(ছোটগল্প) “ধাক্কা”
প্রকাশ চন্দ্র রায়
রচনা-০৫,০২,২০২১
শুক্রবার।
কেন কাঁদে মন,অকারন! ঠিক অকারনও নয়,নির্দিষ্ট একটা নিভৃত কারনে কাঁদে নমিতার মন। বাবা ডাক্তার,মা টিচার আর দাদা ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার। এরকম একটা শিক্ষিত পরিবারে জন্ম তার। সে-ও তো মহান পেশায় যুক্ত আছে দু’বছর থেকে তবে কেন এরকম করছে! আদর-যত্নেই মানুষ হয়েছে বলে আদরের মাত্রাধিক্যে ভীষণ জেদি হয়ে উঠেছে মেয়েটা। বছর দেড়েক থেকে প্রায় শতাধিক পাত্রপক্ষ দেখে গেছে তাকে কিন্তু কী এক অজানা কারনে কোন ছেলেকেই পছন্দ হয়নি নমিতার! তার দৃষ্টিতে কেউ কালো,কেউ বেঁটে-খাটো,কেউ আবার হ্যাংলা-পাতলা ইত্যাদি ইত্যাদি।
আজ ডিনারে বসে প্রসঙ্গ তুললো দাদা অভিলাষ,
-শোন বোন,কালকে আমার এক বন্ধু আসবে তোকে দেখতে। এবার যদি তাকে এভয়েড করিস তবে আমার হাতে আর কোন অপশন থাকবে না।
-না দাদা,আর কোন উল্টো-পাল্টা আচরণ করবো না। কানা-খোঁড়া যেই হোক,তাকেই বিয়ে করবো,খুব বিষণ্নমনে জবাব দিল নমিতা।
-কানা-খোঁড়া কী বলছিস!সিনেমার নায়কের চেয়েও সুন্দর-সুদর্শন আমার এ বন্ধুটা।
-আচ্ছা,আচ্ছা,বললাম তো,এক কথায় রাজী হয়ে যাবো এবারে। তোমাদেক টেনশনে রাখতে মন সায় দিচ্ছে না আর।
-তোর আর আমার মোবাইল নাম্বারসহ ডিটেইলস দেয়া আছে তাকে। ফোন করলে ভালভাবে কথা বলিস ওর সাথে।
মাথা ঝাঁকিয়ে উঠে পড়লো নমিতা,তারপর ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লো সটান। শুয়ে শুয়ে ভাবছে কেমন হবে দাদা’র এ বন্ধুটা। ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লো একসময়।
পরদিন ব্লু-স্টার হোটেলে চা-নাস্তা করার সময়ে প্রথম ধাক্কা’টা খেলো সে!
কে এই ভদ্রলোক ! সাদা ধবধবে প্যান্টের উপড়ে হালকা নীলাভ ফুলহাতা শার্ট ইন করেছেন। কুচকুচে কালো রঙের চিকন বেল্টে সিলভার কালার বকলেস। জুতা জোড়াও দুধসাদা রঙের। গোল্ডেন কালার নেকটাই এর প্রান্তভাগ নাভীর নীচে বেল্টের বকলেস ছুঁই ছুঁই করছে। একদম ক্লিন সেভড, একটু দূর থেকে লক্ষ্য করলে মনে হবে যেন এখনও দাড়িগোঁফ উঠেই নি তার। লম্বাটে ফরসা মুখমন্ডলে ঈষৎ থ্যাবড়া নাক, বড় বড় গোলাকার দুটো চোখ-বেশ মায়াবী আর নিষ্পাপ দৃষ্টি তাতে। মাথাভর্তি রেশমী কালো ঘন ব্যাকব্রাশ করা চুল। বয়স আর কত হবে! বড়জোর বত্রিশ-তেত্রিশ। আড়নয়নে দেখছে আর ভাবছে নমিতা। ব্লু-স্টার হোটেলের কর্ণার টেবিলে বসেছে ওরা, সোনিয়া,রেহেনা আর নমিতা।
নমিতা রায়। একই স্কুলের টিচার তিনজন-ঝাউতলা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দু’বছর পূর্বে প্রথম জয়েন করেছে সে। ইতিমধ্যে সি, ইন, এড প্রশিক্ষণ শেষ করেছে। রেহেনা, সোনিয়াও যে চুপি চুপি দেখছে ভদ্রলোককে সেটাও আন্দাজে টের পাচ্ছে নমিতা। ভাবছে কে এই ভদ্রলোক ! এত সুদর্শন পুরুষ আগে কখনোই দেখেনি সে। ক্যাশ-টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে কী যেন অর্ডার করছে ভদ্রলোক,কর্ণার টেবিল থেকে শুনতে পারছে না নমিতারা। কিছুক্ষণের মধ্যেই এক কার্টুন মিষ্টি এনে ক্যাশ-টেবিলে রাখলো হোটেল বয়। বিল মিটিয়ে দিয়ে মিষ্টির কার্টুনটা হাতে নিয়ে,হোটেল থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন সুদর্শন ভদ্রলোক। সর্বনাশ! বুকের ভিতর হৃৎপিণ্ডটা ধ্বক করে লাফিয়ে উঠলো নমিতার। ধড়ফর করে উঠতে গেল চেয়ার থেকে,শাড়ীর পাড়ে জুতোর ডগা আটকে থাকায় চেয়ারসহ উল্টে পড়ে যাচ্ছিলো প্রায়,শাড়ীটা সামলে নিয়ে সবাই উঠে পড়লো। হোটেলের বাইরে এসে খুঁজলো মনে মনে,না! নেই সুদর্শন লোকটা! বেরুতে বেরুতেই যেন হাওয়া হয়ে উবে গেছে কোথাও! মনটা খারাপ হয়ে গেল ভীষণ। নমিতার ভাব দেখে সোনিয়া বলে উঠলো,
-কী হলো নমিতাদি?এমন থ হয়ে ভাবছিস কী! চল না,এতক্ষণে তোর দাদা’র বন্ধুরা নিশ্চয়ই এসে গেছে।
-আসুকগে, সে নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই, নির্লিপ্তভাবে জবাব দিলো নমিতা রায়।
-তারমানে! কঁকিয়ে উঠলো রেহানা। সেজন্যই তো আমাদের ডেকে আনলি!
আবার নির্লিপ্তকণ্ঠে বললো নমিতা,
-ওরা আসলে বাসা থেকে ফোন করে ডেকে নিবে দাদা।
-তার আগে সাজগোজের ব্যাপারটা আছে না তোর?
-না নেই,ওসব আমার ভালো লাগে না। আমি ভাবছি অন্যকথা।
-কী কথা?
-কিছুক্ষণ আগে মিষ্টি কিনলো,লোকটা কে?
-হবে কোন নতুন অফিসার,ট্রান্সফারে এসেছে। এলাকার কেউ যে নয়,তা তো বোঝাই যায়।
কথার মাঝে হঠাৎ বলে উঠলো সোনিয়া,
-আরে রেহানা আপা,শুনেছো খবরটা?
-কোন খবরটা? উৎসাহী হলো রেহানা।
-আমাদের শিক্ষা অফিসার স্যার, ট্র্যান্সফার হয়ে গেছেন,নতুন অফিসার এসেছেন দিনাজপুর থেকে।
এ খবরেও কোন ভাবান্তর হলো না নমিতার,সে কেবলই ভাবছে,কে এই সুদর্শন ভদ্রলোক? ভাবনার মাঝে হাতে রাখা মোবাইল ফোন বেজে উঠলো ক্রিং ক্রিং শব্দে। রিসিভ করে কানে লাগালো ফোনটা,দাদা বলছে,
-ও,তো এসে গেছে একা একা,শীঘ্রই চলে আয়।
বাসায় ঢুকেই দ্বিতীয় ধাক্কা’টা খেলো হল্লাদিনী নমিতা। দেখলো তাদের ড্রয়িংরুমের বারান্দায় বসে দাদা’র সাথে হাসাহাসি করছে হোটেলে দেখা সেই সুদর্শন ভদ্রলোক! মুহূর্তের মধ্যেই মনের ভিতর জমে থাকা আত্ম-অহংকারের রূপসী পাথরগুলো গলে গলে জল হয়ে গেল।
দাদা বললো,
-আয় বোস,এ-ই হলো আমার নায়কবন্ধু সুবিমল রায়,তোদের নতুন শিক্ষা অফিসার। আর,সুবিমল,দ্যাখ আমার আদরিনী বোনকে।
“শিক্ষা অফিসার”কথাটা শুনে আনন্দাতিশয্যে তৃতীয় ধাক্কা’টা হজম করলো নমিতা সুন্দরী। অন্তরের পাথরগলা জলগুলো ততক্ষণে আনন্দধারা হয়ে ছুটে চলেছে সুখ-সাগরের দিকে।★