রসময় লঘু রচনার আড়ালে মানবজীবনের গভীর পরিচয়

তৈমুর খান

রসময় লঘু সাহিত্য যাকে রম্য রচনা হিসেবে গণ্য করা হয়, লাতিন পরিভাষায় একেই বলে বেলে লেটার(Belles Lettres)। লেখকের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, কল্পনা ও উপলব্ধির রসময় রচনা যা হাস্যপরিহাসের মধ্য দিয়ে হালকা চালে লিখিত হয়। যদিও হালকা চালে লেখা, তবু এই রচনার মধ্যে গভীর কোনো আবেদন থাকে, মানবজীবনের কোনো তাত্ত্বিক নির্দেশ থাকে, সর্বোপরি বাস্তবতা এবং মননশীলতাও আবৃত হয় হাস্যরসের গাঢ় আস্তরণে।
তাই শাণিত বুদ্ধিদীপ্তির যেমন লুকানো চাবুক থাকে, তেমনি লেখকের বহুমুখী প্রজ্ঞার সমাবেশও লক্ষ করা যায়। এই কথাগুলির সম্পূর্ণ সমর্থন মিলবে সম্প্রতি প্রকাশিত রেজানুল করিমের ‘ঝাঁজালো হাসি’ (প্রথম প্রকাশ ফেব্রুয়ারি ২০২২) গ্রন্থটিতে। মোট ৩৩ টি রম্যগল্প নিয়ে গ্রন্থটির সম্পূর্ণতা।
গ্রন্থের প্রতিটি গল্পেরই সূচনা হয়েছে আমাদের মানবসমাজের বাস্তবজীবনের কোনো ঘটনাকে কেন্দ্র করে। গল্পের চরিত্রগুলির মধ্যেই যেমন ত্রুটি-বিচ্যুতির বীজ লুকানো আছে, তেমনি নানা বিড়ম্বনাও সৃষ্টি হয়েছে। আর এই বিড়ম্বনাই আমাদের হাসির কারণ হয়ে উঠেছে। তবে এই হাসির মধ্যেও কখনো কখনো বিষণ্নতার ছায়াপাতও ঘটে। এইজন্য আমাদের অসতর্কতা, বোকামি, বেখেয়াল এবং আনাড়িপনা দায়ী।
কোভিড কালে টাকাকেও স্নান করাতে হয় তারপর রোদে শুকাতে হয়। জীবাণু লেগে থাকার কারণে কেউ সহজে কুড়িয়েও নিতে চায় না। তখন টাকাতে টাকাতে সংলাপ শোনা যায়। মাস্ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক, কিন্তু অনেকেই ব্যবহার করেন না। না-ব্যবহারকারীদের মধ্যে যদি দাগি আসামি থাকে তাকেও লকআপে পুরতে হয়। মাস্কের বহু ধরন দারোগাবাবু বুঝতে পারেন না। তাই তাকেও হেনস্থা হতে হয়। জমজ সন্তানের নাম হয় ‘সুসময়’ ও ‘অসময়’। একই রকম দেখতে বলে তাদের চেনার ক্ষেত্রেও বিড়ম্বনা হয় বিদ্যালয়ে।
দুজনেই শেষ পর্যন্ত পড়াশোনায় ইতি টেনে সামাজিক কাজে বীরযোদ্ধা হয়ে ওঠে এবং হিরো নাম্বার ওয়ান হয়। দুই বন্ধুর বিরিয়ানি প্রীতি এবং বিরিয়ানি নিয়ে গবেষণা পাঠকের কাছে ও কৌতূহলোদ্দীপক। তাদের মুখেই জানা যায় বিরিয়ানির আবিষ্কারের কাহিনি। শাহজাহানের স্ত্রী মমতাজ বেগমের নির্দেশে মোগল সৈনিকরা মাংসসহ চাল একসঙ্গে রান্না করত। আবার তৈমুর লং এর সৈন্যদেরও সেই ভাবে রান্না করে খাওয়ানো হতো।
ফারসি শব্দে বিরিয়ানি, বাংলায় তাকে পলান্ন বলা হয়। দুই গ্রামের দুই প্রতিবেশী গিন্নির ঝগড়া এবং ঝগড়ার ভাষা বেশ মজার। মশাদের মিটিং এবং মানবসমাজের ক্ষতি করার কৌশল ও তাদের কথাবার্তা অনেক ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক নেতাদের মতোই মনে হবে। মশার রক্ত খাওয়ার অধিকার যেন আইনসম্মত। বয়স্ক জেঠিমা স্মার্ট ফোন পেয়ে নানা অঘটন ঘটিয়ে ফেলেছে।
এমার্জেন্সি নাম্বারগুলিতে আঙুলের কেরামতিতে কল্ চলে গেছে। ফলে ছুটে এসেছে অ্যাম্বুলেন্স, ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি। নিজের ছবির বদলে ডিপিতে বসেছে এসপির ছবি। হোয়াটসঅ্যাপে কলমিস্ত্রিকে ‘দশটায় আসিস’ ম্যাসেজ লিখতে গিয়ে লেখা হয়েছে ‘দশটা হাসিস’। ফলে নারকোটিক্স ডিপার্টমেন্টের অফিসারদের মনে সংশয় জাগিয়েছে। কলকাতা শহর থেকে গ্রামের মায়ের বাড়িতে বহু পোঁটলাপুঁটলি বেঁধে নিয়ে গেছে। কী আছে সেইসব পোঁটলাপুঁটলিতে?
সকলের চোখেই জিজ্ঞাসা। শেষে দেখা গেল অনেক পুরনো কাপড়চোপড় যা প্রতিবেশীদের দেওয়ার জন্য আনা হয়েছে। তাই এসবের উল্লেখ করে বলেছে: ‘এগুলো সব মেয়ে কুত্তা, তাই কুত্তি’? আসলে ‘কুর্তা’ এবং ‘কুর্তি’ গ্রামের লোকে জানে না তাই এমন বিকৃতি। ফেরত আসার সময় গ্রামের লোকেরা প্রতিদান দিয়েছে ছাই, নারকেল ছোবড়া, ঝাঁটার কাঠি ও খড়ের আঁটি। যা অবশ্য পরে কাজে লেগেছে। কিন্তু তাদের দিয়ে আসা বোতলে ভরা হলুদ রঙের তরল যা গোমূত্র ভেবে ফেলে দেওয়া হয়েছে। আসলে তা ছিল অ্যাপেল সিডার ভিনিগার।
কত বিচিত্র মানুষের মিছিল প্রতিটি গল্প বিশ্লেষণ করলেই উঠে আসবে। তাদের বিচিত্র চালচলন, নেশা, অভ্যাস। যেমন সদানন্দ এমন একটি চরিত্র যে সকলকে কাতুকুতু দিয়ে আনন্দ পায়। কিন্তু বিবাহিত জীবনে নতুন বউয়ের পায়ে সুড়সুড়ি দিয়ে সদানন্দ বিপদে পড়ে যায়। শিক্ষা পায় কাউকে আর সুড়সুড়ি না দেওয়ার। বটুক বাবু চরিত্রটি বেশ রঙ্গপ্রিয়। আম নিয়ে তার বিচিত্র কথাবার্তায় পাঠকও বেশ মজা অনুভব করেন।
তেমনি চা নিয়েও তার চা চর্চা কৌতূহল উদ্রেক করে। লেখক যেন তার মধ্য দিয়ে বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন। কাবাবের দোকানেও শামি কাবাব বানাতে বলে তিনি গুন গুন করে গান ধরেন। সিনেমার নায়ক নায়িকারা তার কণ্ঠে ভিড় করে আসে। সিনেমা দেখার মুহূর্তটি চেতনাপ্রবাহ জেগে ওঠে। স্ত্রীকে সম্বোধনের ভাষাও বড় মজার: ‘রাব্বিয়াতুল বাইত’, ‘কুইন অফ দা হাউস’, ‘বাড়ির রানি’। গিন্নি তার মতলব জানতে চাইলে, তিনি বললেন: ‘শামি কাবাব খাবে?’
স্ত্রী তা না বুঝতে পেরে রেগে গিয়ে বললেন: ‘আমি স্বামী খাব, আমি স্বামী খাব?’ অবশেষে ভুল ভাঙালেন। হাসি-খুশিতে ভরা আমুদে বটুক বাবু এই গ্রন্থের সিংহভাগ জুড়ে রয়েছে। তার হুঁকো চর্চা, তার ভ্যাকসিনেশন বাস্তব জীবনের সঙ্গে অনেকটাই মিলে যায়। বিভিন্ন পরিস্থিতিতে তিনি বিবেকসম্পন্ন মানুষের পরিচয় দিয়েছেন। তার রঙ্গপ্রিয়তায় মেধাবী উত্তরণ ঘটেছে।
কবির লড়াই, ইতিহাসের শাক্য দেব, মশা ও ফুলকাকা, ত্রাণদাতা হাসবি, ফিরোজা আসমান মে কাটি পতঙ্গ, অ্যান্টি গ্রাভিটেশনাল ফোর্স, নাম বিভ্রাট, ওলের কেরামতি, ফটিক দাদু প্রভৃতি কত গল্প একটা সময়ের ভেতর জীবন পাঠের আশ্চর্য দিগন্তের সম্মুখীন করে। প্রচলিত কথন ভঙ্গি, চরিত্রগুলির অকৃত্রিমতা, কোথাও সাধাসিধে চালচলন হাসির খোরাক যোগালেও মর্মকে স্পর্শ করে। বাংলা সাহিত্যে এইরকম গ্রন্থের জন্যই পাঠককে অপেক্ষা করতে হয়।ব্যালে নর্তকী,লেখিকা
সারাহ লাভেন(জন্ম ১৯৯১) তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘লেস বেলেস লেটারস’-এর এক জায়গায় বলেছেন :
“A true artist is never satisfied with settling, so you will never see them stay the same for very long. They are like chameleons… ever-changing, ever-scheming, ever-chasing that glimpse of divine inspiration that creates them anew.” (Sarah Loven, Les Belles Lettres)
অর্থাৎ একজন সত্যিকারের শিল্পী কখনোই মীমাংসা করে সন্তুষ্ট হন না, তাই আপনি তাঁদের দীর্ঘকাল একই থাকতে দেখতে পাবেন না। তাঁরা গিরগিটির মতো… চির-পরিবর্তনশীল, সদা কৌশলী, সদা তাড়া করে ঐশ্বরিক অনুপ্রেরণার আভাস যা তাঁদের নতুন করে সৃষ্টি করায়।
লেখক রেজানুল করিমের ক্ষেত্রেও এই কথাটির সত্যতা প্রমাণিত হয়। কেননা এই গ্রন্থে তিনি তাঁর প্রতিভার একটা ভিন্ন দিগন্তে আমাদের পৌঁছে দিয়েছেন।

ঝাঁজালো হাসি : রেজানুল করিম, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা ৭০০০৭৩, প্রচ্ছদ : রঞ্জন দত্ত, মূল্য ২৯৯ টাকা।
