SHASHANK SHEKHAR ADHIKARI 

 শশাঙ্কশেখর অধিকারী

অনন্তকে ধারণের কাব্য

🍃

তৈমুর খান

🍁

‘কবিতায় জীবন ও কবিতায় যাপন’ এই ব্রত নিয়েই সাতের দশকে যাত্রা শুরু করেছিলেন। একদিকে কবিতায় ভূমা দর্শন, অন্যদিকে কবিতাকে ঐশ্বরিক প্রকাশ হিসেবেই বিশ্বাস করেন। এরকমই একজন কবি শশাঙ্কশেখর অধিকারী। সম্প্রতি প্রকাশিত ‘ছিন্ন পালক পাতায় কিছু শ্রাবণ মেঘ’ (প্রথম প্রকাশ মার্চ ২০২২) তাঁর কাব্যখানির ৫৬টি কবিতায় জীবনদর্শনের অনন্ত রূপটিই উদ্ভাসিত হয়েছে। মৃত্যু কবিকে যেমন ক্ষুন্ন করতে পারেনি, তেমনি আত্মদর্শনের ভেতর নিজেকে অনন্তের পথিক করে তুলেছেন। মহাবিশ্বের সব সুর ধ্বনি আর গানে নিজেকে খুঁজে পেয়েছেন। বট শিরিষ অসত্থ আমলকী ও বনের পাতায় এবং হিজল করঞ্জা জারুল দেবদারু বকুল ফুলের ঘ্রাণে নিজেকে উপলব্ধি করেছেন। পাখপাখালির ডানায় নদীর কলতানে ও সুনীল সাগরের তরঙ্গ মালায় নিজেরই সৌন্দর্য জেগে উঠেছে। সুতরাং জীবন কবির কাছে অপ্রতিরোধ্য চির আবেগময় ঐশ্বরিক পরিভাষারই প্রকাশ যা অনন্তের আধারে পরিব্যাপ্ত। ‘সূর্যস্নান’ কবিতায় লিখেছেন:

“আমি তার চোখে এক অনন্তকালের আহ্বান শুনি

আমার আত্মার নিভৃতে বেজে ওঠে আকাশ রামধনু নক্ষত্র গান

বসন্ত ঋতুর সমারোহ

এক অনাহত জীবনের উৎসার”

এই অনন্তকালের আহ্বান অনন্তকালের মানুষেরাই শুনতে পান। কবির ভেতরের অনন্ত

এবং বাহিরের অনন্ত যেন একসঙ্গেই মিলিত হতে চায়। কবির আত্মার মধ্যেই সীমাহীন আলোড়ন সৃষ্টি হয় বলেই বসন্ত ঋতুর সমারোহে অনাহত জীবনের উৎসার বুঝতে পারেন। ইংরেজি সাহিত্যের বিখ্যাত কবি উইলিয়াম ব্লেক বলেছেন:

“If the doors of perception were cleansed every thing would appear to man as it is, Infinite. For man has closed himself up, till he sees all things thro’ narrow chinks of his cavern.”

(William Blake, The Marriage of Heaven and Hell: In Full Color)

অর্থাৎ উপলব্ধির দ্বার শুদ্ধ হলে প্রতিটি জিনিসই মানুষের কাছে দেখা যেত, অসীম। কারণ মানুষ নিজেকে বন্ধ করে রেখেছে, যতক্ষণ না সে তার গুহার সরু চিকন দিয়ে সব কিছু দেখতে পায়।

কিন্তু কবি তো সাধারণ মানুষ নন, তিনি ঐশ্বরিক ক্ষমতাপ্রাপ্ত, তাই তাঁর অন্তর্দৃষ্টি এই সীমাহীন অনন্তকে উপলব্ধি করতে পারে। শশাঙ্কশেখর তা পেরেছেন। নিজের ক্ষুদ্র অবস্থান থেকেও অনন্তের মহামহিমকে ধারণ করেছেন। তাই স্বয়ম্ভুর মতো উত্থিত কোনো তপস্বীর বিরাট বোধিব্যাপ্তি সম্মোহনে নিজেকে বিস্তৃত করেছেন। ‘ডাক’ কবিতায় লিখেছেন:

“সম্পর্ক ছড়িয়ে আছে কাল মহাকাল

বিষাদহীন শুশ্রূষার তাপ শুষে নিচ্ছে

আমার অগ্রন্থিত কবিতাগুলি

মানবিক অস্তিত্বের আলোকবর্ষ পেরিয়ে তুমি

ছড়িয়ে রয়েছ যে অনন্ত ভূমার নৈঃশব্দ্যে তরঙ্গে

তার স্পর্শে জ্বলে উঠছে

এই শেষ শয্যার মাহেন্দ্রক্ষণটুকু

এক অপার অতীন্দ্রিয় ছন্দে…”

এই সম্পর্ক তো প্রত্নযুগেরই পরিচয় বহন করে। মানবিক অস্তিত্বের আলোকবর্ষ পেরিয়ে যে ‘তুমি’ সর্বনামে বিক্রিয়া শুরু হয়, কবি তাকেই অনুধাবন করেন। তার স্পর্শেই জ্বলে উঠতে পারেন। সেখানেই অতীন্দ্রিয় ছন্দ। আসলে ব্রহ্মচৈতন্যের কাছে আত্মজাগরণেরই এই প্রজ্ঞাটিকে তিনি কবিতা করে তুলেছেন। আর এই প্রজ্ঞার চৈতন্যই তাঁর প্রেমের ভাষা হয়ে গেছে। তাই ছায়ারোদে, হলুদ সূর্যের খেতে যে কিশোরী মুখ দেখতে পান, তাকে ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করেন। এই ‘তুমি’ যে মানবী নন তার পরিচয়ও এভাবে দেন:

“তুমি তো আমার কাছে উথলে ওঠা

ভোরের নির্জন কিংবা যমুনার ঢেউ

প্রত্যাশিত আকাঙ্ক্ষায় শিশিরস্নাত

বিন্দু বিন্দু নীলের মর্মরে

গেঁথে যায় এক হিরণ্ময় সলাজ হৃদয়।”

‘তুমি’ তখন অনন্ত রূপেরই আধারে এক বিস্ময়কর সত্তা। যে সত্তাকে মিথস্ক্রিয়ায় উপলব্ধি করা সম্ভব। তার ব্যাপ্তিকে তখন এভাবেই লিখতে থাকেন:

“অনন্ত আকাশের নীচে বহমান নদী।উথাল পাথাল

শরীর। তার বুকে প্রিয় জন্মের শ্বাস-গন্ধ পাই।

যেন আগুন সিদ্ধ নারীর এক অলৌকিক চুম্বন ছুঁয়ে আছে এপার ওপার।”

নারীর রূপের ও ক্রিয়ার মধ্যে তার প্রবাহ ও আসক্তির অনুরণন শোনা গেলেও তা প্রাকৃতিক এবং মানবিক প্রবৃত্তিকে ছাপিয়ে গেছে। বিরাট আত্মার সমীহ থেকেই তার আলো ও আভাস ব্যঞ্জিত হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই কবি লিখেছেন:

“চন্দ্রমল্লিকা অঝোর ফুল-পাতা ঝরায় হেমন্তের ঘ্রাণে।শিশির জ্যোৎস্না বারেকের তরে শয্যা পাতে

ভোরের দুয়ারে। সব নিকট দূরের অবগাহন সরিয়ে

চড়ুই দিনযাপনের গ্লানি মাঠময় রোদের ওম্ মেখে

শস্যের অতীত বর্তমান আর ভবিষ্যৎ

হিসেব নিকেশের অংক মেলাচ্ছে

ছিন্ন পালক পাতায় কিছু শ্রাবণ….”

কবির দেখা আকাশ মেঘ সকাল দুপুর নদী নারী পাখি গাছপালা শিশির পাহাড় নীলিমা সবকিছুই অনন্তের বর্ণ-গন্ধ-রূপ-রসময় অনুষঙ্গ। কবির আত্মনির্মাণের উপাদান। আবার এসবের মধ্যেই পূর্ব পুরুষেরাও বিরাজ করেন। শূন্য থেকে নিঝুম একাকিত্বের উত্তরীয় গায়ে ধ্রুবতারারা পূর্বপুরুষের চোখ হয়ে ঐশ্বরিক আলো বিলি করে। নিজস্ব নির্মাণের এই পথ ধরেই তিনি যুগাতীত প্রত্যয়ের দিকে অগ্রসর হন।বিশ্ববরেণ্য ফরাসি সাহিত্যিক গুস্তাভ ফ্লোবের(১৮২১-৮০) লিখেছেন: “An infinity of passion can be contained in one minute, like a crowd in a small space.”

(Gustave Flaubert, Madame Bovary)

অর্থাৎ আবেগের অসীমতা এক মিনিটে ধারণ করা যায়, যেমন একটি ছোট জায়গায় ভিড়।

এই অসীম এবং চিরন্তন আবেগের দেখা পেলাম শশাঙ্কশেখর অধিকারীর কাব্যে। অসীমের দুয়ার খুলে ঘন তমসা নদী সহস্র ঈশ্বরকণা আলো নিয়ে যেমন প্রবাহিত হয়েছে, তেমনি রাতের নৈঃশব্দ্যে অন্তরাত্মা অনন্ত নির্বাণের খোঁজ করেছে। মৃত্যুও এখানে জন্মান্তরের পাঠ শিখেছে। সব মিলিয়েই সহজ সুন্দর সাবলীল একমুখী ভাবের কাব্য যা জীবনের সম্মোহনেই উদ্ভাসিত। সাম্প্রতিককালের কবিতার পরিবর্তনের নানা বাঁক ও ধারাকে উপেক্ষা করেই কবি নিজস্ব পথে অগ্রসর হয়েছেন।

🌺

ছিন্ন পাতায় কিছু শ্রাবণ মেঘ: শশাঙ্কশেখর অধিকারী, উত্তরপাড়া, হুগলি-৭১২২৫৮

পশ্চিমবঙ্গ, ভারত, মূল্য ১০০টাকা।

চলভাষ : ৬২৯০৪২০৬৬৮,

 শশাঙ্কশেখর অধিকারী

👨‍👨‍👧

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *