এরিস্টটল
(খ্রি:পূ: ৩৮৪ – খ্রি:পূ: ৩২২)
“””””””””””””””””””””””””””””””””””””””””””””
সৌম্য ঘোষ
“””””””””””””””””””””””””””””
বিশ্ববিখ্যাত গ্রীক বিজ্ঞানী ও
দার্শনিক। তাঁকে ‘প্রাণিবিজ্ঞানের জনক’ বলা হয়। প্লেটোর সাথে যৌথভাবে তাঁকে “পশ্চিমা দর্শনের জনক” বলে অভিহিত করা হয়।
এরিস্টটল— সক্রেটিস ও প্লেটোর দর্শনসহ তাঁর পূর্বের সময়ের বিদ্যমান বিভিন্ন দর্শনের জটিল ও সদৃশ সমন্বয় দেখান।
এরিস্টটলের ভাবগুরু ছিলেন
পারমেনাইডিস, সক্রেটিস, প্লেটো,
হেরাক্লিটাস।
এরিস্টটলের ভাবশিষ্য ছিলেন:
মহামতি আলেকজান্ডার, আল ফারাবি, ইবন সিনা, ইবনে রুশদ, অ্যালবার্টাস ম্যাগনাস, মাইমোনাইডিস কোপারনিকাস, গ্যালিলিও গ্যালিলি, টলেমি, সেন্ট টমাস একুইনাস, Ayn Rand প্রভৃতি।
তাঁর লেখনীতে পদার্থবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান, প্রাণিবিজ্ঞান,অধিবিদ্যাযুক্তিবিদ্যা, নীতিশাস্ত্র, নন্দনতত্ত্ব,
কবিতা, মঞ্চ-নাটক, সঙ্গীত,
মনোবিজ্ঞান, ভাষা
বিজ্ঞান, অর্থনীতি, রাজনীতি ও
সরকার নিয়ে আলোচনা রয়েছে। যা নিয়ে পশ্চিমা দর্শনের প্রথম বুদ্ধিবৃত্তিক ব্যবস্থা গঠিত।
এরিস্টটল খ্রি: পূ: ৩৮৪ সালে থারেস উপকুলবর্তী স্টাগিরাস নামক এক গ্রীক উপনিবেশে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতা নিকোম্যাকাস মেসিডোনিয়ার রাজা আমিন্টাসের রাজসভায় চিকিৎসক ছিলেন। জীবনের শুরু থেকেই মেসিডোনিয়ার রাজসভায় সাথে সম্পর্ক থাকা, তাঁর ভবিষ্যৎকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিল।
শৈশবে তাঁর বাবা মারা যান এবং ১৭ বছর বয়সে তাঁর অভিভাবক প্রোক্সেনাস তাঁকে এথেন্সে জ্ঞানার্জনে পাঠিয়ে দেন। এথেন্স তখন বিশ্বে জ্ঞান চর্চার কেন্দ্র হিসেবে গণ্য হত। সেখানে তিনি প্লেটোর একাডেমিতে সরাসরি প্লেটোর অধীনে প্রায় বিশ বছর শিক্ষা গ্রহণ করেন। একসময় প্লেটো ও তাঁর একাডেমিতে থাকাকালেই তিনি নিজেই ভাষাত্বত্ত নিয়ে লেকচার দিতে শুরু করেন। খ্রিষ্টপূর্ব ৩৪৭ সালে প্লেটোর মৃত্যুর পর এরিস্টটলই একাডেমির প্রধান হবার যোগ্য ছিলেন। কিন্তু প্লেটোর দর্শনের সাথে এরিস্টটলের নিজের দর্শনের দূরত্বের দরুন প্লেটোর আত্মীয় Speusippus কেই একাডেমির প্রধান হিসেবে বেছে নেওয়া হয়। এরপর অ্যাটারনিয়াসের শাসক হারমিয়াসের আমন্ত্রণে এরিস্টটল সেখানে যান। তিনি সেখানে তিন বছর থাকেন এবং রাজার ভগ্নি পিথিয়াসকে বিয়ে করেন। পরবর্তী জীবনে তিনি আর একজন নারী হারপিলিসকে বিয়ে করেন এবং তাঁদের এক পুত্র সন্তান জন্ম হয়, যার নাম রাখা হয় নিকোম্যাকাস। তিন বছর সেখানে থাকার পর অ্যাটারনিয়াস পারস্য সম্রাট দখল করে নেয় এবং
এরিস্টটল মাইটিলেনি চলে যান। পরবর্তী পাঁচ বছর এরিস্টটল মেসিডোনিয়ার রাজা ফিলিপের ১৩ বছরের পুত্র আলেকজান্ডারের (পরবর্তীকালে ‘আলেকজান্ডার দ্য গ্ৰেট’) শিক্ষকতা করেন। রাজা ফিলিপ এবং আলেকজান্ডার উভয়েই এরিস্টটলকে পরম শ্রদ্ধা করতেন।
ফিলিপের মৃত্যুর পর আলেকজান্ডার রাজ্যের শাসনভার গ্রহণ করেন এবং এরিস্টটল এথেন্স ফিরে যান। প্লেটোর মৃত্যুর পর তিনি এবারই প্রথম এথেন্স আসেন। এথেন্সে এসে তিনি দেখলেন প্লেটোর একাডেমিতে প্লেটোনিজমের ব্যাপক প্রসার ঘটেছে এবং এথেন্সে এখন প্লেটোনিজমের প্রধান দর্শন। ফলে তিনি লাইসিয়াম নামক এলাকায় নিজের স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তী তের বছর তিনি শিক্ষকতা ও তাঁর দর্শন প্রচার করে কাটান। তিনি দিনে তাঁর ঘনিষ্ঠ ছাত্রদের জন্য এবং রাতে এথেন্সের সাধারণ জ্ঞানপিপাসু জনগণের জন্য বক্তৃতা দিতেন। খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৩-এ আলেকজান্ডারের অকাল মৃত্যুতে এথেন্সের মেসিডোনিয়া পূর্ব সরকারকে উৎখাত করা হয়। তখন এরিস্টটলের উপর ধর্মীয় বিশ্বাসহানিতার অভিযোগ আনা হয়। শাস্তি থেকে রক্ষা পাবার জন্য দ্রুত ইউবোয়ার ক্যালসিসে চলে যান। তিনি ভয় করছিলেন তার অবস্থাও যেন প্লেটোর শিক্ষক সক্রেটিসের মত না হয়। ক্যালসিসে প্রথম বছরই তিনি পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হন এবং খ্রি: পূ: ৩২২ সালে মৃত্যু বরণ করেন।
প্লেটো বলেছিলেন, ”ভাল রাষ্ট্র গড়তে হলে ভাল নাগরিক চাই।” ভাল নাগরিক পাওয়ার ব্যাপারটা ভবিতব্যের ওপর ছেড়ে দিলে চলবে না। ভাল শিক্ষা দিয়ে ভাল নাগরিক তৈরি করতে হবে এবং সে দায়িত্ব রাষ্ট্রের। সে জন্যই তিনি তাঁর রাষ্ট্র বিষয়ক গ্রন্থ ‘রিপাবলিক’-এর একটা বড়সড় অংশ নিয়োজিত করেছেন শিক্ষা বিষয়ক আলোচনায়, যেখানে তিনি সুশিক্ষিত নাগরিক তৈরীর এক অনুপম পরিকল্পনা উপস্থাপন করেছেন।
প্লেটো ভাববাদী দার্শনিক এবং এরিস্টটল বাস্তববাদী। কিন্তু শিক্ষা দর্শনের ক্ষেত্রে উভয়েই যুক্তিবাদী এবং বলা যায়, এরিস্টটলের শিক্ষাদর্শন প্লেটোর শিক্ষাদর্শনেরই একটি উন্নত সংস্করণ। ফলে পরবর্তীকালের ভাববাদী ও বাস্তববাদী শিক্ষাদর্শনের বক্তব্যে প্রচুর সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। বিশেষ করে শিক্ষার মূল লক্ষ্য নির্ধারণে। শিক্ষাদর্শনের ক্ষেত্রে প্লেটোর অবদান সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে আঠারো শতকের দার্শনিক জ্যাঁ জ্যাকস রুশো যা বলেছেন তা প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলছেন, ‘’তুমি যদি জানতে চাও নাগরিক শিক্ষা কাকে বলে তাহলে প্লেটোর রিপাবলিক পড়।”
~~~~:–
ব্যক্তিগত কিছু প্রশ্ন এই প্রবন্ধের শেষাংশে উত্থাপন করছি। আমার প্রবন্ধের পাঠক-গুণীজন এই বর্ধিত অংশের জন্য আমাকে দায়ী করে নানাবিধ প্রশ্ন-বাণ ছুঁড়তেই পারেন, সেটাই আমার অভিলাষ।
আমরা বোধহয় একথা বলতে পারি, শিক্ষাদর্শনের ক্ষেত্রে প্লেটো, এরিস্টটলের কালের অবস্থান থেকে আমরা খুব একটা অন্য রকম কোন অবস্থানে এসে পৌঁছাইনি। এবারে প্রশ্ন জাগতে পারে, তাহলে গত আড়াই হাজার বছর ধরে এত দার্শনিকের শিক্ষা নিয়ে এত কথা বলার কি দরকার ছিল?
মানুষ হিসাবে কতকগুলো সাধারণ বৈশিষ্ট্যের জন্য এক মানুষের সঙ্গে অন্য মানুষের মিল আছে। আবার অমিলও প্রচুর। ঐসব বৈশিষ্ট্যের জন্যই আমরা প্রাণীজগতের অন্যান্য সদস্যের থেকে ভিন্নতর। কিন্তু আবার প্রত্যেকটি মানুষই অন্য আরেকজন মানুষ থেকে আলাদা। আপন ভাই বোনের মধ্যেও চরিত্রগত ও আকারগত প্রচুর পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। এই ব্যক্তি স্বাতন্ত্রের জন্যই জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণে বিভিন্নতা দেখা যায়। জীবনের লক্ষ্যের সঙ্গে শিক্ষার লক্ষ্য অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। সেইজন্যই স্থান-কাল-পাত্রের পরিবর্তনের সঙ্গে পরিবর্তিত হয় শিক্ষার দর্শন, সেই জন্যই আড়াই হাজার বছর আগে বিনির্মিত প্লেটো- এরিস্টটলের শিক্ষাদর্শন অনুপম হলেও পরবর্তী কোন কালেই তা পুরোপুরি বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। বিভিন্ন যুগের বিভিন্ন দেশের মনীষীরা তাঁদের নিজেদের পরিমন্ডলের প্রয়োজন অনুযায়ী, নিজেদের মন-মানসের সংগঠন অনুযায়ী শিক্ষাদর্শন বিনির্মাণে সচেষ্ট থেকেছেন। এ প্রচেষ্টায় তাঁরা অবশ্যই পূর্বসূরীদের চিন্তাচেতনার সাহায্য গ্রহণ করেছেন। প্লেটো ও এরিস্টটলও তা করেছিলেন।
আমাদের দেশে আমরা সাধারণত: যে সব মতবাদ নিয়ে আলোচনা করি এবং যেসব মতবাদ দ্বারা অনুপ্রাণিত হই তার প্রায় সবই পাশ্চাত্যের দর্শন। কিন্তু এ কথা অনস্বীকার্য যে জীবনযাত্রার প্রণালী ও আদর্শের দিক দিয়ে প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের মাঝে বেশ কিছু অমিল রয়েছে। তাই প্রাচ্যের একটি দেশ হিসাবে আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে প্রতীচ্যের শিক্ষাদর্শনকে পুরোপুরি খাপ খাওয়ানো সম্ভব নয়, সমীচীনও নয়। এ কথা আমাদের পূর্বসূরী চিন্তাশীল ব্যক্তিগণ ভালোই বুঝেছিলেন। তাঁরা তাঁদের চিন্তার স্বাক্ষরও রেখেছেন নানান কর্মে, নানা বক্তব্যে। শিক্ষা ক্ষেত্রে আমাদের চলাকে স্বচ্ছন্দ করতে প্রাচ্যের সেই সব মননের স্বরূপ উদঘাটন করা একান্ত প্রয়োজন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষাদর্শন নিয়ে আলোচনায় রবীন্দ্রনাথকে বলা হয় ‘ভাববাদী দার্শনিক’। কিন্তু শিক্ষাদর্শনের ক্ষেত্রে তাঁকে যে কেবল আকাশচারী ভাবালুতার উপস্থাপক বলা যায় না বরং বলা যায় আধুনিক সমন্বয়বাদের পৃষ্ঠপোষক।
উল্লেখ করা যায়, বেগম রোকেয়া সাখাওয়াতের শিক্ষাদর্শন। বেগম রোকেয়ার কর্মকাণ্ডের মূল ক্ষেত্র ছিল নারীর উন্নয়ন এবং তার মাধ্যমে সমাজের সংস্কার। সে জন্য যে সুশিক্ষার প্রয়োজন তার সম্যক উপলব্ধি তাঁর ছিল। এ উপলব্ধির লিখিত প্রকাশ রয়েছে তাঁর নানান রচনায়। সেগুলো পর্যালোচনা করে তার সাথে বিভিন্ন পাশ্চাত্য শিক্ষা দার্শনিকের মতামতের তুলনা করে রোকেয়ার শিক্ষাদর্শনের গুরুত্ব নিরূপণ করার প্রচেষ্টা করা জরুরী বলে এই প্রাবন্ধিক মনে করে।
‘ভাল রাষ্ট্র গড়ার জন্য ভাল নাগরিক গড়া’ —— এই লক্ষ্য থেকে আমরা যেন ক্রমশ বিচ্যুত হয়ে চলেছি।।
=========================
লেখক …. সৌম্য ঘোষ। চুঁচুড়া।
পশ্চিমবঙ্গ।
_______________________________