একটা নৃশংস হত্যা
শম্পা সাহা
আমার নতুন ঠিকানার সামনেই এক বিরাট বিল্ডিং।তার সামনেও একটা বাড়ি।ওই বাড়ি আর বিল্ডিংয়ের ফাঁকে কি করে যেন সবার ভয়ানক রুক্ষতাপ্রিয় চোখকে ফাঁকি দিয়ে একটা বিরাট আমগাছ।
আমি যখন ডিসেম্বরের মাঝামাঝি আমার নতুন আশিয়ানায় উঠি,তখন সে পাতায় পাতায় ঝাঁকড়া।কি করে যেন এত ইট, কাঠ,পাথর, গাড়ি,মারাত্বক আধুনিকতার মধ্যেও একফালি সবুজের নেতৃত্ব দিচ্ছে সে। তাতে সকাল বিকেল কত যে পায়রা, কাক আর চড়ুইয়ের সভা বসতো,শালিকরা সব জরুরী আলোচনা সেরে নিতো সেই বিরাট আমের ডালের ,পাতার ফাঁকে বসে।
কোথা থেকে যেন দুটো বুলবুলিও এসে ফিদিন জানিয়ে যেত কলকাতা যতই প্রকৃতির গন্ধটুকু বুক থেকে একেবারে মুছে দিতে উঠে পড়ে লাগুক, প্রকৃতি কিন্তু তাকে একেবারে ভুলতে রাজী নয়।
বসন্তে কোকিল কোকিলা তাদের সাংসারিক আলোচনাও সারতো এর শাখায়।কখনো বা বুক ফাটা বিরহ আর মিলনের সুর সেধে যেত।
এরপর এল বসন্ত।গাছটার ডালে ডালে যেন বিপ্লব।এতো প্রাণ যে বুকে নিয়ে কেউ বসে থাকতে পারে,তা মুকুলের বহর না দেখলে বোঝা যেত না।আর মৌমাছি।তারা কি আর হার মানে? মুকুলের ভিড়ে যখন ডালের মাথাগুলো হারিয়ে যেতে বসেছে, মৌমাছিরাও তাদের আখের গুছিয়ে নিতে ব্যস্ত এরই মধ্যে কচি কচি সবুজ সবুজ আমের কুশি।সেগুলো ধীরে ধীরে যেন শৈশব ,কৈশোর পার করলো আমার চোখের সামনে।একসময় গাঢ় সবুজ থেকে ফ্যাকাশে, যৌবন পেরিয়ে পৌঁছোলো পরিণতির দিকে।দলছুট কারো কারো গায়ে লাগলো ফ্যাকাশে সবুজের বদলে হলদে ছোঁয়া।
সামনের বাড়িটার জানালা থেকে হাত বাড়ালেই পেরে ফেলা যায় সেই প্রায় পাকা আমগুলোকে।কিন্তু আমার একবারের জন্যেও মনে হয়নি ওগুলো পারা বা খাওয়ার জন্য।মনে হতো ওরা যেন আজীবন কাল ওভাবেই থেকে যাবে আর আমগাছটাও গর্বিতা,ফলবতী হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকবে এই দুই ইটকাঠের কাঠামোর মাঝে ,আদিমের প্রতিনিধি হয়ে।
আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে চা বসাতে যাবো,তখনো চোখ ভালো খোলেনি।কিছু একটা আওয়াজে,আওয়াজ লক্ষ্য করে তাকাতেই দেখি ,ওমা!সে ঝাঁকড়া গাছখানা কই? মাত্র দু একটা ডাল,মাথায় দুএকগাছা সবুজ পাতা নিয়ে দাঁড়িয়ে।আর এক বছর পঞ্চাশের বৃদ্ধ মুচড়ে মুচড়ে,পোঁচিয়ে পোঁচিয়ে কেটে ,ডালগুলো নিতান্তই অবহেলায় ছুড়ে ফেলছে নিচে।আমার বুকটা ছ্যাৎ করে উঠলো।হাহাকার করে উঠলো যেন! বিশাল এক শূণ্যতা!এক সবুজে সবুজ ফলবতী গাছ,একেবারে সতেজ! তাকে মানুষ কিভাবে কাটতে পারে?খটাশ খটাশ আওয়াজ করে হাতের দা পড়ছে ডালের উপর আর আমার মনে হচ্ছে কোপটা যেন পড়ছে আমার বুকের উপর।শিউরে উঠলাম, ন্যাড়া গাছ,শূণ্য ডাল আর নিচে স্তুপাকার সবুজ পাতা দেখে।ছিঃ!কি ঘেন্না!কি ঘেন্না!
ও তো কারো কোনো অসুবিধা করেনি।ক্ষতিও না।ও দুই বড় বিল্ডিংয়ের মাঝের এক ফাঁকে ডালপালা মেলে নিজের সংসার পেতেছে আজ কতগুলো বছর। ফলও দিত। তাহলে ওকে নিংড়ে নিঃশেষ করে কার কি লাভ? তবু ! সত্যিই মানুষ পারেও!নাঃ! আসলে মানুষই পারে অকারণে কষ্ট দিতে, আঘাত করতে ,হত্যা করতে।আমি আর ওই জানালা খুলতে পারছি না।খুললেই বুকটা হু হু করে উঠছে! জানি না ,ওর চোখের সামনে ভাসা কবে বন্ধ হবে? কবে আমি আবার ওই জানালাটা খুলতে পারবো?
©®
আমার নামটা কিভাবে যেন Stamps Saha হয়ে গেছে।টাইপোর কারণে হয়ত।ওটা Shampa Saha হবে😭😭
বিষয়টি ঠিক করা হল ।