গল্পের নামঃRaaz.
লেখকঃরজত শুভ্র।
প্যারিস,২০১৫।
ক্যাফেটা ছিল ছোট ও আরামদায়ক।কিন্তু আমার মুখোমুখি বসা মানুষটার দৃষ্টি ছিলো ঠান্ডা,আমার অর্ডার দেওয়া চকলেট আইসক্রিমের চেয়েও ঠান্ডা!হঠাৎ গাঢ় চোখ জ্বলে উঠলো তার।জানালার পাশে রিমা ও নিকিতার দিকে ইশারা করে বলল,”ওরা দুইজনই এখন লড়াই করবে।”চেয়ার পেছনে ঠেলে উঠে দাঁড়ালো দুইজন।চেপে ধরলো একে অপরের জ্যাকেট।
“এবার আসবে একজন পুলিশ।”চটপট বলল আমার মুখোমুখি বসা মানুষটি।একজন পুলিশ এসে সত্যিই আলাদা করলো লড়াইরত দুজনকে।এবার এই দৃশ্যে আবিভূর্ত হবে ক্যাফে মালিক আব্দুল্লাহ।আমাদের পাশ দিয়ে গটগট করে আব্দুল্লাহ এগিয়ে গেলো জানালার দিকে।
একজন সাংবাদিকের মতো বলে চলল সে,আর তার কথা অনুসারে ঘটে চললো ঘটনা।ব্যাপারটা মজার ও কিছুটা বিস্ময়কর।
আমার মনে হলো লড়াইয়ের ব্যাপারটা সে বলতে পেরেছে তাদের কিছু কথা শুনে ফেলায়।পুলিশকে হয়তো দেখেছে জানালা দিয়ে।
“এবার আমরা পরিচিত হবো ও এখান থেকে চলে যাবো।”-সে বললো।
পরে যাবার সময় সে বলল,” আগামীকাল সাতটায় আমাদের দেখা হবে প্যারিসের থিয়েটারে।”
এক মিনিটের জন্য গম্ভীর হয়ে গেল সে।আগামীকাল “ইভনিং প্যারিস” এর তৃতীয় পেজে একটা কবিতার নিচে তুমি আমার ডাকনাম দেখতে পাবে।সে বললো।
পরদিন সেখানে যেতে যেতে আমি তার বলা ইংরেজি ম্যাগাজিনটি কিনলাম।একটাই মাত্র কবিতা সেখানে।নিচে নাম লেখা-মেহবুবা।দেখতে দেখতেই পিছন থেকে ডাক।
‘গুড ডে,কমরেড ঈশান।’
‘নাম দেখেছ তাহলে।’বলল সে সোল্লাসে।
‘তোমার নাম তাহলে মেহবুবা?’
‘না,আমি কেবল আমার ডাক নামের কথা বলেছিলাম।’
‘মানে?তোমার আসল নাম কী?’
বললো না সে এবং রহস্যজনক হাসি দিলো।
‘তোমার থেকেই জানলাম আজকে আমার কবিতা পত্রিকায় ছাপা হয়েছে।’
“যথেষ্ট রসিকতা হয়েছে,মিথ্যে বলো না”।
” মিথ্যে তো বলতেই চাই কিন্তু পারি না।আমি বললেই সত্যি হয়ে যায়-একটাই শর্ত,কথাটা কাউকে বিশ্বাস করতে হবে।”
“তাহলে বল দেখি যে এখনই বৃষ্টি নামবে।” বললাম আমি পরিষ্কার আকাশের দিকে তাকিয়ে।
“বলতে তো পারি,কিন্তু কথাটা তুমি যে বিশ্বাস করবে না।” বললো মেহবুবা।
“তাহলে এটা খুবই দরকার যে তোমার কথা আমাকে বিশ্বাস করতেই হবে?”
“তুমি বা অন্যকেউ।অন্তত একজন।”
“তুমি যে মিথ্যেকথা বলতে পারো না,এটা তুমি জানলে কীভাবে?”
“একদিন আমি বান্ধবী অনন্যার কাছে বড়াই করে বলছিলাম যে অতিরিক্ত কাজ করলে,পরিকল্পনা করলে কাজটি সম্ভব করা।আমি জানতাম যে ব্যাপারটা অসম্ভব,কারণ কাজটা অর্ধেকও হয়নি।হঠাৎ করে একটা গ্যাজেটের কথা মাথায় এলো আমার,আর কাজটা হয়ে গেলো আমার!
সেদিন বুঝতে পারলাম,কথা বলার ব্যাপারে যথেষ্ট সাবধান থাকতে হবে।একদিন কাজে দেরি করে আসার অজুহাত হিসেবে বললাম যে মায়ের অসুখ হয়েছে,একঘন্টা পরেই এলো দুঃসংবাদ।আমার এক বন্ধু শুভকে রাগাবার জন্য বললাম যে তার প্রেমিকা বাণী আসলে তাকে ভালোবাসে না,পরদিনই আমরা শুনতে পেলাম,সে রেজিষ্ট্রি অফিসে গিয়ে অন্য এক লোককে বিয়ে করছে।”
আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম মেহবুবার কথা শুনে।এইরকম ঘটনা ঘটা কি সম্ভব?সে বলতেই থাকলো আরো ঘটনা!
“একদিন তর্কাতর্কি করতে করতে বললাম যে রোহিত পরপর দুটো গেমে হারবে,রোহিতকে তার মাশুল গুনতে হলো।তার মানে আমি যখনই বলেছি কেউ না কেউ বিশ্বাস করেছে!”
বই পড়তে লাগলাম আমি।মেহবুবার মতো ঘটনা কি কোনো মানুষের জীবনে ঘটেনি?একটা কথা আছে যে ভালোবাসার জনের অসুখ নিয়ে মিথ্যে কথা বলতে হয় না।তাহলে,সে সত্যিই অসুস্থ হয়ে পড়ে!কিন্তু এটা কি কুসংস্কার নাকি অজানা মনোবিজ্ঞানের কোনো সূত্র?
আমার মনে হলো,পুরো ব্যাপারটাকে কাকতলীয় ঘটনা হিসেবে ধরে নিয়ে দুশ্চিন্তা বাদ দেওয়াই ভালো।
প্যারিসে হঠাৎ মাঝে মাঝে মেহবুবার সাথে দেখা হয়ে যেতো আমার।থাকতে থাকতেই কোথাও উধাও হয়ে যেতো সে।তার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেও বেশি কিছু বলতো না সে।যেন এক রহস্যজনক মানবী!মেহবুবা ভবিষ্যতের কিছু বলতে শুরু করলেই তাকে থামাবার জন্য তার মুখে হাত চাপা দিতাম আমি,তারপর প্রচণ্ড হাসতাম দুজনেই।কিন্তু তাকে সবসময় থামাতে পারতাম না আমি।তার ফলে কী হলো?
দাবার গ্র্যান্ডমাস্টারকে হারিয়ে দিলাম আমি,পাঁচটা কম্পিউটারের সফটওয়্যার আবিষ্কার করে প্যারিসে বড় প্রযুক্তিবিষয়ক পুরস্কার পেলাম।আমি পেয়ে গেলাম মাষ্টার্সে বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বোচ্চ নম্বর!
মেহবুবা কি আমাকে ভালোবাসে?ভালোবাসা থাকলেই কি এরকম সম্ভব?
মাষ্টার্স পড়া কমপ্লিট আমার।প্যারিস থেকে দেশে আসবো।
প্রচণ্ড বৃষ্টির দিনে হঠাৎ একদিন আবার প্যারিসের থিয়েটারে হলে তার সাথে আমার দেখা।আমি ভাবলাম আজকে আমি তাকে তার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবোই এবং তাকে বলাবোই তার সমন্ধে।কিন্তু আমি প্রশ্ন না করতেই সে একটি লাইন বলে যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো।
“আমার ঢাকার এক মেয়ে রিনা তোমাকে ভীষণ পছন্দ করবে ও তার সাথেই তোমার বিয়ে হবে।”
কী আশ্চর্য!বলেই যেন সে উধাও!পুরো থিয়েটার হলে আমি কোথাও তাকে খুঁজে পেলাম না!সে কি মানুষ?সে কি আমার ভ্রম?বুঝতে পারলাম না আমি!
দেশে ফিরলাম ও ঢাকায় বড় কোম্পানিতে চাকুরিতে জয়েন করলাম আমি।মেহবুবার কথা মিলে গেলো।রিনা নামের আমার কলিগ আমাকে ভীষণ পছন্দ করে ফেললো।মেহবুবার বলা সব কথাই কি ঠিক?কবিতার লাইনে আছে,
“যে মানুষে বিশ্বাস রয়েছে তোমার,অসাধ্য কিছুই নেই তার?”
চমৎকার একজন ছিলো মেহবুবা,ভারি চমৎকার!সে কখনো মিথ্যা বলতো না।
প্যারিস থেকে আসার পরে ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে একদিন ঢাকায় আমাদের অফিসের সামনে রাস্তায় মেহবুবাকে দেখতে পেলাম আমরা।সে আমার দিকে দূর থেকে তাকালো এবং চোখ সরিয়ে নিলো।সে কি দেখতে পেয়েও পায় না নাকি দেখতে আমায় চায় না?আমরা ডাক দেওয়ার আগেই সে এগিয়ে এসে আমাদের দুজনকে ভালোভাবে দেখে বললো,”তোমরা একে অপরকে ভালোবাসো।”বলে রাস্তায় ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গেলো সে।অনেকক্ষণ তাকে আমরা খুঁজলাম কিন্তু মেহবুবাকে দেখতে পেলাম না।আর কখনো দেখা হয়নি মেহবুবার সাথে আমার ও রিনার।কিন্তু তার কথা মনে আছে খুব আমার।
আমি নয় আমরা!ঈশান ও রিনা।নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন আপনারা,মেহবুবা কখনো মিথ্যে বলেনি।কাকতলীয়।