SOUMYA GHOSH.

STORY AND ARTICLE
———————————–

মণীশ ঘটকের কবিতা
=====================
সৌম্য ঘোষ
=====================

নদীমাত্রেরই একটি সাধারণ অভিযোগ থাকে; সেই অভিমুখ হলো সমুদ্র। তেমনই কবি মাত্রেরই একটি সাধারণ আকাঙ্ক্ষা থাকে —- কাব্যরস সৃষ্টি। কাব্যরস অর্থাৎ নন্দন অর্থাৎ আনন্দ সৃষ্টি করা। কবিতা, তা যে একালের হোক না কেন, তাতে ভাব, ভাষা, আঙ্গিক, প্রকরণ ইত্যাদিতে যতই নতুনত্ব সৃজন করা হোক না কেন, কবিতাকে কোনদিন রসহীন করে পরিবেশন করা যায় না।
কল্লোল যুগেও যখন কাব্যে রোমান্টিক চিন্তা ও ভাষাকে পরিহার করে কঠোর নৈরাশ্যবাদী জীবন বাস্তবতার মধ্যে কবিতার উপাদানের সন্ধান করার চেষ্টা হত, যখন কবি লেখেন —–

“এই যুগের চাঁদ হ’ল কাস্তে”

তখনও কিন্তু তারা কবিতাই লিখেছেন।
সোভিয়েত রাশিয়ার সাহিত্যে জীবন বাস্তবতাকে যদি গ্রহণযোগ্য করে থাকেন গোর্কি, তবে সে শুধু তার অপরিমেয় বেদনাবোধ, তার জীবন জিজ্ঞাসার জন্য। গোর্কির হৃদয়ে সাহিত্য সৃষ্টির প্রেরণার সঙ্গে জীবনবোধের গভীরতার সমবায় ঘটেছিল। বাংলা কাব্য সাহিত্যে মণীশ ঘটকের মনন ও চিন্তনে ম্যাক্সিম গোর্কির প্রভাব প্রত্যক্ষ।
কবি মণীশ ঘটকের পূর্বসূরী
“পটলডাঙ্গার পাঁচালী”র স্রষ্টা যুবনাশ্ব। তাই যুবনাশ্বের মানসিকতা এবং অভিজ্ঞতা কবি মণীশ ঘটকের
জীবনকে নিয়ন্ত্রিত করেছিল। কল্লোল যুগের কবিদের মধ্যে একটি সাধারণ সাদৃশ্যতা ছিল, বাস্তববাদী হওয়ার প্রবল আকাঙ্ক্ষা। তাই আমরা পড়ি —-

“আমি কবি যত কামারের আর
কাঁসারি আর ছুতোরের…..”

এই বাস্তববাদী হওয়ার নিদর্শন স্বরূপ তারা জীবনকে এক নতুন অভিধায় গড়ে তুললেন। গ্রহণ করলেন তার দারিদ্র, দুঃখ যন্ত্রণা সঙ্গে নগ্নতার স্বরূপ। জীবনকে এক দ্বিধাহীন বোহেমিয়ান উৎশৃঙ্খলা তাই তাদের কাম্য বলে মনে হয়েছে।
কবি মণীশ ঘটক কল্লোল যুগের কবি। যিনি নজরুল, যতীন্দ্রনাথ, মোহিতলালের উত্তর পর্বে এবং সমর সেন, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের পূর্ব অধ্যায়ে বাংলা কাব্যে রিয়ালিজমের ধারাকে প্রবাহিত করতে পেরেছিলেন।
১৩৪৬-এর মাঝামাঝি সময়ে প্রকাশ হয়েছিল তার প্রথম কবিতা গ্রন্থ “শিলালিপি”। এই গ্রন্থে আছে তার কবিতা —- ‘পরমা’।

“ভাঙাও ঘুম ভাঙাও
কুহক কাহিল মৃত্যু থেকে সেই জানোয়ারদের
বেয়াল্লিশ হাজার জানোয়ারদের।
জ্বলুক তাদের চোখে
তাজা ইস্পাতের নীল ঝলক,
শিউরে উঠুক বর্বর অত্যাচার।”
( ‘দোস্ত, তাদের জাগাও’)

‘পরমা’ কবিতায় লিখলেন—-

“পূর্ণলোহু যৌবনের মধ্যাহ্ন ভাস্কর
সেদিন জ্বলিতেছিল এদেহো অম্বরে।”

তার পরবর্তী কবিতাগ্রন্থ “যদিও সন্ধ্যা” প্রকাশিত হয় ১৯৬৮ সালে। অর্থাৎ দীর্ঘ ২৮ বছর পর। ১৯৭০ সালে “বিদূষী বাক”। ১৯৭৪
সালে পাবলো নেরুদা থেকে অনুবাদ করা কবিতা সংকলন।
মণীশ ঘটক আধুনিক ও বাস্তববাদী হয়েও কবিতার ঐতিহ্য থেকে বিচ্যুত নন। যিনি সমকালীন বিশ্বের সাম্যবাদী সাহিত্যের মর্ম উদঘাটন করে তার সাহিত্যাদর্শ গ্রহণ করেছেন, তিনি বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির অন্তর যন্ত্রণাকে কোনদিন ভুলে থাকতে পারেননি। তাই তিনি পুরোপুরি বাঙালি কবি।

যৌবনের উগ্রতা তার জীবনের শেষ পর্বে এক শান্ত জিজ্ঞাসা বহন করে ফিরে আসে। “বিদূষীবাক” গ্রন্থে তিনি প্রাচীন “হিন্দু পুরাণ”- এর যুগে ফিরে গিয়েছেন। গ্রন্থের সংবেদন গুলি দেবী চণ্ডীর উদ্দেশ্যে রচিত। কোথাও প্রার্থনা, কোথাও প্রশস্তি! জীবনের বহু বিচিত্র অভিজ্ঞতা ও অনুভূতির মধ্যে থেকে নিজেকে একক চিন্তার গভীরে সমাহিত করেছেন।

“স্পন্দনময়ী বসুধা লভিছে শক্তি
রূপে রসে গানে মনোলোভা অভিব্যক্তি
পরমাপ্রকৃতি ত্রিবিধ গুণের সাম্য
ইন্দ্রিয়াতীত পরাবাক্ তার কাম্য।”

এক ধ্রুপদী সত্যের অনুভবে কবির হৃদয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে। তার সংবেদন—
“আমি সচ্চিদানন্দ আমি দেহাতীত
একাদশ রুদ্ররূপে হই কালান্তক
অষ্টবসু হয়ে করি সাধাকে অন্বিত।”

আবার কখনও তার কাছ থেকে আমরা পাই —-

“পরা প্রকৃতির দেবী সত্বগুণবতী
হৃদারূঢ়া জ্ঞানময়ী মহা সরস্বতী…”

যৌবনের উত্তপ্ত মণীশ ফিরে গেছেন হিন্দুত্বের চিরন্তন বোধে।‌ তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন —- ‘এই সংবেদনগুলি তার অনুভূতিজাত’।
অচিন্ত্যকুমার, নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ, বুদ্ধদেব বসুর মতোই তার চেতনায় ঐতিহ্য ফিরে এসেছে। জীবন সীমায় এসে তিনি স্থির ও ধ্যানময়; এক জীবনসন্ধানী পুরুষ।।

“”””””””””””””””””””””””””””””””””””””””””””””””””””
লেখক ••• সৌম্য ঘোষ। চুঁচুড়া। পশ্চিমবঙ্গ।

 

 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *