
সুখ ও সমৃদ্ধি
প্রশান্ত গিরি
আজ সকাল থেকে অপর্ণার মেজাজ বিগড়ে আছে , সকালে ঘুম থেকে উঠতে না উঠতেই কাজের মেয়েটির ফোন
-আজ আসবো না বৌদি …
-কেনো …?
-বাড়িতে লক্ষী পুজো করব |
-সে তো রাত্রে …তুই আয় , আজ অনেক রান্না বান্না আছে , আমার এক বান্ধবী আর তার বর দুপুরে খাবে , হটাৎ প্ল্যান হয়েছে , তোকে জানাতে ভুলে গেছি |
-ওঁদের কাল আসতে বলো না বৌদি …|
-মানে …! তুই আসতে পারবি না বলে আমাদের গেস্ট আসবে না নাকি …?
-না …মানে , আমি ঠিক তা বলিনি …
-আর বোঝাতে হবে না …আমি সব বুঝি , তোর ডানা গজিয়েছে |
-না গো বৌদি …|
-তোকে বেশি বকতে হবে না , আজকে তুই আয় , সে যে ভাবেই হোক |
-আচ্ছা ঠিক আছে হাতের কাজটা সেরে নিয়ে যাচ্ছি , তবে বৌদি আজ একটু তাড়াতাড়ি ছুটি দিও |
-তুই আয় তো আগে |
অপর্ণার মেজাজ গেল আরও বিগড়ে , কাল রাতে ঘুম হয়নি ভাল , আজ কাল ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমাতে হয় | ডক্টর বর্মন এর কাছে যেতে হবে আবার , বলেছিলেন শুরুতে ট্যাবলেটের অর্ধেকটা খেতে , কাজ না হলে পুরোটা , কয়দিন ধরে গোটা ট্যাবলেট খেয়েও ঘুম আসছে না | মাথা ধরে আছে , তার উপর কাজের মেয়ে মালতীর এই নাটক আর নেওয়া যাচ্ছে না | ঘড়িটা সশব্দে দুলতে দুলতে জানিয়ে দিলো দশটা হলো বেলা , বোঝো এবার ঠেলা , কিস্যু হয়নি , ওরা যে কি ভাববে কে জানে ? মেয়েটা এখনও ঘুমাচ্ছে | কাল রাতে কি নাকি লেট নাইট পার্টি ছিল , ভোর বেলা বাড়ি ঢুকলো , ওর ভাবতেও কষ্ট হয় এতো কিছু করেও ছেলে মেয়ে দুটোকে মনের মত মানুষ করতে পারলো না | হয়তো ওর নিজেরই কিছু ভুল আছে , হাঁ ভুল তো আছেই | অতি আধুনিক স্বামীর সাথে পায়ে পা মেলাতে মেলাতে কখন যে পা পিছলে আধুনিকতার নামে অপসংস্কৃতির প্রবাহে ভেসে গেছে , আজও ভাসছে , আর উপায় নেই , ভাসতে ভাসতে হারিয়ে যাওয়াই ভবিতব্য | অপর্ণা সম্ভ্রান্ত বনেদি বাড়ির মেয়ে , বাবার অগাধ অর্থ থাকলেও বাঙালিয়ানা ছিল ষোলোআনা | কপালের ফেরে বিয়ে হলো এক বিলেত ফেরত আধা বাঙালি আধা সাহেব মানুষের সাথে | মানুষ হিসাবে অমরেশ বেশ ভাল কিন্তু উনার জীবন প্রবাহে পাশ্চাত্যের স্রোত বেশি থাকার দরুন , এদেশীয় রীতি নীতি , সংস্কৃতি , মূল্যবোধ , ভাবাবেগ তেমন কলকে পায়নি |
-এলাম গো বৌদিমনি …
-তোর এই সময় হলো …আচ্ছা যা বসার ঘর আর আমার শোবার ঘর ভাল করে গুছিয়ে নে আগে |
মালতী ঘর গোছাতে শুরু করে |
-বৌদি …তুমি আবার কাল দুটো ঘুমের ট্যাবলেট খেয়েছো ? ওটা না তোমার বারণ ?
-তুই বেশি পাকামো করিস না , এমনিতে দেরিতে এসেছিস , কি করে হবে এত কাজ ! এত রান্না !
ধমক খেয়ে মালতী চুপ করে থাকে | ও জানে বৌদিমনি মানুষ খারাপ নয় , এই তো পুজোয় বোনাস ছাড়াও সবার জন্য লুকিয়ে কাপড় কিনে দিলে | আজ কোনও কারণে মেজাজ বিগড়ে আছে | দুঃখী মানুষ বটে বৌদিমনি , খুব একা | ছেলেটা বাড়ির অমতে বিয়ে করে বৌ কে নিয়ে অন্য জায়গায় থাকে , কোনও যোগাযোগ নেই | মেয়েটার কথা না বলাই ভালো , ওর যদি ওমন মেয়ে হতো তো এতো দিনে গলা টিপে মেরেই ফেলত | আর দাদা বাবু তো যেন ইংলিশ ম্যান , মুখ পড়া বড্ড ইংরিজি বকে | এতো যদি সাহেব হওয়ার শখ , তবে যাও না বাপু বিদেশে , এদেশে থেকে আমাদের মতো মুখ্যু লোকের উপর ইংরিজি ঝেড়ে মাথা খাওয়া কেন ?
-বৌদি ঘর গোছানো শেষ , এবার বলো কি করতে হবে ?
-তাহলে মাছ আর মাংস গুলো ভাল করে ধুয়ে ফেল দেখি |
-সেকি ! আজ লক্ষী পূর্ণিমা , আমি পুজো করব বাড়িতে , আজ আমি ওগুলো ছোঁবো না |
এবার যেন তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন অপর্ণা |
-তাহলে …ওগুলো করবে টা কে ? আমি ? তোর সাহস তো খুব ? আর এত লক্ষী পুজো করে হবে টা কি ? সেই তো দুটো টাকার জন্য লোকের বাড়িতে ঝি গিরি করবি | মালতীর খুব রাগ হলো কথা গুলো শুনে |
-হাঁ গো বৌদি , ঝি গিরি করে খাই , টিনের চালায় থাকি , কম দামি জামা জুতো পরি তবু খুব সুখে আছি | তোমার মতো অট্টালিকায় টাকার বিছানায় ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমাতে যাই না , সারাদিন খেটে খুটে নিশ্চিন্তে এক ঘুমে রাত কাবার করে সকালে উঠি |
কথাটা অপর্ণার বুকে তিরের মতো বিঁধলো , দু চোখ দিয়ে জল গড়াতে লাগলো |
-তুই অমনটা আমায় বলতে পারলি মালতী ?
-আমি রাগের মাথায় বলে ফেলেছি বৌদি , তোমার পায়ে পড়ছি আমায় ক্ষমা করে দিও |
অনুতপ্ত মালতী অপর্ণার পায়ে পড়ে কাঁদতে থাকে | ওর সুখ আছে সমৃদ্ধি নেই , বৌদির সমৃদ্ধি আছে সুখ নেই |
প্রশান্ত গিরি