
এক টুকরো রৌদ্রের বিলাপ
শাপলা বড়ুয়া
১
– উনার ভেইন কোথায়? মৌসুমী আপা, আপনি ওনার ভেইন পাইছেন? জানতে চাইলো পয়ত্রিশর্ধো এক ভদ্রলোক।
– বুঝতে পারছি না, ইনজেকশন ঢোকাবো কিভাবে? হাতে তো মাংসই নাই। সবই হাড্ডি।
-আল্লার নাম নিয়া এইখানে ঢুকাইয়্যা দেন। ঢুকাইছেন?
অমনি তীক্ষ্ণ গোঙানির মতো একটা শব্দ বেরিয়ে আসলো অপলার গলা দিয়ে! মনে হলো, প্রাগৈতিহাসিক কোন ভোঁতা অস্ত্র দিয়ে কে বা কারা খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে এ-ফোঁড় ও-ফোঁড় করে দিচ্ছে ওর বাম হাত! ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে অপলা।
– ব্যাথা লাগে? একটু সহ্য করেন বোন। সব ঠিক হয়ে যাবে। অভয় দেয় লোকটি। ‘একদম নড়বেন না। হাতটা সোজা রাখেন।’ বলেই লোকটি দ্রুত দরজা বন্ধ করে দিয়ে ভেতরে কম্পিউটারের সামনে গিয়ে বসলো। কিছুক্ষণের মধ্যে আবার হন্তদন্ত হয়ে ভেতরে প্রবেশ করেই; লোকটি গলা উঁচিয়ে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে হাঁক ছাড়লো; ‘আপা, এদিকে আসেন তো। উনার এই হাত তো ফুলে গেছে। আমি উনার হাতটা ধরে আছি, আপনি ইনজেকশনটা তাড়াতাড়ি বের করে আনেন। ডান হাতের ভেইনের কি অবস্থা দেখেন?
– ঐ হাতেরও তো একই অবস্থা, ফয়সাল ভাই! ভেইনগুলো বেশ পাতলা! ইস্ কি অবস্থা! মনে হয়, খাওয়া দাওয়া একদমই করেন না। এই বলেই ত্রিশর্ধো এক নারী ডান হাতের নানান জায়গায় অপলার শিরা খুঁজতে থাকে আর একবার এদিকে আরেকবার ওদিকে ভোঁতা সুই ফোঁটাতে থাকে বেডে শুয়ে থাকা নারীটিকে। অসহ্য ব্যথায় কুঁকড়ে গিয়ে মুমূর্ষু রোগীর মতো ছটফট করতে থাকে ও!
হঠাৎ সেতুর মতো দেখতে অদৃশ্য কেউ শুয়ে থাকা নারীটির চারপাশে ঘুরে যায় যেনো। ‘সেতুই তো। ও এখানে এসেছে কেনো!’ আতংকিত হয়ে ওঠে অপলা। আচ্ছা, সেতুর স্তনবৃন্তের মাঝে গজিয়ে ওঠা বিষফোঁড়াটি কতদূর ছড়িয়েছিলো! ঠিক এমনি করে কি ভোঁতা অস্ত্র দিয়ে প্রতিনিয়ত এ-ফোঁড় ও-ফোঁড় করতো ওর সমগ্র শরীরকে! সেতুও কী ঠিক এমনি করে যন্ত্রনায় কুঁকড়ে যেতো! হাজারো আশংকা ঘুরপাক খেতে থাকে অপলার মাঝে। অমনি গোঙানির ভঙ্গিতে এক তীব্র যন্ত্রণা ওর মুখ ঠেলে বেরিয়ে আসে!
– কি হয়েছে? ব্যাথা লাগাছে? আরো একটু সহ্য করেন আপা। নতুন আরেকটি বড় ও মোটা ইনজেকশন ঠিক করতে করতে জানায় লোকটি।
কেঁপে ওঠা গোঙানিটা এখন অপলার শরীরের ওপর কঠিন পাথরের মতো চেপে বসে যায় যেনো!
– এমন করলে আপনাকে আর ইনজেকশন দিবো না আমরা। আপনি কি চান, ইনজেকশান দিবো না? একরকম নরম ও তীক্ষ্ণ কণ্ঠে ধমক দেয় লোকটি।
– বাম হাতটা ভীষণ টনটন করছে। আর সহ্য করতে পারছি না! মুখটাকে এক পাশে কাত করে দাঁতে দাঁত চেপে গোঙাতে থাকে অপলা!
২
সিটি স্ক্যান রুম থেকে বেরিয়ে আসতেই পয়ত্রিশোর্ধ লোকটি একটি চেয়ার বাড়িয়ে দিলো অপলাকে,
– এতো ভয় পেলেন কেন? সামান্য একটা ইনজেকশনের ব্যাথা নিতে পারছেন না,অপারেশনের ধকল সহ্য করবেন কিভাবে?
অসহ্য যন্ত্রণায় আর কথা বলতে ইচ্ছে করছিলো না অপলার। এখনও ব্যাথায় টনটন করছে হাতটা! ফোলা জায়গায় হাত বুলিয়ে যাচ্ছিলো ও কিছুক্ষণ পর পর।
– নিয়ম করে জায়গাটিতে দু’য়েক দিন পর পর গরম সেঁক দেবেন, কয়েকদিনের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে, ইনশাল্লাহ।’ আশ্বশ্ত করলো লোকটি।
– রিপোর্ট কখন পাওয়া যাবে?
– আজ বিকেল ৫ টায় পেয়ে যাবেন। এই বলেই ক্যাশ মেমোয় সীলের ছাপ দিয়ে অপলার হাতে কাগজটি ধরিয়ে দিলো লোকটি।
কাগজটি হাতে নিয়ে বাইরের চেয়ারে উবু হয়ে বসে পড়ে অপলা। উফ, মাথাটা ভীষণ ব্যাথা করছে! চোখ মেলে তাকাতে পারছি না আর। মাথার দুই পাশ হাত দিয়ে চেপে ধরে নিজের মনেই কথা কয়’টি আওড়াতে থাকে ও।
আজ ক’দিন হলো সেতুকে ভীষণ মনে পড়ছে। এই নভেম্বরই তো সেতু মারা গিয়েছিলো! সময়টা মনে করার চেষ্টা করে অপলা। ওর মৃত্যুসংবাদ কেউ জানায়নি তাকে। নাম্বারটি হয়তো সেতুর ফোনবুক থেকে মুছে গিয়েছিলো! নাকি ইচ্ছে করে মুছে ফেলেছিলো ও! অনেক অজানা কথার মতোই এই কথাটিও অজানা থেকে যায় অপলার!
সেতুর সেই হাস্যোজ্জ্বল মুখটি স্পষ্ট হতে হতে আরও স্পষ্টতর হয়ে ওঠে। ধীরে ধীরে পুরো অবয়ব নিয়ে অপলার পাশে এসে দাঁড়ায় সেতু। চোখের নীচের বড় কালো দাগটি যেনো আরও বেশি করে অপলার চোখে পড়ে।
এতো বড় কালো দাগ তো এর আগে কখনও দেখিনি। আঁতকে ওঠে ও! খুব ভালো করে সেতুর মুখটি দেখার চেষ্টা করে আবার। ধীরে ধীরে পুরো মুখায়বেই ছড়িয়ে পরে যেনো দাগটি। দেখতে দেখতে কেমন মলিন ও জীর্ণ হয়ে ওঠে ওর মুখ! সেতু কী কোন আর্তি জানাচ্ছে ওকে! অনেক চেষ্টা করেও তার মুখের ভাষা পড়তে পারে না অপলা। সেতুর বুকের মাঝে একটু একটু করে বেড়ে ওঠা সেই বিষফোঁড়াটি যেনো ওকে ছাপিয়ে বিরাটাকার লাল ঘা-এর মতো দগদগ করতে থাকে! ভয়ে-আতংকে হঠাৎ অসহায়ের মতো কেঁদে ওঠে ও! নাক ও চোখের পানি একসাথে মিশে, ভিজে চপচপ করতে থাকে ওর মুখের মাস্ক! হঠাৎ সম্বিত ফিরে আসতেই সর্তক হয়ে ওঠে ও। না, ওকে এ অবস্থায় কেউ দেখতে পায়নি! এই কঠিন পৃথিবীতে আজকাল কেউ কোন অস্বস্তিকর বা অস্বাভাবিক কিছু দেখতে পেলেও পাশ কেটে চলে যায়। কেউ কারো কষ্টের ভাগিদার হতে চায় না এখানে। ক্ষীণ একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে ধীরে ধীরে মাথা নিচু করে টিস্যু দিয়ে চোখমুখ মুছতে থাকে অপলা!
নিজেকে সামলে নিয়ে ধীর পায়ে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আসে ও। মুখের ভেতরটা তেতো হয়ে আছে সেই কখন থেকে। চার ঘন্টার ধকল গেলো সিটি স্ক্যান করাতে! সকাল থেকে পেটে দানাপানি কিছুই পড়েনি। খিদেয় চোখে অন্ধকার দেখছে যেনো! টঙ দোকান থেকে দুটো কলা আর বিস্কিট নিয়ে রিক্সায় ওঠে পড়ে অপলা। কী চড়া রোদ পড়েছে! হাসপাতালে থাকায় এতক্ষণ বোঝা যায় নি।
হাত ফুলে ঢোল হয়ে গেছে এরই মধ্যে! কিছুক্ষণ পর পর চিনচিনে ব্যথা দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করতে হচ্ছে ওকে। সেতুকে এতো মনে পড়ছে কেন আজ! দশ বছর আগের সেই ঘটনা মাথা থেকে কিছুতেই ফেলতে পারছে না অপলা।
– তুমি আমার সাথে আর যোগাযোগ রাখলে না কেন অপু! তুমি চাইলে আমাকে সব কথা খুলে বলতে পারতে। এতটা অমানুষ মনে হয়েছিল আমাকে!’ অভিমান ও অনুযোগ ঢেলে দেয় যেনো কৃশকায় এক নারী
– আমার ভীষণ ভুল হয়ে গেছে। আমি জানি এর কোন ক্ষমা নেই। তুমি জানো না, এ নিয়ে প্রতিনিয়ত আমি দগ্ধ হচ্ছি এখনো। ভীষণ যন্ত্রণা হয় আমার! কাউকে খুলে বলতে পারি না আমি।
ওহ, ঈশ্বর! এ কেমন শাস্তি, আজীবন ভুগতে হচ্ছে আমাকে! কষ্টে-যন্ত্রণায় মুষড়ে পড়ে অপলা। কিছুতেই চোখের জল আটকাতে পারে না ও। আশপাশের রিক্সা থেকে কয়েকজন কৌতুহলী চোখ উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখতে থাকে ওকে।
৩
এরই মধ্যে সময়ও গড়িয়েছে অনেক। এই তো সেদিনের কথা। কিন্তু এরই মধ্যে দশ বছর হয়ে গেছে। সময়গুলো দ্রুতই গেছে যেনো। মনে করার চেষ্টা করে, সেতুর সাথে হলি ফ্যামিলিতেই দেখা হয়েছিলো শেষ কয়েকটি মাস। ওর মাকে দেখতে গিয়েছিলো হাসপাতালে। কোন এক ওর্য়াড থেকে উচ্চস্বরে কান্নার শব্দ ভেসে আসছিলো,হয়তো ঐ ওর্য়াডের কেউ মারা গিয়েছিলো তখন! সেতু ওর ডিএসএলআর ক্যামেরা নিয়ে সাথে সাথে দৌড়! অপলাকে পীড়াপীড়ি করছিলো যাবে কিনা! এমন ভারাক্রান্ত পরিবেশ ওর ভালো লাগে না বলে সরাসরি এড়িয়ে গিয়েছিলো ও। ওর বাড়ির সকলের বারণ তোয়াক্কা না করে চলে গিয়েছিল ও ছবি তুলতে।
– এমন পরিবেশে তুই যে ছবি তুললি, কেউ কিছু বললো না তোকে? এই পরিস্থিতিতে কেউ ছবি তোলে? তিরস্কারের বাণ ছুঁড়ে দিলো ওর বড় বোন।
– কে কি বলবে? ঐ পরিবারের আত্মীয়দের ম্যানেজ করেই ছবি তুলেছি!
– যাই হোক, তোমার সাহস আছে বলতে হবে! একটা মানুষ মরে শক্ত হয়ে পড়ে আছে, তুমি সেই মৃত মানুষের ছবি কিভাবে তুলে নিয়ে আসলে! মুহূর্তেই অবাক চোখে সেতুর দিকে তাকিয়ে রইল অপলা।
– কি যে বলো না! ফটোগ্রাফারদের অতো কিছু ভাবলে চলে। হাসতে হাসতে বলে যায় সেতু।
রিক্সা মহল্লার রাস্তাটায় বাঁক নিতেই হঠাৎ সম্বিত ফিরে এলো অপলার। ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে এটুকু পথ আসতেই হাঁপিয়ে উঠলো ও। ডান হাতের ফোলা জায়গাটা চেপে এক একটা সিঁড়ি ভেঙে; ঘরের দোর অব্দি আসতেই মাথা ঝিমঝিম করে ওঠলো ওর। ঘরে ঢুকেই কোনভাবে চেয়ার টেনে বসতেই হু-হু করে ওঠে ওর বুকের ভেতরটা। তলপেট চেপে চেপে অনুভব করার চেষ্টা করলো বিষফোঁড়াটি ঠিক কতটুকু বড় হলো! আগে তো এর সাইজ গোল ছিল এখন এতো শক্ত আর লম্বা লাগছে কেনো! তাহলে কী আরো কয়েক সে:মি: বেড়ে গেলো এরই মধ্যে। উদ্বিগ্নতা ছড়িয়ে পড়লো ওর চোখেমুখে।
এর মাস দু’য়েক পরে সেতুর মোবাইল থেকে আসলো একটি ফোন। ওর বড় বোন ফোন করেছে।
-অফিস থেকে বাসায় ফেরার পথে তুমি হলি ফ্যামিলিতে আসতে পারবে, অপু?
– জি, পারবো। কেন, কি হয়েছে? খালাম্মা ঠিক আছে তো?
– উনি ঠিক আছে। তুমি আসলে কথা হবে। পাঁচটা থেকে ছয়টার মধ্যে এসো, কেমন।
৩নং ওয়ার্ডে ঢুকতেই সেতুর চোখে চোখ পড়লো অপলার। হাসিহাসি মুখ নিয়ে বেডে বসে আছে সেতু। ওপাশের বেডে খালাম্মা। বুঝতে পারছিলো না ও, সবই তো ঠিক মন হচ্ছে; ব্যাপার কী!
– কি যেনো বলবেন, তখন ফোনে বলছিলেন?
– আর বলো না। গত পরশু থেকে শরীর খারাপ করেছে সেতুর । রাতে হঠাৎ বমি, সেই সাথে জ্বর। হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছি। ফিসফিস করে জানালো ওর বোন,
– এখন কি অবস্থা? ডাক্তার কি বললো?
হাত ধরে টেনে বারান্দায় নিয়ে আসলেন অপলাকে।
– কিছু রিপোর্ট করতে দিয়েছিল। ব্রেষ্টে ক্যান্সার ধরা পড়েছে। কতটুকু ছড়িয়েছে এখনো শিউর করতে পারছেন না ডাক্তার, আরো কিছু টেষ্ট করলেই বোঝা যাবে। ওনারা তো অভয় দিচ্ছেন আমাদের, চিন্তার কোন কারণ নেই। কিন্তু আমার কাছে লক্ষণ ভালো লাগছে না, অপু! ওড়না দিয়ে চোখ মুছতে থাকেন উনি।
– সেদিনও তো সুস্থই দেখলাম ওকে। কী অদ্ভুত ব্যাপার ! আশ্চর্য হয়ে গেলো অপলা।
– রোগটা এখন হয়নি, অপু। অনেক আগেই হয়েছে। আমার ধারণা, ও আমাদের জানায় নি, চেপে গেছে। ডাক্তার সেটাই বলতে চাইলো আমাদের।
মুহুর্তেই বিমর্ষ হয়ে গেলো অপলা। বারান্দা থেকে রুমে ঢুকতেই সেতুর নজর এড়ানো গেলো না। ওর মুখ দেখে কী বুঝে নিলো কে জানে! ইশারায় কাছে ডাকলো সেতু । নিজে থেকেই বললো,
– অতো চিন্তার কি আছে! সব ঠিক হয়ে যাবে, দেখে নিও। এই কথা শুনেই অবাক হয়ে গেল ও!
– ডাক্তার যখন তোমার পরিবারের সাথে কথা বলছিলেন, তখন তুমি ওখানে ছিলে?
– ছিলাম তো।
কিছু বলার মতো সাহস খুঁজে পাচ্ছিলো না অপলা। অনেকটা মুষড়ে পড়লো ও। মনে মনে ভাবছিলো, এই কথা শোনার পরও এতটুকু মনের জোর হারায় নি সেতু! এ যেনো সেতুরই অন্য এক আত্মা,বসে আছে ওর পাশে। সারাদিন অফিস করে এসে এরকম সংবাদ শুনে মাথা ভীষণ ব্যাথা করছিলো ওর। মনে হচ্ছিল, এখান থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বেরিয়ে যাওয়া প্রয়োজন।
৪
শরীরের হাবভাব মোটেও ভালো ঠেকছে না অপলার। জ্বর আসবে মনে হচ্ছে! এদিকে ছাদের সব গরম একসাথে বাসায় ঢুকে পড়েছে যেনো। রান্নাঘরেও ঢুকতে ইচ্ছে করছে না এখন। আজকাল বাসায় খাওয়ার তেমন কিছুই থাকে না। অনেক ঘাঁটাঘাঁটির পর প্লাস্টিকের বক্সের তলানিতে দু’য়েকটি বিস্কিট পাওয়া গেলো।
এরই মধ্যে হাসপাতাল থেকে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছিল সেতুকে। কোন এক ছুটির দিনে ওকে দেখতে গিয়েছিলো অপলা।
– তুমি মাঝেমধ্যে সময় পেলে সেতুকে দেখে যেও। বেচারা সারাদিন একা বিছানায় পড়ে থাকে। আর সইতে পারছি না! অপলার হাত চেপে ধরে অনুনয় করতে থাকে ওর বড় বোন।
– ওসব নিয়ে ভাববেন না তো। আমি তো আছি। ছুটির দিনে আমি সারাদিন এসে থেকে যাবো। অভয় দেয় অপলা। ‘ কিছু মনে করবেন না, আপা। এদেশে এই ধরণের চিকিৎসার জন্যে ঠিক ভরসা হয় না। চেন্নাই বা ভেলোর এ দেখাতে পারলে ভালো হতো।’
– কে নিয়ে যাবে বলো। তুমি পারবে? সব খরচ দিবো আমরা।
– তা ঠিক আছে। কিন্তু আমার তো পাসপোর্টই নাই।
– পাসপোর্টটা করে ফেলো। তোমারও নিজের প্রয়োজন হতে পারে একদিন।
– সেটাই ভাবছি, পাসপোর্টটা এবার করে ফেলা দরকার।
হঠাৎ একটি ঘটনা হুড়মুড় করে ঢুকে পড়লো এ সম্পর্কের মাঝে। মুহূর্তের মধ্যে জল ঢেলে দিলো যেনো সমস্ত আশা আকাঙ্ক্ষায়। সেতুর ফেসবুকে অপলার প্রাক্তন স্বামী শিশিরকে দেখেই নিজেকে আর সামলাতে পারলো না ও! ভেতরে ওৎ পেতে থাকা হিংস্রতা অভিমান হয়ে ফেটে পড়লো যেনো। রাগের মাথায়, সেতুর সাথে সব যোগাযোগ বন্ধ করে দিলো ও। সেতুই একদিন নিজে থেকে ফোন করলো অপলাকে।
– এই, কি হয়েছে তোমার? কোন খবর নাই? বাসায় ও আসো না কেন আজকাল?
– কই না তো, কিছু হয় নি তো। অফিসের কাজ নিয়ে এত ঝামেলায় ছিলাম, কোথাও যে যাবো তার ফুসরত ছিলো না। এই বলে একরকম এড়িয়ে গেলো অপলা।
– আমার কিন্তু তা মনে হয় না। তুমি কিছু একটা লুকাচ্ছো! আমাকে খুলে বলো,প্লিজ।
অনেক ভেবেচিন্তে কথা ক’টি বলার প্রয়োজন বোধ করলো অপলা। কোন ভনিতা ছাড়াই সেতুকে জানালো, ‘শিশির সম্পর্কে আগেই সবই খুলে বলেছিলাম আমি তোমাকে! এরপরও তোমার ফেসবুকের ফ্রেন্ড লিস্টে সে কী করে থাকে, সেতু? তোমার ফ্রেন্ড লিষ্টে শিশিরকে শো করছিলো, দেখলাম সেদিন। কষ্টে,যন্ত্রণায় কথাক’টি বলে যায় অপলা!
– ওহ্ , এজন্যই তুমি আমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করেছো! দেখো, তুমি বললেই আমি ওকে ব্লক করে দিতে পারি! কারণ সে শুধুই আমার ফেসবুক বন্ধু, আর কিছু না! স্বাভাবিক শোনালো ওর কণ্ঠ।
– তোমাকে বলতে হবে কেনো! এটা তোমার একান্তই নিজস্ব ব্যাপার। এই বিষয়ে কোন সিন্ধান্ত তোমার ওপর চাপিয়ে দিতে পারি না আমি! এটা ভালো দেখায় না, তাছাড়া এভাবে বলাও আমার উচিত হয়নি বলেই মনে হচ্ছে আমার এখন! অভিমানে ফেটে পড়ে অপলা।
অসুস্থতাকে ছাপিয়ে একসময় অভিমান শেকড়-বাকড় ছড়িয়ে রূপ নিলো এক পৈশাচিকতায়। মুহূর্তেই নিষ্ঠুর ও অমানবিক হয়ে ওঠলো ত্রিশোর্ধ এক নারী।
এরপর মাস পেরিয়ে বছর গড়ালো, বছর পেরিয়ে আরো একটি বছর; সেতুর দিকে থেকে সবধরনের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেলো একসময়। ফেসবুকও লক করে দিলো ও।
জীবন তার নিজস্ব গতিতেই এগিয়ে যায়। নানান ঝামেলা আর ব্যস্ততায় সেতু নামের এক নারীর অসুস্থতার খবরও ম্রীয়মান হয়ে গেলো একসময়।
বছর তিনেক পর অপলার এক বন্ধুই খবর দিলো মাস ছয়েক আগে মারা গেছে সেতু। নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিলো না যেনো ও। স্তব্ধ হয়ে যায় ও। অমনি বিছানার ওপর ধপাস করে বসে পড়ে অপলা ! চিৎকার করে কাঁদলে নাকি বুকের ভেতরটা হালকা হয়ে যায়। কিন্তু ওর চোখ থেকে তো একফোঁটা জলও গড়িয়ে পড়ছে না! দুমড়েমুচড়ে যায় ওর বুকের ভেতরটা। কুণ্ডলী পাকানো সাপের মতো ভাঁজ করা হাঁটুর ওপর মাথা গুঁজে বসে পড়ে অপলা।
অনুশোচনায় দগ্ধ হওয়া এক নারী নিজের সাথে নিজেই কথা বলে যায় যেনো।
‘আমি অপরাধী । আমি প্রতারক। একজন অসুস্থ মানুষের অসুস্থতার সুযোগ নিয়ে প্রতারণা করেছি! আমি খুনি, আমি অপরাধী। আমি জানি, এ অপরাধের কোন শাস্তি হয়না, শুধুই দগ্ধ হতে হয়!’
শেষমেশ হাউমাউ করে উদভ্রান্তের মতো কেঁদে ওঠে অপলা!’