Satyen Mondal

সত্যেন মণ্ডল

এক টুকরো আদর

সত্যেন মণ্ডল

                       

কেটলিতে জল টগবগ করে ফুটছে, কয়লার আঁচ ,মাঝে মাঝেই উনুনে কয়লা দিচ্ছে, তালপাতার পাখা দিয়ে উনুনে হাওয়া মারতে হচ্ছে, রাস্তার ধারেই নিরিবিলি পরিবেশে ঝুপড়ি চায়ের দোকান ।
সেই দোকানের কাছে ছ’ বছরের নীচের প্রায় গোটা চারেক বাচ্ছা অকাজ কুকাজ খেলাধুলো করছে। একটি মাঝবয়সি মহিলা ছেলেগুলোর মাঝে বসে রয়েছে,মহিলাকে দেখে মনে হল অন্তঃসত্ত্বা, অর্থাৎ আবার একটি বাচ্ছা আসছে এবং ঐ বাচ্ছা গুলোও তার ,যে লোকটা মাঝে মাঝেই চা করে খরিদ্দার কে দিচ্ছে সে ঐ মহিলারই স্বামী।

দুপুর প্রায় পৌনে তিনটে, এ রাস্তায় খদ্দের প্রায় এখন নেই, মাঝে মাঝেই দু একটা টাঙাওলা আসছে, কিছুক্ষন বাঁশের পাড়াতে বসে তরিবৎ করে চা খেয়ে গন্তব্যে চলে যাচ্ছে।
বিছানায় শুয়ে ঘুম আসছিল না তন্ময়ের, এই চারতলা লজের দোতলার বারান্দা থেকে, রাস্তার বিপরীতে ঐ চায়ের দোকান । সেটাই এতক্ষণ ধরে লক্ষ্য করছিল তন্ময়, এক রকম তন্ময় হয়েই।
ক দিনের জন্য পাহাড় ঘুরবে বলে অফিসের বন্ধুদের সঙ্গে রাজগীর এসেছে তন্ময়, গতকাল রাতে যখন ট্রেন থেকে স্টেশনে নেমে টাঙায় ওঠে তখন দেখে পাহাড়ের চারদিকে আলোর বন্যা বইছে, ব্যাপার কি ? টাঙাওলা বলে, হুজুর এক এক যুগ বাদ মে রাজগীর পাহাড় কা পাশ মেলা বসতা হ্যায়, উসিকা ছবি হ্যায়। বেশ ভাল লেগেছিল পরিবেশটা।

তবে এই নিরিবিলি নির্জন রাস্তার ধারে লজটা ওর ভাল লাগেনি, এই দুপুরে বন্ধুরা বিছানায় শুয়ে নাক ডাকালেও, ও উঠে এসে বারান্দার চেয়ারে।
তন্ময় শ্যেন দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল চায়ের দোকানে,দেখল লোকটা উনুন থেকে কেটলি তুলে একটা মাঝারি মাপের সিলভারের হাঁড়িতে জল দিয়ে উনুনে বসিয়ে দিল, কিছুক্ষন পরে তাতে চাল ধুয়ে দিল এবং একটা ঢাকনা হাঁড়ির মুখে দিল তারপর পাখা নিয়ে উনুনের মুখে হাওয়া দিতে লাগল।
তন্ময় বুঝতে পারে বেলা গড়িয়ে গেলেও এখনও কারোর খাওয়া দাওয়া হয়নি তারই তোড়জোড় চলছে, এই দৃশ্য গুলো যে খুবই দেখার তা নয় তবুও সে দেখছিল।অন্তঃসত্ত্বা মহিলা খুবই কাহিল বলে মনে হলো, খুব শীঘ্রই আবার বাচ্ছা হবে,তাই সে তিনহাঁটু হয়ে চুপচাপ বসে ছিল।

তন্ময় দেখল রাস্তার অন্য দিক থেকে ঝাকাতে কচি মূলা সমেত শাক বিক্রি করতে যাচ্ছিল এক বিক্রেতা ,সম্ভবত তার নিজের তৈরি ফসল, তার থেকে খানিকটা কিনল।
এরপর শাকগুলো লোকটা কুঁচো কুঁচো করে কাটল এবং যে টুকু মুলো পেলো ডুং ডুং করে কেটে রাখল।
ভাত সম্ভবত হয়ে গেছে, সেটা তুলে একটা কড়াই গরম করে শাকগুলো তাতে দিয়ে সামান্য একটু জল ঢেলে দিল এবং কিছু একটা দিয়ে ঢাকা দিল। কিছুক্ষণ পরে শাকের অতিরিক্ত জল ফেলে সেগুলো ভেজে নিল।

খাওয়া দাওয়ার পালা শুরু হল, একটা বড় গামলায় ভাত বাড়া হল ,লবণ দিয়ে মাখানো হল, সম্ভবত ভাত থেকে সব ফ্যান আগে ফেলেনি, এবার মুলো শাক ভাজা আর কচি ডুমো করে কাটা মুলো সহযোগে চারটি কচি হাত আর একটা বড় হাতে চললো পরমান্ন খাওয়া। ক্ষুধার্তদের খাওয়া দেখে তন্ময়ের মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল।
তন্ময় ভাবতে থাকে জীবনে সে কখনও এমন মেনু খেয়েছে কি ? এভাবে যারা বড় হয় তাদের দেখলে সত্যিই বড় কষ্ট হয়।
ওদের খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষ হলে বাচ্চারা কাছাকাছি খেলাতে মেতে উঠল,লোকটা আবার কেটলি উনানে বসিয়ে হাওয়া দিতে লাগল।

এতক্ষণ পর মহিলা কোনরকমে উঠল,তারপর হাঁড়িতে থাকা বাদবাকি ভাত ওদের খাওয়া গামলাতে নিয়ে খেতে শুরু করল পরম তৃপ্তিতে। এর মধ্যে লোকটা হাওয়া দেওয়া বন্ধ করে নিজের স্ত্রীর পাশে দাঁড়িয়ে, তন্ময় দেখল লোকটা পরম স্নেহে মহিলার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন মহিলা স্বামীর তৈরি পরমান্ন তৃপ্তি সহকারে খেয়ে যাচ্ছে।
এমন অপরূপ দৃশ্য এর আগে তন্ময় কখনও দেখেনি।
আলাদা আর এক অনভূতি ওর মনকে দুর্বল করেদিল
ওর স্ত্রী শুভাকে ও তো এমনভাবে কোনদিন আদর করেনি। শুভা সন্তানহীনা বলে কি ? না কি অন্য কিছু।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *