Somnath Benia

প্রবহমান জীবনের প্রত্যয়ভূমি রচনা

তৈমুর খান

‘উক্তি শ্রীবাস্তব'(প্রথম প্রকাশ ২০২০) সোমনাথ বেনিয়ার পঞ্চম কাব্যগ্রন্থ। সোমনাথ বাংলা কবিতায় ভিন্ন পথের অনুসারী হিসেবেই নিজেকে তুলে ধরতে পেরেছে। শূন্য দশকের যে কজন কবিকে আমরা আলাদা করে চিহ্নিত করতে পারি তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন সোমনাথ। ‘উক্তি শ্রীবাস্তব’ কাব্য গ্রন্থটিতে তিনি অ্যাবসার্ডবাদ এবং অ্যাবস্ট্রাক্টবাদের সমন্বয় ঘটিয়েছেন। যার ফলে বিশৃংখল জীবনের দিশেহারা ক্ষুব্ধ হতাশ নিরুপায় অন্তর্জীবনের প্রকাশ ঘটেছে। তাঁর এই ভাবনার সঙ্গে আলবার্ট কামু, স্যামুয়েল বেকেটের ছায়াও লক্ষ করা যায়। বিশেষ করে ফরাসি নাটক ‘ওয়েটিং ফর গোডো’ এবং আয়োনেস্কোর ‘রাইনোসেরা’ ও ‘দ্য চেয়ারস্’ নাটকের উদ্ভট দৃশ্যগুলি কবিতার পংক্তি বিন্যাসে প্রভাব বিস্তার করেছে। তেমনি বিমূর্তবাদে কবির ব্যক্তি অনুভূতির কণ্ঠস্বরটিই বড় হয়ে ওঠে। সেখানেই তাঁর উপলব্ধিই সত্য। তাই ভি. ই. শোয়াব বলেছেন

বলেছেন :”Abstracts, mostly Nonsense art, my friend Jake calls it. But it’s not really nonsense, it’s just—other people paint what they see. I paint what I feel. Maybe it’s confusing, swapping one sense for another, but there’s beauty in the transmutation.”

(V.E. Schwab, The Invisible Life of Addie LaRue)

অর্থাৎ বিমূর্ত, বেশিরভাগই ননসেন্স আর্ট, আমার বন্ধু জেক এটাকে বলে। কিন্তু এটা আসলেই আজেবাজে কিছু নয়, এটা ঠিক—অন্য লোকেরা যা দেখে তাই আঁকে। আমি যা অনুভব করি তা আঁকি। হতে পারে এটি বিভ্রান্তিকর, একটি ইন্দ্রিয়কে অন্যটির জন্য অদলবদল করে, তবে রূপান্তরের মধ্যে সৌন্দর্য রয়েছে।

ননসেন্স আর্ট এই গ্রন্থের কবিতাকেও মনে হতে পারে। মনে হতে পারে বিভ্রান্তিকর,অসামঞ্জস্য, অসঙ্গতিপূর্ণ, এলোমেলো ও বিচ্ছিরি। কখনো তা নগ্ন বাস্তবের মুখাপেক্ষী হতে চেয়েছে।

কাব্যের নামকরণে ‘উক্তি’ শব্দটি প্রয়োগ করে বাস্তবের সঙ্গে ‘শ্রী’ যোগ করেছেন। এই উক্তি আসলে কবির কথন প্রক্রিয়া, অপরদিকে তা নাটকীয় সংলাপের প্রেক্ষণ। বাস্তবের আগে ‘শ্রী’ যোগ করার একমাত্র কারণ হল, তিনি নিজেই সেই বাস্তবের স্রষ্টা। যে বাস্তবকে সবাই চর্মচক্ষে দেখতে পায় না, তা অন্তরালেই থেকে যায়। অথবা যে বাস্তবতাকে কবিই বিনির্মাণ করেন অথবা দেখাতে চান। এই ধারার কাব্য সৃষ্টিকে বলে কিউবিজম। যে সৃষ্টিতে প্রশ্রয় পেল উদ্ভট ও বিমূর্ততা। মানবমনের জটিল স্তরগুলিকে প্রকাশ করতে চাইলেন এর মাধ্যমে। প্যারিসের কিউবিস্ট কবি ম্যাক্স জ্যাকব একটি রচনায় লিখলেন: “Cubism is … a picture for its own sake.

Literary Cubism does the same thing in literature, using reality merely as a means and not as an end.”

(Max Jacob, The Cubist Poets in Paris: An Anthology)

অর্থাৎ কিউবিজম হল… নিজের স্বার্থে একটি ছবি।

সাহিত্য কিউবিজম সাহিত্যে একই কাজ করে, বাস্তবতাকে নিছক একটি উপায় হিসাবে ব্যবহার করে এবং শেষ হিসাবে নয়।

সুতরাং কিউবিজম পাঠক ও কবির মধ্যে একটি সেতু গড়ে তুলতে চায় যার দ্বারা শিল্পীর সৃষ্ট জগতে পৌঁছানো যায়।

শ্রীবাস্তব উক্তিগুলিতে কবির সৃষ্ট বাস্তবতার স্বরূপগুলিতে দৃষ্টি নিক্ষেপ করা যাক।

১,”উক্তি, একদিন মুছে যাওয়ার গল্প শোনাবে

ফিসফিস করে নয়, বরং অসহ্য চিৎকারে”

২,”উক্তি, উইঢিবিকে শালগ্রাম শিলা ভেবো

দেখবে স্পর্শ কতটা আদিম ভালোবাসার প্রচ্ছদে!”

৩,”উক্তি, ঘুমের দেশে ট্যাবলেট হৃদয়ের সাথে কী কথা বলে

প্রিয় সম্বোধনে কোষে জল জমে, শ্যাওলা পড়ে…

তোমার পিছলে যাওয়া পাণ্ডুলিপি রাখা আছে ছায়াপথে”

৪,”দৃষ্টির সাথে দৃশ্যের গেরিলা যুদ্ধ বাঁধে, ফিনফিনে আলো

নেশাতুর অবকাশে তোমার টাইটেল নিয়ে আলোচনা

এক অদ্ভুত রকমের সংগঠনের সামনে দাঁড়ায় নেটিজেন

উক্তি শ্রীবাস্তব বলে কাটাতে চেয়েছি সম্পর্কের

হ্যালুসিনেশনপর্ব”

৫,”উক্তি, বিষাদ আমার কাছে বিষ

নীলকন্ঠ হওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই

কল্কের মধুতে, ধুতরার বীজে পুনর্জন্মের খসড়া রাখতে চাই না”

৬,”ওরা শ্রীবাস্তবের কথা জানে না, জানে না

কোটেশনের ভিতর অতিরিক্ত নিশ্বাস ভয়েস চেঞ্জ চায়…”

৭,”পথ হারালেও পথ থাকে, চেনা নাও হতে পারে

উক্তি বোঝে কচুবনের চেতনা জোনাকির আলো

জ্যোৎস্নার আলোয় সার্বিক বৃদ্ধি তার শেয়ারবাজার”

৮,”উক্তি একটি পাসওয়ার্ড

আবার অ্যাট দ্যা রেট অব ইয়াহু ডট কমেও আছে

মনের সহজাত ভুলে যাওয়া স্বভাবকে যা দিয়ে রাখি”

৯,”উক্তি হাই তুললে ভোরের কুয়াশা ইনফ্যাচুয়েশন

তখন সূর্যের উঠি-উঠি ভাব আকাশের মেমো নম্বর

কে নড়ে ওঠে মৃত স্বপ্নের জঠর ছিঁড়ে”

১০,”উক্তি মাঝেমধ্যে নো পার্কিং জোন

ভিতরে স্তূপাকৃতি বিষাদের চূড়া ভিতরে ডাম্প হতে থাকে

এই আগামীর আনমনা বৃষ্টি আগে থেকে অনির্ণেয়

তবে ভিজতে খারাপ লাগে না

মন আসলে অনুভূতির বাজার, যে যেমনটা কেনাকাটা করে

কিছু অনুভূতি এক্সট্রা উপপাদ্য, আনসলভড থেকে যায়

এরপরও লেটার মার্কের কাছাকাছি পৌঁছে-

অতিরিক্ত একটি দিনের কামনায় ব্যাকুল”

একান্ত নিজস্ব অনুভূতি যার বহুমুখী অভিজ্ঞা নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে। আমাদের দেখারও যা অগোচর, আমাদের ভাবনারও যা অগম্য, আমাদের প্রকাশেরও যা সীমাবদ্ধ—কবি তাকে গুরুত্ব দিলেন। বাহ্য রূপের অন্তরাল ভেদ করলে ভেতরে প্রবেশ করতে পারি। সেই অভিনব কৌণিক পদ্ধতি অবলম্বন করলেন। আবিষ্কার করতে চাইলেন আত্মদ্রাঘিমার বিস্তৃত জগৎ। যা আমাদের কাছে অবাস্তব, জটিল, কখনো অপার্থিব অতিচেতনার বিষয় হয়ে উঠল। তবে তা মননশীলতায়, উপলব্ধির প্রাখর্যে, প্রসঙ্গচ্যুতির অবিন্যস্ত কার্যকলাপে উপলব্ধির সত্যের কাছেই দায়বদ্ধ হল। জীবনযাপনের নানা স্তরগুলি বাস্তবতাকে গ্রহণ করেই এক অন্তঃস্থিত শূন্যতাকেও ধারণ করল। ফলে চেনা জগতের মাঝেও অচেনা জগতের পদধ্বনি শোনা গেল। কবি সহজেই লিখতে পারলেন:”শূন্যস্থান হাতড়াতে-হাতড়াতে নিজের মুখে নিজের আঙুলের রক্ত দেখেছি”। খুঁটে খুঁটে উক্তিকে জপের মালায় রেখেছেন। অজ্ঞাতসারে দিনযাত্রার ইশতেহার কবির। পাশবালিশ সরে গেলে বিছানার চাদরেই নিবিড় সহবাস। বহুগামী পতিতার কোষে কামনার রিক্ত অস্থায়ী নিষিদ্ধজল। সব “গন্তব্য শেষে স্বর্গের আশ্চর্য বায়োপিক”। ৮০ পৃষ্ঠার বই। আলাদা করে কোনো কবিতার শিরোনাম ব্যবহার করতে হয়নি। প্রবহমান জীবনের প্রত্যয়ভূমি রচনা করতে উক্তি শ্রীবাস্তবের আয়োজন বাংলা সাহিত্যে একটি নব সংযোজন বলেই মনে হল।

পাবলো পিকাসো বলেছেন :”The fact that for a long time Cubism has not been understood and that even today there are people who cannot see anything in it means nothing. I do not read English, an English book is a blank book to me. This does not mean that the English language does not exist. Why should I blame anyone but myself if I cannot understand what I know nothing about?” -Pablo Picasso.

অর্থাৎ সত্য এই যে দীর্ঘকাল ধরে কিউবিজম বোঝা যায়নি এবং আজও এমন লোক রয়েছে যারা এর মধ্যে কিছু দেখতে পায় না, তার মানে কিছুই নয়। আমি ইংরেজি পড়ি না, একটি ইংরেজি বই আমার কাছে একটি খালি বই। এর মানে এই নয় যে ইংরেজি ভাষার অস্তিত্ব নেই। আমি যে বিষয়ে কিছুই জানি না তা বুঝতে না পারলে নিজেকে ছাড়া অন্য কাউকে দোষারোপ করব কেন?

এই কবিতাগুলি সম্পর্কেও একই কথা বলা যায়। যদি আমরা না বুঝতে পারি, যদি এর ভিতর প্রবেশ না করতে পারি, যদি কিউবিজম বিষয়ে আমাদের ধারনা না থাকে, তবে সোমনাথ বেনিয়াকে আমরা দোষারোপ করব কেন? তাঁর একটা উপলব্ধির জগৎ আছে, তাঁর জগতের একটা সত্য আছে এটা আমাদেরকে মানতেই হবে। তিনি যা ভাবতে পারেন, তিনি যা বলতে পারেন, তিনি যা লিখতে পারেন—তাইতো শ্রীবাস্তব!

🌺

উক্তি শ্রীবাস্তব : সোমনাথ বেনিয়া, আত্মজা পাবলিশার্স, বসন্ত কুসুম, আড়িয়াদহ, কোলকাতা-৫৭, প্রচ্ছদ অরুণাভ চট্টোপাধ্যায়, মূল্য ২০০ টাকা ।

sahityapatrika

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *