
বীর শিবাজী – ২
পুলক মজুমদার
অবশেষে প্রায় দুবছর পর বিজাপুর রাজ্যের সেরা ওমরাহ আবদুল্লাহ ভটারি শিবাজীর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনায় সম্মত হল। আদিল শাহ জীবিতাবস্থায় দীর্ঘ, সুঠাম দেহের অধিকারী, ভয়ংকর যোদ্ধা আবদুল্লাহ ভটারিকে বিজাপুর রাজ্যে তার অসামান্য অবদানের জন্য আফজাল খান উপাধী দেন। আফজাল খান দায়িত্ব নেওয়ার পর বিজাপুরের অনুগত জায়গীরদারদের নানা প্রলোভন দেখিয়ে শিবাজীকে আরাবল্লীর গহীন পর্বতাঞ্চল থেকে লোকালয়ে আনার অনেক রকম চেস্টা করে ও সফল হল না। অন্য কোন উপায় না পেয়ে আফজাল খান সুলতানের মার সাথে বিশেষ আলাপে ব্যস্ত হল। কারন সে জানত অযোগ্য সন্তান সুলতানের মসনদে থাকলে ও অভিজ্ঞতা বলে বিজাপুর রাজ্যে কুট সিদ্ধান্ত নিত পরলোকগত আদিল শাহের বিধবা স্ত্রী। তিনি সিদ্ধান্ত দিলেন –
-শিবাজীর দাদা শম্ভাজীকে তুমি অনন্য কৌশলে হত্যা করেছ। আমি জানি আপনি এই কাজে সফল হবেন। বন্ধুত্বের ভান করে শিবাজীকে তোমার কাছে এনে হত্যা কর।
পরামর্শ অনুযায়ী রণসজ্জায় সজ্জিত শক্তিশালী ও অভিজ্ঞ সৈণ্যদল নিয়ে আফজল খাঁ বাই নগরে এসে ঘাঁটি গাড়ল। দেওয়ান কৃষ্ণাজী ভাস্করকে দিয়ে ছত্রিশ কিলোমিটার দূরের প্রতাপপুর দুর্গে শিবাজীর কাছে লিখে পাঠাল –
শিবাজী।
তোমার পিতা সাহাজি রাজা ভোসলে আমার পুরণো বন্ধু। সুতরাং তুমি আমার পর নও। বিজাপুরের সুলতানকে রাজি করানোর দায়িত্ব আমার। অধিকৃত দুর্গ ও কোঁকন প্রদেশ তোমার অধিকারেই থাকবে। যদি তুমি সুলতানের দরবারে থাকতে চাও। তবে অভাবিত মান ও সম্মানে ভূষিত হবে। আর যদি নিজ দুর্গে বাস করতে চাও তার বৈধ অনুমতির ব্যবস্থা করব। সিদ্ধান্ত যায় হোক। অতি সত্বর আমার সাথে দেখা কর।
আফজাল খান।
মন্ত্রনা কক্ষে মারাঠা সর্দারদের গোপন বৈঠক আহবান করলেন শিবাজী।
-আফজাল খা আমাকে বিজাপুরের সাথে সন্ধি করার জন্য ডেকে পাঠিয়েছে। বলুন আপনাদের কি অভিমত?
-রাজে। আপনি আফজাল খার সাথে সন্ধি করুন।
-কেন এ কথা বলছেন?
-তার বিশাল সুপ্রশিক্ষিত বাহিনি রয়েছে। সে নিজে ও একজন নামকরা যোদ্ধা। কয়েক বছর আগে স্বাধীন দুর্গাধিপতি কস্তূরী রঙ আত্মসমর্পণ করার জন্য তার কাছে গেলে সে কস্তূরী রঙকে বন্দী করে খুন করে। আফজল খাঁ হিংস্র, উদ্ধত, নৃশংস। শরণাগতের প্রতি বিন্দু মাত্র সহমর্মিতা সে পোষন করে না।
আরো অনেক বাক্যালাপের পর ও শিবাজী কোন সিদ্ধান্তে আসতে না পেরে তখনকার মত মন্ত্রনা কক্ষ থেকে বিদায় নিয়ে ভবানীর মন্দিরে প্রবেশ করলেন। অল্পক্ষণের মধ্যে দুঃচিন্তা তাঁকে গ্রাস করল। মন্দিরের বারান্দায় পায়চারী করতে করতে অন্তহীন ভাবনা তাঁকে পেয়ে বসল। যদি সে বিজাপুরের সুলতানের অধীনতা মেনে নেয় তবে হয় বিজাপুর বন্দীশালায় বন্দী হয়ে বাকি জীবন কাটাতে হবে নয়ত সামাণ্য জায়গীরদার হয়ে বেঁচে থাকতে হবে। আর যদি অধীনতা মেনে না নেয় তবে বাকি জীবন মোগল ও তার দোসরদের সাথে লড়াই করে জীবন কাটাতে হবে। আর তাহলে নিজ জন্মভূমিকে মুক্ত করে স্বরাজ স্থাপন করা কখনোই সম্ভব হবে না।
অমাবস্যার নিকষ কালো রাত। দুর্গের কিছু চৌকস পাহারাদার ছাড়া পুরো প্রতাপগড় দুর্গ সুপ্তির কোলে গভীর ঘুমে মগ্ন। মাঝে মাঝে আশপাশের জঙ্গল থেকে রাত জাগা হিংস্র পশুদের ভয়ার্ত ডাক ভেসে আসছে। দুর্গের অতিথিশালায় আফজল খানের দূত কৃষ্ণাজী ভাস্কর যে কক্ষে অবস্থান করছেন গুপ্ত পথে দেওয়ালের আড়াল সরিয়ে সতর্ক পদ বিক্ষেপে সেখানে প্রবেশ করলেন শিবাজী। অতিথিকে ঘুম থেকে জাগিয়ে মোহিনী কণ্ঠে শিবাজী বলে উঠলেন –
-প্রণাম ভাস্করজি। ভয় পাবেন না। আমি শিবাজী।
-প্রণাম রাজে। এত রাত্রে!
বাম হাতে রাখা ছোট একটা কারুকাজ করা কাপড়ের পুটলি থেকে বহু মূল্য একটা হার ভাস্করের হাতে দিয়ে বললেন –
-দেখুন। আপনি পুরোহিত। সত্য বলুন তো ঠিক কোন উদ্দৈশ্যে আফজাল খান আমার সাথে দেখা করতে চাইছেন।
-রাজে। খানের অভিসন্ধি শুভ নয়।
-ঠিক কি বোঝাতে চাইছেন?
-আপনাকে বন্দী করাই ওর উদ্দৈশ্য।
যা শুনতে এসেছেন তা জানা হল। আরো কিছু দুর্মূল্য অলংকার ভাস্করকে দিয়ে বিদায় নিয়ে শিবাজী চলে গেলেন ভবানী মন্দিরে।
নানা ভাবনায় পায়চারী করতে করতে মাঝে মাঝে দীর্ঘ নিঃশ্বাসের সাথে সাথে তাঁর মুখ দিয়ে বার বার একটা শব্দই অস্ফুট প্রকাশ পাচ্ছিল, জগদম্ব। যেন বা দেবী ভবানীর কাছে এই বিষম সংকটে পরিত্রানের উপায় খুঁজছিলেন। ক্লান্ত শরীরে শেষ রাতের দিকে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন শিবাজী। হঠাৎ স্বপ্নের আবেশে তাঁর মনে হল তমোগুণময়ী মা জগদম্বা বলছেন –
“তোর তলোয়ার নিয়ে শত্রুকে আক্রমন কর। জয় সুনিশ্চিত। আমি তোর সাথে থাকব”।
মাথায় হাতের আলতো ছোঁয়ায় তড়িঘড়ি করে জেগে উঠে ঘুম চোখে মনে হল দিব্য একটা শরীর মা ভবানীর প্রতিমায় মিলিয়ে গেল।
রোজকার মত ব্রাহ্ম মুহূর্তে ঘুম ভেঙ্গেছিল শিবাজীর। পুজো সেরে মা জিজা বাঈকে স্বপ্নাদেশের কথা জানাতেই তিনি সম্মতি দিলেন –
-ভাবনার কিছু নেই শিবা। তুই যুদ্ধ যাত্রার আয়োজন কর।
মার চরণ ছুঁয়ে প্রণাম করতেই ছেলেকে আশীর্বাদ করে তিনি বললেন –
-আমার একটা আব্দার আছে শিবা।
-বল মা।
-কথা দে, শিবা। ভয়ংকর অত্যাচারী আফজাল খানকে হত্যা করে তার ছিন্ন মস্তক আমার কাছে নিয়ে আসবি।
দৃপ্ত কণ্ঠে দাঁতে দাঁত চেপে শিবাজী বলে উঠল –
-কথা দিলাম মা। তোমার আশায় পূর্ণ হবে।
(ক্রমশ)