কবিতার পাতা – এক

ভুবনডাঙ্গার মাঠ   –  মহীতোষ গায়েন

কঠিন এই দু:সময়ে

সবাই কেমন একা,

জীবন-যুদ্ধ শেষে হবে 

মঙ্গলময় দেখা।

ভোরাই সুরে আর বাজেনা

আনন্দময়ী গান,

উতল হাওয়ায় যায়না শোনা

আশাবরীর তান।

মাধবীলতায় ফুল ফুটেছে

সূর্য গেছে পাটে,

বিষাদ সুরে বাজছে সানাই

উজানতলির ঘাটে।

নির্জন রাত দুর্দিনে আজ

বনপলাশীর পাশে,

জোৎস্নালোকে পথ বেয়ে

ঐ বিষাদসিন্ধু আসে।

আবার সবাই ফিরে যাবে

কর্মজীবন হাটে,

যুদ্ধ জেতার প্রস্তুতি তাই

ভুবনডাঙ্গার মাঠে।

.হীতোষ গায়েন,অধ্যাপক, সিটি কলেজ,১০২/১,রাজা রামমোহন সরণি,কলকাতা-৯

লকডাউনে
শংকর দেবনাথ

লকডাউনে গ্রাম-টাউনে
তোমরা ধনী যারা,
সন্ধি করে বন্দিযাপন
করছো মজায় তারা।

কাজ না করেও রাজসেলারি
পাচ্ছো ঘরে বসে,
অঢেল টাকা ব্যাংকে রাখা
আনছো তুলে গো সে।

নানানরকম খানাপিনার
সঙ্গে আয়েস করে,
কাটাচ্ছো দিন ধিন ধাগে ধিন
অচিন্ত্য অন্তরে।

দিন আনি দিন- আমরা তো দীন
কাজ যদি না করি,
একটা টাকাও কেউ দেবে ফাও
যতই কেঁদে মরি?

কাজ হারিয়ে ভাঁজ কপালে
চিন্তা শুধু মনে,
শেষ হলো তা সঞ্চয়ও যা
ছিল ঘরের কোণে।

বাইরে গেলে নাই রে রেহাই
মারবে করোনা যে,
খাবার ছাড়াই মরবো আবার
থাকলে ঘরের মাঝে।

লকডাউনে শখ-আহ্লাদে
তোমরা আছো সুখে,
বন্দি ঘরে যাচ্ছি মরে
আমরা ধুকেধুকে।

গুহাবাসী
শংকর দেবনাথ

আমরা কয়টি পরাণী, ভয়টি
জড়িয়ে ছোট্ট
দু’হাতে-
গৃহমাঝে নয় আছি মনে হয়
আদিমযুগের
গুহাতে।

দুরুদুরু মনে প্রতি ক্ষণেক্ষণে
হানা দেয় ভীতি-
ভাব এসে-
বাইরে করোনা করে আনাগোনা
বের হলে গিলে
খাবে সে।

শুধু চারপাশে নীরবতা ভাসে
নিবিয়ে উছল
সুখ-আলো-
বন্ধু স্বজন যা ছিল ক’জন
সকলে কোথায়
লুকালো!

কিছুটা খাবার গুছিয়ে আবার
আদিম মানুষ
যেভাবে,
ফিরতো গুহায় সাবধানি পা’য়
ফিরে আসি নিতি
সেভাবে।

ভয়েভয়ে বাঁচি- মনে হয় আছি
পাহাড়-গুহায়
কী বনে!
পৃথিবী আবার ফিরে গেল তার
নাকি সে আদিম
জীবনে?

 

ধূলিশর্মিষ্ঠা গুহ রায়(মজুমদার)

কাননপুষ্প ফুটিল ভোরে,
আহা,কি রূপ তাহার ঝরিয়া পড়ে।
আদরিণী কয়,’দেখরে আমায়,
ভ্রমর কেমন ঘিরিয়া ধরে।
ওলো ভ্রমর,করিস যদি মধুপান,
তোর পায়েপায়ে করাসনে ধূলিস্নান।’
তরুতলে ধূলি শুনি নীরবে হাসে।
ঊর্ধ্বপানে চন্দ্র তদা সন্ধ্যাকাশে ভাসে।
মুহ্যমানপুষ্প,এবার তাহার ঝরার পালা,
দুহাত মেলিয়া তরুতলের ধূলি তারে ডাকে,
‘কোলে ফিরে আয়,ফিরে আয় আদরিণী,
এ মায়ের আঁচলখানি তোরই তরে আছে মেলা।’

ছড়া – মাধব মন্ডল

বুমবুম নাচে ডুমডুম
জুলু নাচে ডুমডুম
বান্টু নাচে ডুমডুম
ঝুমঝুম নাচে ডুমডুম
পুমপুম নাচে ডুমডুম
আর
দাদু নাচে ডুমডুম

নাচ বুমবুম নাচ রে
সঙ্গে নাচে জুলু রে
আর নাচে বান্টু রে
ঝুমঝুম নাচে
পুমপুম নাচে
আর নাচে দাদু রে
নাচ বুমবুম নাচ রে

ডি কে পালের লিমেরিক
‘সাধের জীবন’


রঙ বেরঙের ঘুড়ি আমার, মত্ত আছি উড়াতে,
আমি এবং আমার ঘুড়ি উড়ছে আকাশ চূড়াতে;
পা’য়ের দিকে নেইতো খেয়াল
ন্যাড়া ছাঁদে —–বড্ড বেহাল,
উড়ু-উড়ু সাধের জীবন,সাঙ্গ তাড়া-হুড়াতে।

চতুর্দশপদী – করোনাসুর
শংকর দেবনাথ

মানবজাতির শত্রু দানব করোনা-
অদৃশ্য হানায় তার দেহ জর্জর।
সংক্রমণ অস্ত্র নিয়ে সংগোপনে ঘোরে-
সুযোগ পেলেই হানে শ্বাসরোধী শর।
বিপন্ন পৃথিবী আজ ত্রাসি ত্রাহি রবে-
মৃত্যুর মিছিলে কাঁদে অসহায় প্রাণ।
রক্ষঃকরোনার থেকে রক্
ষা নাই বুঝি-
কেমনে এ শত্রু থেকে পাবে পরিত্রাণ।

মানুষের সশরীরী হে দেবতা-দেবী-
ভরসা তোমরা শুধু। আসুরী শক্তিকে-
পরাভূত করে দিতে ব্রহ্মাস্ত্র ভ্যাক্সিন-
হাতে নিয়ে রণাঙ্গণে জাগো দিকেদিকে।
রক্তবীজ অসুরের বংশ করোনাকে
নাশ করে বাসযোগ্য করো পৃথিবীকে।

আঁচড় – সুদীপা মন্ডল

কতটা যন্ত্রণা পেলে বলা যায়,
বন্ধু, তোমাকে ভালোবাসি,
জানা নেই…..
কতটা রক্তপাত ঘটলে বলা যায়,
আমি আঘাত পেয়েছি,
শোনা নেই…..
হৎযন্ত্রে অবিরাম চাবুকের আঘাত
এ থামার শেষ নেই….
কতটা বিদ্রুপ করলে ভাঙা যায় স্বপ্ন,
ভাষা নেই…..
কৌশলে কি করে আড়াল করা যায়
চোখের নোনতা জল
শেখা নেই…..
অবহেলায় কি ভাবে টুকরো করতে হয়
জমানো প্রতিশ্রুতি
সাহস নেই।
আজ আমার নেই কিছু, তাই বুঝি
শুধু স্মৃতির আনাগোনা পিছুপিছু
দেখাতে পারিনি আমার ক্ষতবিক্ষত মন
ফিরবে তুমি এআশায় ছিলাম প্রতিক্ষন
চাওনি ভাঙতে দুজনের মাঝের নিরবতা
মিথ্যে ছিলো সেই আশ্বাসের রঙিন কথকথা
আজ দুজনের পথ দুটি গেছে বেঁকে
বিদায় কালে ভাঙা মনটুকু গেলে রেখে
কেমন করে ভুলবো সেসব স্মৃতি
ভাঙা মন জোড়া দেবার আছে কি কোনো নীতি ???

একদিন এই নদীর বুকে অলোক আচার্য

কতদিন ভেবেছি একদিন গাংচিল হয়ে

এই ঢেউ তোলা নদীর বুকে

ছুঁয়ে যাবো জলাধার- শিকারের খোঁজে

উড়ে যাবো একদিন পানকৌড়ি হয়ে

ডুব দিয়ে গভীরে মায়াজাল,

স্নিগ্ধ বাতাস গায়ে মেখে- একদিন

অতঃপর ফিরে আসি।

এই গুল্মের ঝোপ-মেটে শালিকের ছানা

বিকেলের শেষে মিঠে রোদ

মিশে যায় হঠাৎ-শ্যাওলার মতো ভেসে

গায়ে মাখা চিত্রার জল।

অলোক আচার্য
শিক্ষক ও লেখক

 

 

 

 

 

ম করোনা থাম – সব্যসাচী নজরুল

চীন থেকে হয় যাত্রা শুরু 

শেষটা বলো কোথায়

লকডাউনে পরে যে আজ

বড়ই অসহায়।

বাইরে ভীষণ বৃষ্টি হলো

ভিজতে মনে চায়

বন্দিদশায় পাগলপ্রায়  

জীবন বড় দায়!

লাল জামা চাই বলে মেয়ে

ছেলে কিনবো ফ্যান

বউয়ের বায়না শাড়ি-চুরি

ঈদ হবেনা কেন!

মুখ হাত-পা চোখ ফুলেছে

গৃহেই আছি বন্দি

দূর হ বলি যা করোনা কর

না ফেরার সন্ধি। 

কেমন করি কি করি ভাই

নাই টাকা নাই কাম

ওরে হাতে ধরি পায়ে ধরি

থাম করোনা থাম।

শিরংগল, ভোজেশ্বর, নড়িয়া, শরীয়তপুর।

কোয়ারেন্টাইনে উমা
সবিতা কুইরী

চীন দেশের পর্বত এক
     কৈলাস তার নাম
উমার স্বামী মহাদেবের
     সেইখানেতেই ধাম।

মহাদেবের সেবায় উমা
     থাকেন শ্বশুর ঘরে
বাপেরবাড়ি শরৎকালে
     আসেন সময় করে।

গ্রীষ্ম শেষে বর্ষা এবার
     শরৎ অতি কাছে
মহামারী দেখে ভোলা
     বাধা দেন পাছে।

মধুর স্বরে গৌরী কহে
     স্বামী মহাদেবে
বাপেরবাড়ি যাওয়ার উপায়
     বলতে তোমায় হবে।

চীন ভারতের দুটি বডার
     পথের পরে পাব-
ছোঁয়াচে ঐ দানবেরে
     সঙ্গে নিয়ে যাব?

দয়া কর ওগো প্রভু
     দয়াময় স্বামী
নিরাপদে বাবারবাড়ি
     যেতে চাই ‘আমি’।

হরগৌরীর বাক্যালাপে
     উপায় এক জাগে
গৌরী এবার রওনা দেবে
     একমাস আগে।

দুটি দেশের দুই বডারে
     চৌদ্দ দিন করে
কোয়ারেন্টাইন শেষে উমা
     আসবে নিজের ঘরে।

সহবাস – আশীষ কুমার পাল

অসহায় পিতা সন্তানের খুশির জন্য কত হাসি হেসেছে,
কত লান্ছনা সহেছে পরিবারের কাছে!
চোখের অশ্রুতে কত পারাবার তৈরী হয়েছে!
কতবার ভেজা বালিশটা উল্টেছে!
ছেঁড়া জুতোর যন্ত্রণায় কত পথ রক্তাক্ত করেছে,
কত গ্লানির ধিক্কারে নিজেকে ধিক্কৃত করেছে,
কতবার মুখোশটা পাল্টেছে,
কত অভাবের পাহাড় ডিঙিয়েছে,
কতবার তার সলিল সমাধি হয়েছে,
কুটো না পেয়ে জলকেই আঁকড়ে ধরেছে,
কতবার কত স্রোতে যে ভেসেছে,
বাকি চাওয়ার আশায় কতগল্প ফেঁদেছে,
কতবার মিথ্যা প্রলোভনে পাতা ফাঁদে
পা দিয়েছে,
মিলিত হবার আশা নিয়ে কতদিন সমান্তরাল লাইনে হেঁটেছে,
কতবার যে অনুঘটক হয়েছে,
প্রয়োজনের আয়োজনে কত মিথ্যার স্তুতি করেছে,
বাস্তবের রুক্ষ জমিতে যে কতবার আছাড় খেয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে,
কতবার শৈশবের জাবর কেটেছে,
কতবার যমদূত ইন্টারভিউ নিয়েছে,
ফাঁকা জেনেও ব্যাঙ্কে কতবার লাইন দিয়েছে,
বউ এর বকুনি খেয়ে হাসিমুখে মায়ের
সম্মুখিন হয়েছে,
উল্টোটাও কত্তবার হয়েছে,
কত কষ্টে চোখের জল শুখিয়েছে,
দাগ আছে,জীবনে দাগ নেই,
যন্ত্রণায় মলম হয়ে অশ্রুর সঙ্গে সহবাস করেছে ,

চিঠির বাক্সকথা – সঞ্চিতা রায়

আমি তোমাদের বাড়ীর প্রবেশদ্বারে ঝুলে থাকা  পুরাণ  একটি  চিঠির  বাক্স। 

আজ আমি গুরুত্বহীন।

একসময় ছিল আমার অপরিসীম গুরুত্ব। 

বাড়ীর ছেলে মেয়েরা চাকরিপ্রাপ্তি চিঠি পাওয়ার আশায় বারংরার ছুটে আসত আমার কাছে। 

 পেয়ে সেই প্রতীক্ষিত চিঠি, 

ভরে উঠত তাদের মুখ অনাবিল হাসিতে |

বাড়ির কোনো কোনো সদস্য বা সদস্যা থাকত অপেক্ষায়

প্রেমিকা বা প্রেমিকের রঙিন রঙিন প্রেমপত্রের আশায়। 

আজ তো সবই ইতিহাস। 

প্রথমে এল দূরভাষ, কেড়ে নিল আমার একাধিপত্য| 

বিজয়ার বা নতুন বছরের প্রণামবার্তা র চিঠি হ’ল বন্ধ। 

পৌঁছসংবাদ তাও তো দূরভাষেই চালু হ’ল| এল চলমান দূরভাষ, আরো গুরুত্ব হারালাম আমি। ডাকপিওনেরা আমার বাক্সে

চিঠি দিয়ে যেত, এল ক্যুরিয়ার, ক্যুরিয়ার দূতরা

সই করিয়ে দিতে লাগল চিঠি। 

আমার কাছে তোমাদের আনাগোনা বন্ধ হ’ল। 

আর এখন হোয়াটসঅ্যাপ আরো নানা সোস্যাল নেটওয়ার্ক চিঠির জায়গা নিয়ে নিল, আমি বা আমরা হয়ে গেলাম একা,বড়ই একা। 

সেদিন হয়তো এসে গেল 

যেদিন চিঠির বাক্স  কথাটাই হয়ে যাবে ইতিহাস। 

থাকবো না আমরা কোনো বাড়ি র প্রবেশদ্বারে বা প্রাচীরে।

তবু আমাদের মাঝে মাঝে স্মরণ কোরো। 

পরবর্তী প্রজন্মকে আমার আমাদের কথা একটু বোলো।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *