Sankar Brahma

প্রবন্ধ

প্রথম_পর্ব

    জন হোয়ার আপডিকের জন্ম হয় ১৮ই মার্চ, ১৯৩২ সালে । তিনি একাধারে ঔপন্যাসিক, কবি, লেখক, শিল্প ও সাহিত্য সমালোচক।

          আপডিকের লেখা বিখ্যাত Couple (দম্পতি) উপন্যাসটি গড়ে উঠেছে শহরতলির তিন-চার জোড়া সদ্যবিবাহিত দম্পতির ভেতরকার জটিল সম্পর্ক নিয়ে। এই গ্রন্থে অনেক খোলামেলাভাবে আমেরিকার পারিবারিক-সামাজিক জীবনের ভেতরের ক্ষত-আর্থিক পছন্দ ও বিলাস চিহ্নিত ভোগবাদী মার্কিনিদের একান্ত অস্বস্তির জায়গাটি লেখক চিত্রিত করেছেন। এই কাজ সৎভাবে, সমধর্মী সমাজে বেঁচে থেকে নানা ধরনের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার তরঙ্গে দুলেও যতদূর সম্ভব সৎ ও আন্তরিকভাবে সম্পন্ন করতে পেয়েছেন এর লেখক। 

ফলে ১৯৬৮ সালে প্রকাশিত নবেলটি স্বভাবতই তুমুল আলোচনার সূত্রপাত করে। তর্ক-বির্তক দীপ্ত এসব আলাপের ঢেউ বৃদ্ধিকৃত্তিক সাহিত্যের পরিমন্ডল পেরিয়ে সাহিত্যমোদি বিচিত্র সব পারিবারিক বৃত্তে এমনটি নানা রকম পেশাজীবী বৃত্তের গিয়ে লাগে। কেননা, আপডাইক শুধু মানসলোকের টানাপড়েনের ছবিই আঁকেননি, ঐশ্বর্য ও ক্ষমতা দর্পে প্রায়ান্ধ একটি সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রের ভেতরের গলদ নানাবিধ অসঙ্গতি ও ভন্ডামির চেহারাও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন।

 ঈড়ঢ়ষবং-কে কেন্দ্র করে জমে ওঠা বিতর্ক একদিকে মননজীবী অগ্রসর সমাজের চিত্তবিনোদনের উৎস হয়েছে, অন্যদিকে তা বিপুলভাবে সাহায্য করেছে গ্রন্থটিকে বেস্ট সেলার হতে। উল্লেখ্য, প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে একটানা চার বছর এই উপন্যাস ছিল সর্বোচ্চ বিক্রির তালিকায়। আপডাইক জন্ম ও বেড়ে ওঠার সূত্রেই রক্ষণশীল পরিবারের রীতিনীতিগুলোর সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল শিলিউটন (পেনসিলভেনিয়ার ছোট্ট শহর)সহ যুক্তরাষ্ট্রের আরো কিছু ছোট শহরের মানুষের মূল্যবোধ ও জীবনযাপনরীতি সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা।

 ওইসব ছোট শহরের মানুষ ছিলেন প্রটেস্ট্যান্ট মতবাদের অনুসারী এবং তারা ছিলেন মধ্যবিত্ত মূল্যবোধে আচ্ছন্ন। কিন্তু শত শত বছর ধরে অক্ষুণ্ন ওই মূল্যবোধে চিড় ধরে যায় বিশ্বযুদ্ধোত্তর আর্থসামাজিক পরিস্থিতি প্রভাবে। কেননা, ততদিন যৌনতা সম্পর্কিত নতুন চেতনা এবং নারী পুরুষের বিবাহ বহির্ভূত দৈহিক মানসিক সম্পর্ক ধীরে ধীরে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। লেখক এসব বিষয়কেই উপজীব্য করেছেন। এই উপন্যাসে দেখা যাচ্ছে যৌনতার খোলামেলা প্রকাশ আর পাত্র পাত্রীদের বল্গাহীন ফুরফুরে মানসতার ছবি। এই গ্রন্থই আপডাইককে শহরতলির ব্যভিচারী জীবনের রূপকার হিসেবে পরিচিত ও প্রতিষ্ঠিত করে তোলে। 

এটা লেখকের প্রথম উপন্যাস। পাঠকপ্রিয় হওয়ার ফলে বইটি যে কেবল লেখককে প্রতিষ্ঠা এনে গিয়েছিল তা-ই নয়, গ্রন্থটির সাফল্য তাকে গুরুত্বপূর্ণ গগেনহাইম ফেলোশিপ পেতেও সাহায্য করেছিল। আপডাইক ওই আর্থিক অনুদান পাওয়ার পর উৎসাহী হয়ে তার বিখ্যাত খরগোশ সিরিজের বইগুলো ( মোট চারটি) লিখতে আরম্ভ করেন। চার পর্বে সমাপ্ত উপন্যাস চতুষ্টয়ের প্রথমটির  প্রকাশকাল ১৯৬০। দশ বছরের বিরতির পর প্রকাশিত হয় দ্বিতীয় খন্ড(১৯৯১) এরও দশ বছর পর তৃতীয় খন্ড (১৯৮১)। শেষেরটি প্রকাশ পায় নয় বছর পর (১৯৯১)। খরগোশ হচ্ছে ছোট শহরের একজন খেলোয়াড়ের নাম। এ ধরণের মানুষের সঙ্গে আমাদের মাঝে-মধ্যেই সাক্ষাৎ হয়। পুরো নাম হ্যারল্ডর্ যাবিট অ্যাংস্টম। 

চরিত্রটি মোটেই বুদ্ধিদীপ্ত নয়। অন্ত্যজ শ্রেণির প্রতিনিধিকে নিরাসক্তভাবে কিন্তু দরদ দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন আপডাইক। তার অর্থনৈতিক অবস্থা, আকাঙ্ক্ষা অভিরুচি, স্বপ্ন-কল্পনা ও মানসিক পরিস্থিতি চমৎকারভাবে বর্ণিত হয়েছে এখানে। কাহিনীর কুশীলবরা মেধাবী না হলেও এ জাতীয় নীচু শ্রেণীর মানুষকে নিয়ে রচিত গল্পেও লেখক বুদ্ধিদীপ্ত মননের ছবি আঁকতে পারতেন। লেখকের নিজের চেহারা-চরিত্রই এক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করত বলে মনে হয়। 

দেখা যাচ্ছে, 'খরগোশ' সিরিজের প্রথম বই বেরোয় ১৯৬০ সালে আর শেষ বইটির প্রকাশকাল ১৯৯০। মাঝখানে ত্রিশ বছরের ব্যবধান। এই দীর্ঘ সময়ের ভেতর মানুষের চিন্তা ধারা ও লাইফস্টাইল অনেকখানিই বদলে গিয়েছিল। মার্কিন সমাজের পটভূমিতে পৃষ্ঠ এই পরিবর্তনের জীবনঘনিষ্ঠ পরিচয় ধৃত আছে সিরিজের তৃতীয় ও চতুর্থ উপন্যাসে। আপডাইককে এনে দিয়েছিল জনপ্রিয়তা। 'খরগোশ' সিরিজের উপন্যাসগুলো তাকে দেয় সত্যিকার প্রতিষ্ঠা ও খ্যাতি। আর 'রেচ' সিরিজের উপন্যাসমালা সেই খ্যাতিতে যোগ করে বর্ণাঢ্যতা। 

যে বৈচিত্র্যের অন্বেষণ তিনি সারা জীবন ধরে করেছেন, তার অনেকটাই পূরণ হয়েছে এই সিরিজের দ্বিতীয় বই প্রকাশ পাওয়ার এক বছর আগেই, অর্থাৎ ১৯৭০ সালে জন আপডাইকের 'বেচ' সিরিজের প্রথম বই  প্রকাশিত হয়। সম্পূর্ণ নতুন এক চরিত্রের মুখোমুখি হলো পাঠক। কাল্পনিক এক ঔপন্যাসিককে নিয়ে এই উপন্যাস। বেচের আশা-উচ্চাশা, মানসবিভ্রান্তি, স্বপ্ন-কল্পনা, নিঃসঙ্গতা ও অনিরামেয় মনোবেদনা অসাধারণ দক্ষতায় ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন লেখক এখানে। সমকালের মূল্যবোধ, সুযোগের আরও নানা বৈশিষ্ট্য যুক্ত হয়েছে লিপিকুশলতা ওই মুন্সীআনার সঙ্গে। সিরিজের দ্বিতীয় গ্রন্থ প্রকাশকাল ১৯৮২ সাল।

 শেষ বইটি আলোর মুখ দেখে ১৯৯৮সারে। দুই যুগের বেশি সময় ধরে লেখক বই তিনটি লেখা শেষ করেছেন। তার খ্যাতির পালে জোর হাওয়া লাগিয়েছে সিরিজের শেষ গ্রন্থটি। এই সমস্ত কাজের জন্য জন আপডাইককে আধুনিক মার্কিন কথাসাহিত্যের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব হিসেবে গণ্য করা হয়। পরিণত বয়সে তার গদ্য হয়ে উঠেছিল মেদহীন স্বাতন্ত্র্যচিহ্নিত এবং ভাবনা স্বচ্ছল। 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *