Sankar Brahma

প্রবন্ধ

        যুদ্ধের পরে কাম্যু ফ’রের সঙ্গে প্যারিসে বাস করতে লাগলেন। ১৯৪৫ সালে জ্যঁ এবং ক্যাথারিন নামে তাঁদের দুটি যমজ কন্যা হয়। কাম্যু এইসময় একজন খ্যাতনামা লেখক হয়ে ওঠেন। তাঁর খ্যাতির মুখ্য কারণ ছিল প্রতিরোধের ক্ষেত্রে তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহণ। দুটি পৃথক ভ্রমণে তিনি উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষণ দেন। তিনি আরো একবার আলজেরিয়াতে ভ্রমণ করেন; কিন্তু সেখানকার অত্যাচারী ঔপনিবেশিক নীতি দেখে তিনি হতাশ হন। তিনি এই নিপীড়নের বিরুদ্ধে বহুবার সোচ্চার হয়েছিলেন।

এই সময় প্রবন্ধ ল’হোম্মি রিভোল্টি (দি রেবেল) লেখার মধ্যে দিয়ে তাঁর সাহিত্যকর্মের দ্বিতীয় চক্র সম্পূর্ণ হয়। এই বইয়ে কাম্যু সর্বগ্রাসী সাম্যবাদকে আক্রমণ করেন এবং স্বাধীনতাপন্থী সমাজতন্ত্র ও ট্রেড ইউনিয়নভিত্তিক নৈরাষ্ট্রবাদের পক্ষে সোচ্চার হন। কমিউনিজমকে বাতিল করার জন্য তিনি তাঁর অনেক ফরাসি সহকর্মী ও সমসাময়িকদের বিরাগভাজন হন এবং এই বইটির কারণে তাঁর সার্ত্রের সঙ্গে চিরবিচ্ছেদ হয়। আলজেরিয় যুদ্ধের সময় থেকে মার্ক্সবাদী বামপন্থীদের সাথে তাঁর সম্পর্কের আরো অবনতি হয়।

কাম্যু বিভিন্ন প্রান্তিক সংস্থার ইউরোপীয় সংহতির জোরালো সমর্থক ছিলেন। ১৯৪৪ সালে তিনি কমিটি ফ্রান্সিস পোর লা ফেডেরেশন ইউরোপিন্নে – (সিএফএফই (ফ্রেঞ্চ কমিটি ফর দি ইউরোপিয়ান ফেডেরেশন)) – প্রতিষ্ঠা করেন এবং ঘোষণা করেন ইউরোপ “একমাত্র তখনই অর্থনৈতিক উন্নতি, গণতন্ত্র এবং শান্তির পথে এগোবে যখন এর রাষ্ট্রগুলো একটা যুক্তরাষ্ট্র হয়ে উঠবে।” ১৯৪৭-৪৮ সালে তিনি গ্রুপস্‌ ডি লিজ্যঁ ইন্টারন্যাশেনেল (জি.এল.আই) প্রতিষ্ঠা করেন যেটি ছিল একটি বৈপ্লবিক ক্ষেত্রে ট্রেড ইউনিয়নভিত্তিক আন্দোলন।

আঁদ্রে ব্রেটনের নেতিবাচকতা এবং শূন্যতাবাদকে পরিত্যাগ করে  পরাবাস্তবতা এবং অস্তিত্ববাদের ইতিবাচক দিকগুলোকে প্রকাশ করাই তাঁর মূল উদ্দেশ্য ছিল। কাম্যু হাঙ্গেরিতে সোভিয়েত হানার বিরুদ্ধে এবং স্পেনে ফ্রাঙ্কোর শাসনব্যবস্থার সর্বগ্রাসী মনোভাবের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন।

কাম্যু অনেকগুলো সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন, বিশেষত স্পেনদেশীয় অভিনেত্রী মারিয়া কাসারেসের সঙ্গে তাঁর অনিয়মিত সম্পর্ক ছিল যা শেষমেশ জনসমক্ষে প্রকাশিত হয়। এই অভিনেত্রীর সঙ্গে তাঁর প্রচুর চিঠিপত্রের আদানপ্রদান হয়েছিল। ফ’রে এই সম্পর্ককে হাল্কাভাবে নিতে পারেননি।

তিনি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন এবং ১৯৫০এর দশকের প্রথমদিকে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। কাম্যু এই ঘটনায় অপরাধবোধে ভুগতে শুরু করেন, তিনি জনসমক্ষ থেকে নিজেকে সরিয়ে আনেন এবং কিছু সময়ের জন্য তিনি সামান্য অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েন।

    ১৯৫৭ সালে কাম্যু খবর পান যে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করতে চলেছেন। এটা তাঁর কাছে একটা বড়ো ধাক্কার মত ছিল। তিনি মনে করেছিলেন আঁদ্রে ম্যালরক্স এই মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কারের অধিকারী হবেন। ৪৪ বছর বয়সে তিনি দ্বিতীয়-সর্বকনিষ্ঠ প্রাপক হিসেবে পুরস্কার লাভ করেন। এক্ষেত্রে ৪২ বছর বয়সী প্রাপক রুডিয়ার্ড কিপলিংয়ের পরেই ছিলেন তিনি।

১৯৫৭ সালে ৪৪ বছর বয়সে, নোবেল ইতিহাসের দ্বিতীয়-কনিষ্ঠতম প্রাপক হিসেবে, তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। 

তাঁর কাজগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল – 

১). দি স্ট্রেঞ্জার (The Stranger) , 

২). দি প্লেগ (The Plague) , 

৩). দি মিথ অফ সিসিফাস (The Myth of Sisyphus) , 

৪). দি ফল (The Fall), 

৫). দি রেবেল (The Rebel), 

৬). দি আউটসাইডার (The Outsider) প্রভৃতি।

 এরপরেই তিনি তাঁর আত্মজীবনী লে প্রিমিয়ার হোম্মে (দি ফার্স্ট ম্যান) নামক তাঁর আত্মজীবনী লিখতে শুরু করেন এবং এইভাবে তিনি “নৈতিক শিক্ষা” নিয়ে পরীক্ষার করতে উদ্যোগী হন। তিনি আরো একবার থিয়েটারের দিকে ঘুরে দাঁড়ান। নোবেল পুরস্কারের টাকা দিয়ে তিনি দস্তয়েভস্কির উপন্যাস ডেমনস্‌-এর নাট্যরূপায়ণ এবং পরিচালনা করেন। নাটকটি ১৯৫৯ সালের জানুয়ারীতে প্যারিসের আন্তোইন থিয়েটারে মঞ্চস্থ হয় এবং সমালোচকদের প্রশংসা অর্জন করে।

         এই সময়কালে তিনি দার্শনিক সিমোন ওয়েলের সাহিত্যকর্মগুলোকে তাঁর মৃত্যু-পরবর্তীকালে প্রকাশ করেন; এস্পোর (হোপ) নামক ধারাবাহিক হিসাবে সেই লেখাসমূহ এডিশনস গালিমার্ড প্রকাশ করে। ওয়েলের কাজ কাম্যুর ওপর গভীর প্রভাব ফেলে এবং কাম্যু মনে করতেন ওয়েলসের লেখা শূন্যতাবাদের যোগ্য প্রত্যুত্তর। কাম্যু তাঁকে “আমাদের সময়ের একমাত্র মহান ব্যক্তিত্ব” বলে বর্ণনা করেছেন।

        ফ্রান্সের ভিল্লেব্লেভিন শহরে কাম্যুর স্মৃতিসৌধের ওপর ব্রোঞ্জের প্লেট। ফরাসী থেকে অনুদিত, যাতে লেখা আছে: “ইয়োন্নে বিভাগের সাধারণ পরিষদের পক্ষ থেকে, লেখক আলবের কাম্যুর শ্রদ্ধাস্বরূপ, যাঁর দেহাবশেষ ভিল্লেব্লেভিনের টাউন হলে ৪ঠা থেকে ৫ই জানুয়ারী, ১৯৬০এর রাত্রিতে সংরক্ষিত রাখা হল”

ভিল্লেব্লেভিনে নির্মিত কাম্যুর সমাধিস্তম্ভের একটি আলোকচিত্র।

ভিল্লেব্লেভিনে কাম্যুর সমাধিস্তম্ভ, যেখানে তিনি 

 ১৯৬০ সালের ৪ঠা জানুয়ারী, ৪৬ বছর বয়সে ভিল্লেব্লেভিন নামক ছোট শহরের লে গ্রাঁদ ফসার্ডে সেন্সের কাছে একটি গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা যান। তিনি ১৯৬০ সালে পরিবারের সাথে তাঁর লোরমারিন, ভ’ক্লুজের বাড়িতে ইংরেজি নববর্ষের ছুটি কাটিয়েছিলেন; সেখানে তাঁর এডিশন গালিমার্ডের প্রকাশক মাইকেল গালিমার্ড, গালিমার্ডের স্ত্রী জানাইন এবং তাদের কন্যাও ছিল।

কাম্যুর স্ত্রী এবং মেয়েরা ২রা জানুয়ারী ট্রেনে করে প্যারিসে ফিরে যায়, কিন্তু কাম্যু গালিমার্ডের বিলাসবহুল ফাসেল ভেগা এইচ.কে ৫০০তে ফিরবেন বলে ঠিক করেন। রুট ন্যাশানাল ৫ (বর্তমান আর.এন ৬) এর দীর্ঘ সোজা রাস্তায় চলার পথে গাড়িটি একটি গাছে ধাক্কা মারে। কাম্যু তৎক্ষণাত মারা যান।

তিনি আরোহীর আসনে বসেছিলেন এবং সিট বেল্ট পরেননি। গালিমার্ড কয়েকদিন বাদে মারা যান। যদিও তাঁর স্ত্রী এবং কন্যা অক্ষত ছিলেন। অনেকে মনে করেন, কেজিবির গুপ্তচর বাহিনীই কাম্যুকে হত্যা করে, কারণ তিনি সোভিয়েত অত্যাচারের প্রবল সমালোচক ছিলেন।

গাড়ির ধ্বংসাবশেষের মধ্যে থেকে লে প্রিমিয়ারে হোম্মে (দি ফার্স্ট ম্যান) এর ১৪৪ পাতার হস্তলিখিত পাণ্ডুলিপি উদ্ধার হয়। কাম্যু মনে করতেন তাঁর আলজেরিয়ার ছোটবেলার দিনগুলো নিয়ে রচিত এই অসমাপ্ত উপন্যাসটিই হবে তাঁর সবচেয়ে সেরা সাহিত্যকর্ম। কাম্যু যেখানে বাস করতেন, ফ্রান্সের সেই ভ’ক্লুজেই লোরমারিন সেমেটারিতে তাঁকে কবর দেওয়া হয়। তাঁর বন্ধু সার্ত্রে একটি শংসাপত্র পাঠ করেন, কাম্যুর বীরত্বপূর্ণ “একরোখা মানবতাবাদের” জন্য তাঁকে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।

উইলিয়াম ফকনার তাঁর শোকগাথায় লিখেছিলেন, ‘যখন তাঁর জন্য দরজা বন্ধ হয়ে গেল, তার আগেই তিনি দ্বারের এপাশ থেকে লিখে গেছিলেন – প্রতিটি শিল্পীই যাঁরা সারাজীবন ধরে সেই একই পূর্বজ্ঞান এবং মৃত্যুঘৃণা বয়ে নিয়ে চলে তাঁদের সকলের থেকেই এই লেখা আশা করা যায় – আমি এখানে ছিলাম।”

         কাম্যু সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির পরে স্টকহোমের লুসিয়াকে মুকুট পরিয়ে দিচ্ছেন।

কাম্যু সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির তিনদিন পরে ১৯৫৭ সালের ১৩ই ডিসেম্বর স্টকহোমের লুসিয়াকে মুকুট পরিয়ে দিচ্ছেন।

কাম্যুর ১৯৩৬ সালে তিনজন বন্ধুর সাথে প্রথম একটি নাটক প্রকাশ করেন যার নাম ছিল রিভোল্ট ডান্স লে আস্তুরিয়ে (রিভোল্ট ইন দ্য আস্তুরিয়াস)। এর বিষয়বস্তু ছিল ১৯৩৪ সালে স্পেনীয় খনিশ্রমিকদের বিদ্রোহ যা তৎকালীন স্পেন সরকার অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে দমন করে যার ফলে ১৫০০ থেকে ২০০০ জন শ্রমিক মারা যান। ১৯৩৭ সালের মে মাসে তিনি তাঁর প্রথম বইটি লেখেন ল’এনভারস এট ল’এন্ড্রয়েট (বিটয়েক্সট অ্যান্ড বিটুইন, দি রং সাইড অ্যান্ড দি রাইট সাইড নামেও অনুদিত হয়েছিল)। দুটি বইই এডমণ্ড শার্লট নামে একটি ছোট প্রকাশনী সংস্থা প্রকাশ করেছিল।

(ক্রমশঃ)

#দ্বিতীয়_পর্বের_লিঙ্ক 

https://www.facebook.com/groups/sahityapatrika/permalink/1104956846828222/

web to story

শংকর ব্রহ্ম

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *