বিন মাসে। এ বই বেরুবার আগে সাময়িকপত্রে এই লেখকের কয়েকটি ছোটগল্প প্রকাশিত হয়। লেখক হিসেবে সামান্য পরিচিতি ছিল তখন। সেই সময় এ বিশাল আয়তন উপন্যাসের প্রকাশক জোগাড় করার কাজটি সহজ ছিল না। ঝুঁকি নিয়ে এ দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছিলেন সজনীকান্ত দাস। তার নিজস্ব কোনো প্রকাশনা সংস্থা ছিল না। শুধু এ বইটা বের করার জন্যই তিনি ‘রঞ্জন প্রকাশালয়’ প্রতিষ্ঠা করেন। ‘পথের পাঁচালী’ বই হিসেবে বেরুবার আগেই বিচিত্রা পত্রিকায় এর বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হতে থাকে। সেই বিজ্ঞাপনে বলা হয়, বইটির দাম রাখা হবে তিন টাকা। বিজ্ঞাপন ছিল এরকম : “শ্রীবিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রণীত বাঙলা ভাষায় সম্পূর্ণ নূতন ধরনের উপন্যাস। শিশুমনের দুর্জ্ঞেয় রহস্য ইতিপূর্বে আর কেহ এদেশে এরূপভাবে উদ্ঘাটিত করেন নাই; অন্য দেশেও কেহ করিয়াছেন কি না আমাদের জানা নাই। উপন্যাসখানি ‘বিচিত্রা’য় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হইতেছে। ইতিমধ্যেই সাহিত্য-রসিক মহলে ইহার সম্বন্ধে বিস্তর আলোচনা হইয়াছে।”রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাস সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন যে, ‘বইখানা দাঁড়িয়ে আছে আপন সত্যের জোরে।’
অরুণকুমার মুখোপাধ্যায় বলেন, “বিভূতিভূষণ কেবল মাটি ও সাধারণ মানুষের শিল্পী নন , আকাশভরা আনন্দলোক ও ঐশী মহিমার রূপকার । ” প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও গবেষক অধ্যাপক সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন,
“কেউ কেউ আছেন যিনি তুচ্ছ কে মহৎ করে তোলেন, বিভূতিভূষণ শেষ শ্রেণীর লেখক । তাঁর কাছে কিছুই তুচ্ছ নয় ——— তিনি যা কিছু দেখেছেন তার সবই পূর্ণ ।”

তাঁর কালজয়ী উপন্যাস, যেমন, পথের পাঁচালী (১৯২৯), অপরাজিত (১৯৩২) , আরণ্যক (১৯৩৯) , আদর্শ হিন্দু হোটেল (১৯৪০) , ইছামতী ( ১৯৫০) , অশনি সংকেত ( ১৯৫৯) ইত্যাদি ইত্যাদি । শিশুসাহিত্য ” চাঁদের পাহাড় (১৯৩৭) বহুল জনপ্রিয় । তাই ভ্রমণ কাহিনী ” অভিযাত্রিক ( ১৯৪১) স্মরণীয়। কারো কারো মতে, রোমাঁ রোলাঁ র ” Jean Christophe” – এর সঙ্গে “পথের পাঁচালী”র সাদৃশ্য আছে। “ইছামতী” উপন্যাসের জন্য তিনি মরণোত্তর রবীন্দ্র পুরস্কার পান (১৯৫১)।

১লা নভেম্বর, ১৯৫০ সালে বাংলার প্রকৃতি প্রেমিক কথা সাহিত্যিকের জীবনাবসান হয়।।
=========================

___ সৌম্য ঘোষ। চুঁচুড়া। পশ্চিমবঙ্গ।

(অনুরোধ: এই লেখার সঙ্গে বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের একটি ফোটো যুক্ত করলে খুব ভালো হয়।)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *