Prasanta Giri 

প্রশান্ত গিরি

শিশুসুলভ সাম্য
প্রশান্ত গিরি

বিকেল বেলায় ছোট্ট ঝোলা বাগিচায় জল দেওয়া আমার স্ত্রী ও পুত্রের নিত্য দিনের কর্ম তথা জল বিনোদনও বটে | সদ্য ক্রীড়া-পাঠ্য স্কুলে যাওয়া আমার পুত্রের অফুরন্ত প্রশ্ন ভান্ডার মূলত এই সময় হাট করে খুলে যায় | নিত্য নতুন প্রশ্ন বাণে জর্জরিত স্ত্রীর অসহায় মুখ খানি আমার অন্তরে কৌতুক সঞ্চার করলেও মুখে তার প্রকাশ করার উপায় থাকে না | সেদিন শুনলাম পুত্রের চিৎকার …” মা…আ …গাছে ওই জল দেবে না …”

“কেন ?”

” খাওয়ার জল দাও …গাছ ওই জল খেলে ওর পেট ব্যাথা করবে …|

আমি একটু নজর করে বুঝলাম , ও ট্যাপের জল গাছে দিতে চাইছে না , ফিল্টার করা জল দিতে চাইছে , ওর ধারণা, ওই জল খেলে গাছেরও পেট ব্যাথা করবে |

আমি বেশ অবাক হলাম , ও যা বলছে সঠিক , ওর মা নোংরা কিছু মুখে দিতে না বলে , খেলে পেট খারাপ হবে বলে ভয় দেখায় , হতে পারে সেই ভাবনা থেকেই গাছেও ট্যাপের জল দিতে চাইছে না | একেই বলে নিখাদ সাম্যবাদ | অকলুষিত শিশুমনই পারে প্রকৃত সাম্যের দিশা দিতে | যত দিন যাবে , বয়স বাড়বে , স্বার্থের থাবা মানসপটে দীপ্তিমান হবে , একে একে শুরু হবে বিভাজন তথা ভেদাভেদ | সুতরাং বিভেদ মূলক মাইন্ড সেট নিয়ে কেউ পৃথিবীতে আসে না , সমাজ তাকে বিভেদ করতে শেখায় |

বাড়ির কাছে পিঠে একটি ছোট্ট পার্কে মাঝে মাঝেই বাচ্চাকে নিয়ে যাই | এলাকার বেশ কিছু কচি কাঁচা খেলতে আসে এখানে | এক দিন দেখলাম এক ভদ্রমহিলা ওর ছেলেকে ধমক দিচ্ছেন …” তোমাকে না আমি বারণ করেছি ওই ছেলেদের সাথে খেলতে , ওরা পড়াশুনো করে না , সারাদিন খেলে বেড়ায় , তুমি একা খেলতে পারো না ? ওদের সাথে মিশে তুমিও গোল্লায় যাবে নাকি ? ” প্রথমত পৃথিবীতে কোন খেলা আছে যা একা খেলে মজা পাওয়া যায় ? আমরা ছোট্ট থেকেই বাচ্চাদের মনে নানা কারণে বিভেদ এর বীজ বপণ করি , ওরা পবিত্র মন নিয়েই পৃথিবীতে আসে |

ছোটবেলায় বাড়িতে যেদিন ডিমের ঝোল ভাত হতো , মা কে দেখতাম বোনেদের আধখানা ডিম দিতে যেখানে আমার পাতে গোটা ডিম | ওরাও এটা মেনে নিয়েছিল , দাদা বড় সুতরাং বেশি পাবে , বড় মাছটি , দুধটাও গ্লাস ভর্তি | আচ্ছা আমি যদি ছেলে না হয়ে মেয়ে হতাম তখনও কি এমনটা হতো … নাকি ? প্রশ্ন রইলো | আপনারা ভাবতে পারেন আমি মা কে দোষ দিচ্ছি , মোটেই না | মা তো আমাদের প্রচলিত সমাজ ব্যাবস্থার ক্ষুদ্র অংশ মাত্র | আজকে হয়তো কিছুটা চিত্র পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু আমি হলফ করে বলতে পারি , ছেলের জন্মদিন ঠোঁটস্থ থাকলেও মেয়ের জন্মদিন মনে করতে মাথা চুলকাতে হয় | সবচেয়ে মজার বিষয় হলো , যে মেয়েটা শুধু মাত্র মেয়ে বলে বিবিধ সামাজিক ও পারিবারিক ভেদাভেদের স্বীকার হয়ে ঠোঁট ফুলিয়ে , নিভৃতে চোখের জল ফেলে বেড়ে উঠলো , সেই মেয়েটি মা হয়ে ছেলে মেয়ের মধ্যে ছেলেকে প্রাধান্য দিতে শুরু করলো |

ভেদাভেদ আমাদের সমাজে নানা রূপে বিদ্যমান | দুর্গা পুজোয় বন্ধুরা মিলে ঠাকুর দেখতে বেরিয়েছি , বিশাল বড় পুজো , বিশাল লম্বা লাইন , আমার ঠিক পিছনে এক জন ছেলেকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন , দীর্ঘ লাইনে দাঁড়াতে দাঁড়াতে ক্লান্ত ছেলেটি তার বাবাকে বলছে …” বাবা পাশের দড়িটা পেরিয়ে চলো না …দেখো পুরো ফাঁকা রাস্তা , আমরা তাড়াতাড়ি প্যান্ডেলের কাছে পৌঁছে যাবো |”

” ওটা তো ভি আই পি লাইন বাবা , ওখানে আমাদের যেতে দেবেনা |”

” তবে ওরা যে যাচ্ছে …”

” ওরা তো ভি আই পি , ওদের ভি আই পি পাশ আছে |”

” তুমি তো ভি আই পি পাশ কিনতে পারতে …”

” ওগুলো কেনা যায়না বাবা …”

“তুমি জানো না …পিকু বলছিলো …ওদের বাড়ির কাছে একটা শপিং মলে সব পাওয়া যায় |”

“আচ্ছা কাল কিনবো বাবা |”

“বাবা …ওটা কিনতে অনেক টাকা লাগবে ?”

“হাঁ …”

বাবা ছেলের এই কথোপকথন আমার ঠাকুর দেখার ইচ্ছে টুকু শেষ করে দিয়েছিল , বার বার পাশের ভি এই পি লাইনে চোখ চলে যাচ্ছিল , ওদের চোখে মুখে সেই প্রাচীন অবক্ত্য অহংকার…|

আজকে পাড়ার ছোট্ট একটি মাচা অনুষ্ঠানেও বিশেষ অতিথিদের জন্য আলাদা বসার জায়গা করা থাকে , শুনতে খারাপ লাগে তবু এটা কি অস্বীকার করতে পারবেন ? আচ্ছা এটা কি এড়ানো যায় না ? সেই পিতা যে জীবনে কোনও দিন ভি এই পি পাশ জোগাড় করতে পারবে না , সে কত বার তার সন্তানের কাছে মুখ লুকোবে ? “আচ্ছা বাবা আমরা ভি আই পি নই কেনো ?” এই প্রশ্ন আজীবন তাকে কুরে কুরে খাবে |

বিভাজন ও ভেদাভেদ এর নিরাময় কঠিন , এটি একটি মানসিক ব্যাধি | আমি এটিকে স্বজ্ঞানে মানসিক ব্যাধি বলছি তার কারণ মানুষ স্বজ্ঞানে কিছু ধারণা লালন পালন করে , যেমন উচ্চ-নীচ , ধনী-দরিদ্র ইত্যাদি | হাল আমলে এর নবতম সংযোজন সরকারী-বেসরকারী কর্মচারী |

কোরোনার প্রথম ঢেউ তখন নিম্নমুখী , দীর্ঘ কাল কর্মক্ষেত্রে একলা কাটিয়ে বাড়ি ফিরেছি | বিকেলে গ্রামের পথ ধরে ঘুরতে বেরিয়েছি , সঙ্গী আমার এক শিক্ষক বন্ধু , রাস্তায় পরিচিত এক ভদ্রলোকের সাতে দেখা , উনি প্রথমে সঙ্গী বন্ধুর শারীরিক কুশলতা সম্পর্কে নিশ্চিন্ত হয়ে আমায় নিয়ে পড়লেন …”কবে আসা হলো ?”

“কাল রাত্রে ফিরেছি …”

“তারপর ওই দিকের সব খবর ভালো তো ?”

“হাঁ …কলকাতায় সংক্রমণ একটু কমেছে , সব স্বাভাবিক হচ্ছে ধীরে ধীরে …”

“না আমি তোমার কাজের কথা বলছিলাম …মানে যা সব শুনছি …কত লোকের চাকরী চলে যাচ্ছে , মাইনে ছাঁটাই হচ্ছে …”

বুঝলাম উনি আমার নয় আমার জীবিকার কুশলতা জানতে চাইছেন | একটু খারাপ লেগেছিলো বৈকি ,তবে তা দীর্ঘায়িত হয়নি কারণ বেসরকারী কর্মচারী হওয়ার দরুন এর পুর্ব অভিজ্ঞতা আমার ছিল | শুনেছি কর্মের নাকি উচ্চ নীচ নেই , সব কর্মই সম্মানের তা যদি হয় সৎ পথে |

আর একটি ছোট্ট ঘটনা বলেই লেখাটি শেষ করতে চাই …তো ছেলেকে স্কুলে নিয়ে যাওয়ার সুবাদে আরও অনেক প্যারেন্টস দের সাথে কথা হয় , সবাই নিজ নিজ বাচ্চার সারাদিনের কর্মকাণ্ড বর্ণনা করে … এক দিন এক জন কে বলতে শুনলাম উনার ছেলে নাকি কারুর সাথে কিছু শেয়ার করতে চায় না ,সে খেলনা হোক বা চকোলেট | ও নাকি বলে …” আমি সব নেব …সব কটা আমার বাবা এনেছে, তাই সবটা আমার | “

আমি বুঝলাম এই সমস্যা খুবই জটিল , বাচ্চাদের দোষ দিয়ে কি লাভ ? আমরাই সারাক্ষন …’এর সাথে মিশবে না , ওর সাথে কথা বলবে না , তার সাথে খেলবে না , ওরা ভাল নয় , এটা আমাদের , ওটা আমি করেছি …আমি অমুক …আমি তমুক …আমি ….| আমি ময় পৃথিবী …আমিত্বে টইটুম্বুর আমাদের চেতনা | তো তার ফল স্বরূপ আমি থেকে অহম থেকে অহংকার তো আসবেই | আর এই যে এতক্ষন বিভাজন তথা ভেদাভেদ নিয়ে বক বক করলাম তার মূলে কিন্তু এই অহমবোধ বা অহংকার | অহমবোধের কারণেই মানুষ স্থান কাল পাত্র ভেদে নিজেকে অন্যের তুলনায় উৎকর্ষ প্রমাণে এতই মরিয়া থাকে যে বুঝতেই পারেনা সে ধীরে ধীরে নিঃসঙ্গ , একলা হয়ে যাচ্ছে | যে সমাজের মোমেন্টামই নিঃসঙ্গতার দিকে , সেখানে সাম্যের স্বপ্ন অলীক কল্পনা |

প্রশান্ত গিরি , Sept10, 2022. নিউটউন , কলকাতা

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *