SIDDHESWAR HATUI

SIDDHESWAR HATUI

কোন পথে গ্রাম্য সংস্কৃতি

কলমে- সিদ্ধেশ্বর হাটুই

সমাজ পরিবর্তনশীল এবিষয়ে সকলেই অবগত আছেন, দিনের পর দিন ক্রমান্বয়ে পৃথিবীর সমস্ত দেশে তথা অখন্ড বিশ্বব্যাপী এর অবিচ্ছিন্নতা বজায় রেখে চলেছে। পরিবর্তন দেশের পক্ষে ও সমাজের পক্ষে উৎকৃষ্ট, মানব সমাজকে সম্মুখে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করে। আমরা কেউই নির্দিষ্ট স্থানে থেকে বিশ্বের বা দেশের কোথায় কি পরিবর্তন হচ্ছে তা সঠিকভাবে জানতে পারিনা। দূরদর্শন এবং অন্যান্য প্রচার মাধ্যমের সাহায্যে আমরা মোটামুটি ভাবে তা জানতে পারি। তবে হ্যাঁ.. আমি নিজে আমার গ্রাম বা তার পার্শ্ববর্তী এলাকার যে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন হচ্ছে সেগুলো লক্ষ্য করেছি। তাই আজকের দিনে দাঁড়িয়ে এ বিষয়ে আলোচনা করা খুব বেশি প্রাসঙ্গিক বলে আমি মনে করি।

আমরা যারা গ্রামাঞ্চলে বসবাস করি আমরা সকলেই বেশ ভালোভাবেই উপলব্ধি করি সমাজের পরিবর্তনের কোনগুগো উত্তম দিক আর কোনগুলো মন্দ দিক। আমার বয়স যখন শৈশব বা তার একটু পূর্বে, মানে আজ থেকে যদি ত্রিশ –বছর পূর্বের স্মৃতি রোমন্থন করি তাহলেও সমাজের পরিবর্তনের ধারাগুলো মোটামুটি ভাবে উপলব্ধির মধ্যে অনেকটা চলে আসবে। আমার থেকে আরো অনেক বয়স্ক মানুষ জন গ্রামে আছেন তারা আরো ভালো ভাবে বিষয়গুলো জানেন। বর্তমানে গ্রামে রাস্তাঘাট, স্কুল-কলেজ, টেলিফোন, হাসপাতাল , পুকুর , পানীয় জল, যোগাযোগ ব্যবস্থা সবকিছুই হয়েছে, ভবিষ্যতে হয়তো আরো ভালোভাবে হবে। এগুলো তো ভালো দিক , মানুষের উন্নতিসাধনের দিক।

পাশাপাশি আমরা লক্ষ্য করছি সমাজের অশুভ পরিবর্তনের দিকগুলি- শহর ও গ্রামে। এবিষয়ে কিছু কিছু ঘটনা আলোচনা করলে বোঝা যাবে আমরা কোন কোন দিকগুলোতে সংকটের পথে পা বাড়াচ্ছি। যেমন —–

বয়স্ক মানুষজন যারা আছেন পূর্বে তাদের যোগ্য সম্মান ছোটোরা দিত। কিন্তু বর্তমানে সে আপনি যাই হোন সম্পর্কে, ছেলেটির বা মেয়েটির পাড়াতুতো কাকা, দাদা, জ্যাঠা, মামা – সেটা চুলোয় যাক, আপনাকে সম্মান দেবেনা। এরা এভাবেই ছোট থেকে বড় হচ্ছে , এদের এবিষয়ে জ্ঞান নেই বললেই চলে। আর বোঝানোর মতো লোকও নেই। আর কেই বা বোঝাবে , বোঝাতে গেলে তখন আবার বলবে –‘বড় পণ্ডিত হয়েছে -জ্ঞান দিতে আসছে।‘ আপনি যদি দোকানে যান পান খাব বলে, আপনাকে দোকানদার পান সাজিয়ে দিচ্ছে , এমন সময় দেখলেন আপনার পাড়ার আট বছরের ভাইপো আপনার সামনেই দোকানে একটা সিগারেট কিনে টানতে টানতে বেরিয়ে গেল।

কিম্বা আপনি রাস্তা দিয়ে বা বাসে করে কোথাও যাচ্ছেন দেখবেন আপনার পরিচিত ছোট্ট ছোট্ট ছেলে-মেয়ে গুলো উজাড় করা প্রেম নিবেদনে খুব ব্যস্ত, আপনাকেই মাথা নিচু করে চলে যেতে হচ্ছে। কি আর বলবেন নিজের আত্মসম্মানটাওতো রক্ষা করতে হবে। বর্তমানে আবার করোর -মানে কনো ছেলে বা মেয়ের বাড়িতে গিয়ে যেটা দেখে আপনার খারাপ লগলো সে বিষয়ে কিছু বলবেন তাতেও বিপদ, তার বাড়ির লোক আপনাকেই দোষ দেবে-আপনি নাকি ওর ছেলে বা মেয়ের ক্ষতি করার চেষ্টা করছেন— ওটাই আপনার প্রাপ্য। সাহস আছে আপনার , আর বলতে যাবেন ? চোখ বন্ধ করে রাখুন, আর দুটো কানে তুলো গুঁজে নিন সবথেকে ভালো হবে। হয়তো এমনও ঘটনা ঘটছে নিজের পিতা-মাতাকেও অনেক ছেলে-মেয়ে সেই সময় চিনতেই পারেনা , না আমিই ভুল বললাম , চিনলেও চেনার চেষ্টা করেনা।

পূর্বে আমাদের যারা শিক্ষক ছিলেন তাদের আমরা ইশ্বর জ্ঞানে পূজো করতাম, চলার পথে কোথাও দেখা হয়ে গেলে প্রণাম করতাম। আর আজ স্কুলে কনো ছাত্র-ছাত্রীকে পড়া না করার জন্য মার দেওয়া তো দূরের কথা……ভাবা যায়না। বরং যদি ভুল করে পড়া না হওয়ার জন্য শিক্ষক বা শিক্ষিকা বেত মারেন। ব্যস এরপর শিক্ষক বা শিক্ষিকা মহাশয়া বুঝে নেবেন কিভাবে বাড়ি ফিরবেন, রাস্তায় মার খেতেও হতে পারে ! আমি শুনেওছি এমন কিছু বিষাক্ত ছেলে আছে যাদের শিক্ষক মশাই অসদাচরণ করার জন্য মেরেছে, সঙ্গে সঙ্গে সেই ছাত্রও শিক্ষকের গালে চড় বসিয়ে দিয়েছে। ভাবুন তো কি অবস্থা, কাঁদবেন না হাসবেন ?

বর্তমানে দেখবেন খেলার মাঠে গিয়ে আর কেউ ফুটবল খেলছেনা। মোবাইলে খেলা খেলে, দৌড়া-দৌড়ি সমস্ত ওখানেই। যদিও এর জন্য আমরা নিজেরা অর্থাৎ বাড়ির বড়রা দায়ী। আমরা তাদের এভাবেই মানুষ করছি বর্তমানে। পূর্বে পাড়ার ছেলেরা একসঙ্গে মাঠে ফুটবল, ক্রিকেট, কাবাডি ,পাড়ায় -ছু-কিতকিত খেলত, মার্বেল খেলত কত আনন্দ করে, কিন্তু আজ আর ঐ খেলাগুলো খুব কম চোখে পড়ে। যদিও ক্রিকেট খেলাটা একটু ব্যতিক্রম । যাইহোক খেলা তো না হয় মোবাইলেই হবে! আবার অন্য বিষয়ে একটু আলোকপাত করিয়ে দিই——

আজ থেকে বেশ কিছু বছর পূর্বে বিশেষ করে গ্রাম এলাকায় জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষে-মানুষে বা পাড়ায়-পাড়ায় সকল মানুষের মধ্যে একটা ভালো সম্পর্ক ছিল। একে অপরের বিপদে ঝাপিয়ে পড়ত, এমনকি রান্না করা খাবার পর্যন্ত লেনদেন হত নিজেদের মধ্যে। কিন্তু বর্তমানে যে হয়না তা নয়, পরিমানটা কমে গেছে। তবে শহরের তুলনায় পাড়া-গ্রামের মানুষ অনেক সঙ্গবদ্ধ জীবন যাপন করে আজও।

সংস্কৃতির কথা যখন আলোচনা করছি তখন আজ-কাল পাড়া-গ্রামেও যে সংস্কৃতির কাপড় খুলে উলঙ্গ করে দেওয়ার একটা প্রবল প্রচেষ্টা চলছে তা বলাই যায়। আপনি দেখবেন -গ্রামে পূর্বে কত যাত্রাপালা, নাটক, পালাকীর্তন, রামায়ণ-মহাভারত পাঠের আসর বসত। আজ আর নাটক,যাত্রা কেউ দেখেনা। মোবাইলে না হলে টিভিতে কিছু দেখে। ধরুন কনো উৎসবে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে , সেখানে কী হবে বাউল গান, লোকগান, পালাকীর্তন, পুতুলনাচ পাড়ার বা গ্রামের ছেলে-মেয়েদের নিয়ে একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ? না না না…..সে হবেনা । যদি সেটা হয় তাহলে সেই আসরে ইঁট-পাটকেল ছুটে আসতে পারে , তাই না ? বরং সেখানে হবে অশ্লীল নাচ-গানের আসর, সেটাই ভালো। কনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করা বর্তমানে জটিল। অনেক মানুষ আছেন নিজের সম্মান-বুদ্ধিকে বিসর্জন দিয়ে হা করে বসে বসে সেগুলো দেখেন, মুখে গোবরপোকা ঢুকে গেলেও বুঝতে পারেননা মনেহয়।

এখন দেখবেন প্রায় সমস্ত জায়গায় কনো দেব-দেবীর পূজো শেষ হয়েছে। এবার বিসর্জনের পালা । দাদা তখন বুঝবেন কেন ভালো অনুষ্ঠান হলো না, কেন প্যাণ্ডেলটা ছোট, তার কারন বিসর্জনের দিন দেখবেন মাইকের প্যান্ডেল আর মদ বা শরাবের সু-গন্ধের ছড়াছড়ি আর উদ্দাম নৃত্য। তখন নিশ্চই বুঝতে অসুবিধে হবেনা আমরা কোন পথে এগোচ্ছি বা এগোবার চেষ্টা করছি। ভবিষ্যত প্রজন্মকে আমরা কি শিক্ষা দিচ্ছি, সেটা ভালো না মন্দ বিচার আমরা করবোনা ? আজ যারা এই অপ-সংস্কৃতির ধারক-বাহক হয়ে সমাজকে বিপথে ঠেলে দিচ্ছেন তাদেরকে একদিন আক্ষেপ করতে হবে। তারাও কনোএকদিন কারো পিতা-মাতা হবেন, সেদিন বাচ্চাদের কি ঐ শিক্ষাই দেবেন ? না সভ্য সংস্কৃতির পূজো পাঠ করে শোনাবেন ?

যাই হোক আমরা যারা এখনো সমাজে সভ্য সংস্কৃতিকে উদ্ধার করতে চাই…….তাদের এবার দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। আর যারা অপ-সংস্কৃতির বাহক তাদেরকে সভ্য সংস্কৃতির মন্ত্র পাঠ করতে শেখাতে হবে। এটাই হোক মোদের অঙ্গীকার।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *