pulak mondal

শিক্ষকের মর্যাদা কি আত্মসম্মানবোধ ছাড়া হতে পারে?

পুলক মন্ডল
—————————————-
অতিমারী পরিস্থিতিতে যখন নাকি প্রায় দেড় বছর যাবৎ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই বন্ধ, তখন আবার শিক্ষক দিবসের গুরুত্ব কোথায়! এমন টা আমার এক পরিচিত মানুষের উপলব্ধি। ধরে নিতে হবে তাঁর ভাবনা অনুযায়ী শিক্ষকের সম্পর্ক শুধুমাত্র স্কুল-কলেজ নামক ভবনগুলোর সাথেই। এখন প্রশ্ন হলো এটা কি শুধুমাত্র আমার ঐ পরিচিতই মনে করেন? নাকি আরও অনেকেই এমনটাই ভাবেন! শিক্ষককে কি শুধুমাত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গন্ডীতেই বেঁধে রাখা যায়! তবে কেন এমন ধারণা? কেনই বা স্কুল বন্ধ থাকলে শিক্ষকদের বেতনও বন্ধ করে দেওয়া উচিৎ, অথবা ‘ঘরে বসে মায়না পেতে লজ্জা করেনা!’ ইত্যাদি ব‍্যাঙ্গ-বিদ্রুপ সোশ্যাল মিডিয়া থেকে প্রকাশ‍্যেও একজন শিক্ষককে হজম করতে হয়?

খুব বেশীদিনের কথা নয়, মাত্র পঁচিশ-ত্রিশ বছর আগেও আমাদের কিশোর বয়সে অত্যন্ত স্বাভাবিক ও পরিচিত দৃশ্য ছিল এমনটাই যে, পাড়ার উঠতি ছেলেদের পরিচালনায়(গ্রাম বা শহরে) যে কোন অনুষ্ঠানেই তা সে একদিনের ফুটবল প্রতিযোগিতাই হোক আর রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তিই হোকনা কেন, অনাড়ম্বর মঞ্চে কৃতীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেওয়া কিম্বা খেলাধুলার প্রয়োজনিতা অথবা রবীন্দ্র-নজরুল সম্পর্কে দু-চার কথা বলার জন্য সবার আগে নিমন্ত্রিত হতেন ঐ এলাকার বাসিন্দা এক বা একাধিক প্রবীণ শিক্ষক।

মাত্র কয়েক বছর আগের সেইসময়ে এখনকার মতো মানুষের দৈনন্দিন জীবনে সর্বগ্রাসী রাজনৈতিক হানা ঘটেনি। সেইসময় এলাকার ছোটখাট সমস্যায় বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই ‘মাস্টারমশাই যখন বলছেন তখন এটাই করা উচিত’ গোছের মন্তব্য আকছার শোনা গেছে অথবা রাস্তার ধারে উঠতি বয়সীদের আড্ডায় ‘আস্তে স্যার আসছেন’ বলে সতর্ক হওয়া এবং বিপরীত দিক থেকে ‘অমুক তমুক কি করছিস তোরা এখন’ এ ধরনের সামান্য বাক্যালাপ ছাত্র এবং শিক্ষক উভয়ের কাছেই ছিল স্বাভাবিক, প্রত্যাশিত। শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্কের এসব দৃশ্য এখন প্রায় হেরিটেজ হয়ে ওঠার জন্য অনেকেই ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক আগ্রাসনকে দায়ী করেন, আবার কেউ কেউ বলেন ছাত্রছাত্রীদের মানবিক মূল্যবোধ ক্রমহ্রাসমান কিম্বা শিক্ষকরা ক্ষমতার পেছনে ছুটছেন ইত্যাদি ইত্যাদি।

তবে এসব নানা কারন তত্ত্বকথায় ব্যাখ্যার চাইতে অনেক সময় প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে প্রাপ্ত অনুভুতির প্রয়োজন বেশী জরুরী হয়ে ওঠে। একটি ছোট ঘটনার কথা বলি- একটি উচ্চ বিদ্যালয়ের বাৎসরিক অনুষ্ঠানের পুরস্কার বিতরণী মঞ্চ। নিচে বসে আছে ঐ বিদ্যালয় এবং লাগোয়া একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কয়েকশ ছাত্রছাত্রী। মঞ্চের উপরে একসারি চেয়ারে বসে আছেন দুই বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকাগণ। অনুষ্ঠান শুরু হতে একটু বিলম্ব হওয়ার হেতু অনুষ্ঠানের উদ্বোধক স্থানীয় পঞ্চায়েতের মাননীয় প্রধানের জন্য অপেক্ষা। কিছু সময় পরে তাঁর আধুনিক দ্বিচক্রযানে তিনি মঞ্চের নীচে প্রবেশ করার পর যখন পুষ্পবৃষ্টির মধ্যে দিয়ে মঞ্চের উপরে আসতে শুরু করেছেন ঠিক সেইসময় সেদিন মঞ্চে বসে থাকা এই তুচ্ছ কলমচীকে(পড়ুন শিক্ষক) রীতিমত বিস্মিত করে সকল শিক্ষক-শিক্ষিকাগণ দণ্ডায়মান রইলেন ততক্ষন পর্যন্ত যতক্ষণ না তাঁদের অনেকেরই হাঁটুর বয়সী(চলতি কথায়) সেই তরুন প্রধান চেয়ারে উপবিষ্ট হলেন। সেদিন চেয়ার কামড়ে বসে থাকা এই অর্বাচীনকে পাশে দণ্ডায়মান এক মধ্যবয়স্কা শিক্ষিকা ক্রমাগত নিচুস্বরে বলতে থাকলেন, ‘উঠে দাঁড়ান, প্রধান সাহেব এসেছেন, আপনি অন্যায় করছেন’। অনুষ্ঠান শুরুর পর সেদিনের বিস্মিত কণ্ঠটি জানতে চেয়েছিল, না উঠে আমি না হয় অন্যায় করলাম, কিন্তু আপনি তো প্রায়ই বলেন যে এই গ্রামপ্রধান আপনার ছাত্রসমান, তাহলে একজন ছাত্রের সামনে একজন উঠে দাঁড়ায়!

আশ্চর্য! উত্তরে ততোধিক বিস্ময়ের সাথে তিনি বলে উঠলেন, ‘আমি তো কোন ছার, দেখলেন না আপনি ছাড়া সবাই তো উঠে দাঁড়ালো।
ঠিক। কিন্তু কোনটি ঠিক? ওই মাননীয়া শিক্ষিকা তাঁর কাজে অন্যদের সক্রিয় সমর্থন পেলেন সেটা ঠিক না ঐ তরুণ প্রধান তাকে দেখে শ্রদ্ধেয় শিক্ষক-শিক্ষিকাদের উঠে দাঁড়ানোর মত ঘটনায় বিন্দুমাত্র বিব্রতবোধ না করে গ্রামপ্রধান বা রাজনৈতিক মাতব্বর রূপে তার স্বাভাবিক ন্যায্য পাওনা বলে মনে করে উপবিষ্ট হলেন সেটা ঠিক? হ্যাঁ, এটা অনুভবেরই বিষয়। গলদ কোথায় ঘটছে? শিক্ষকের বাক্তিতে? মানসিক বিকাশে? না কি ছাত্রছাত্রীর সামাজিক-রাজনৈতিক কর্মজীবনের আপাত ক্ষমতার অহমিকায়? কেন সমাজে প্রভাব বাড়ার সাথে সাথে অনেক ছাত্রছাত্রীই শিক্ষকদের উন্নাসিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখেন? কিম্বা কেনই বা একসময় যাঁদের ধমকে ও ভালবেসে লেখাপড়া এবং শিষ্টাচার শিখিয়েছেন অথচ পরবর্তীকালে সামাজিক প্রভাবের জগতে প্রতিষ্ঠিত সেইসব প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীদের সামনে কেমন একটা কুঁকড়ে গিয়ে কি হারানোর ভয়ে আক্রান্ত হন শিক্ষককুল?
যে জাতি শিক্ষকের যত মর্যাদা প্রদান করবে সেই জাতি বিশ্বের দরবারে তত উন্নত আসন লাভ করবে। শিক্ষাবিদ জন ডিওসি বলেছেন, ‘শিক্ষকের ঊর্ধ্বে কোন শিক্ষা নেই’। অর্থাৎ শিক্ষক নিজেই একটি অনুসরনযোগ্য দৃষ্টান্ত হবেন। কিন্তু সবক্ষেত্রে আমরা কি তা দেখতে পাই? যেমন একজন পরিচিত রাজনীতিবিদ শিক্ষকের কথা এইমুহূর্তে মনে পড়ছে যিনি তাঁর নিজের দলের ডাকা সাধারন ধর্মঘটে সরকারী নির্দেশনামা মেনে চাকুরী বাঁচানোর তাগিদে কর্মস্থলে হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করে আমজনতার কর্মস্থলে যাবার পথে পিকেটিং বা অবরোধে বসে পড়েছেন। এই দ্বিচারিতা একজন শিক্ষকরূপে সমাজে তাঁর সম্মান কতটা অক্ষুন্ন রাখতে পারলো সে ব্যাপারে তিনি কি সচেতন ছিলেন?

একটি জাতির অন্যতম বড়গুণ আত্মসম্মানবোধ। যে বা যারা নিজেকে সম্মান করতে জানেননা তিনি বা তারা অন্যকে আত্মসম্মানবোধের পাঠ দেবেন কিভাবে? তোষামোদ ও আত্মসম্মানবোধ একসঙ্গে চলতে পারেনা। তাই তোষামোদকারী ব্যক্তি তাঁর জীবনের মূল্যবান সম্পদ আত্মসম্মানবোধকে বিসর্জন দিয়ে একাজে অগ্রসর হয়। আত্মসম্মানবোধটা কি! মার্জিত কথাবার্তা, ব্যক্তিত্বে গাম্ভীর্য ইত্যাদি ইত্যাদি? না, এসব আসলে কৃত্তিম বিষয় যা আত্মসম্মানবোধ প্রকাশের মিথ্যা অভিনয়। আত্মসম্মানবোধ হল ব্যক্তিদর্শন অক্ষুন্ন রাখার দৃঢ প্রতিজ্ঞা। আর এই প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করার অর্থ হল আত্মসম্মানবোধের অবক্ষয়।

বারট্রান্ড রাসেল বলেছেন ‘শিক্ষকরা হলেন সমাজ ও সভ্যতার বিবেক’। গান্ধীজী বলেছেন ‘একজন শিক্ষকের জীবন শিক্ষার্থীদের সামনে খোলা বইয়ের মতো’। একজন শিক্ষক তাঁর ছাত্রছাত্রীদের কাছে দার্শনিকের মতো, কারন জীবন সম্পর্কে যে দর্শনচিন্তা তিনি তাঁর ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ছড়িয়ে দেন তার ভিত্তিতেই তারা তাদের জীবনের ব্রত ঠিক করে। তামিল ভাষার প্রচলিত প্রবাদ- যে বাড়িতে সম্মান নেই সেখানে পা রাখবেন না। টাকাপয়সা এবং খ্যাতির তুলনায় একজন মানুষের জন্য আত্মসম্মান অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। একজন শিক্ষকের মর্যাদা আত্মসম্মানবোধ ছাড়া কি হতে পারে!
———————————————–

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *