Nandita

nandita

মাছরাঙার দেশে


স্বনন্দিনী

আলকাতরায় ছোবানো মাঠকোঠা। অফুরন্ত সবুজের হাতছানি ।দিঘী ভরা মাছ। উঠোন ভরা ধান। নিস্তব্ধ দুপুরগুলোতে মাছরাঙা, বউ কথা কও ,কিংবা শালিখ চড়ুইয়ের কিচিরমিচির ।আল পথ ধরে চলে যাও রিক্ত শস্য ক্ষেত্রগুলোতে দেখবে, ভাদ্দর মাসে ধান কাটা শেষে ক্ষেতগুলো যেন খানিক জিরিয়ে নিচ্ছে।

গ্রামে যাবেন? আসুন আমার সঙ্গে। কাটোয়া বোলপুর জাতীয় সড়কের ধারে এক ছায়াঘেরা স্বপ্নগ্রাম। রাস্তার দু’পাশে উঁচু উঁচু মাটির দোচালাগুলো যেন আপনাকেই অভ্যর্থনা করে দাঁড়িয়ে আছে। মোরাম বিছানো রাস্তা পেরিয়ে যেই না আপনি সেই কোঠা বাড়ির উঠোনে পা দেবেন, কানা উপচে পড়া এক গ্লাস নুন -চিনি -লেবুর শরবত আপনার পথশ্রমকে মুহূর্তেই শীতল করে দেবে।

পরিচ্ছন্ন হয়ে বাড়ির অন্দরমহলে প্রবেশ করার পর হয়তো আপনার জন্য আসবে কুসুম ফুলের বিচি মেশানো, সুগন্ধি আম তেল মাখানো, হলুদাভ এক কাঁসি চাল ভাজা ও গোটা কতক শিরির, গুঁড়ের ও তিলের নাড়ু। আপনি যদি এই গ্রামে ইতিপূর্বে না এসে থাকেন তবে আপনার আপ্যায়নকারীরা যখন শিরির নাড়ুটা ঠিক কতটা টান হওয়ায় পরিবারের ইজ্জত রক্ষা হলো এ নিয়ে তরজাই মেতে উঠবে আপনি তখন নাড়ুতে কামড় বসাতে গিয়ে হয়তো বিষম খাবেন !

সাঁতার জানেন? চাইলে বাড়ির সামনের পুকুরটায় খানিকক্ষণ সাঁতরে নিতে পারেন। ইচ্ছা থাকলে বরশি নিয়ে মাছও ধরতে পারেন। কিচ্ছু না চাইলে স্রেফ মাধবীলতা ও তেঁতুলের ছায়া-ঘেরা পুকুর পাড়ে বসে বক ও মাছরাঙ্গাদের দেখেই ঘণ্টা কতক সময় কাটিয়ে দেওয়া যায়।

দুপুরে শুরু হবে মাছ উৎসব। জানেন কি, আপনি আসছেন জেনে অতিথি আপ্যায়নের জন্য বাড়ির সংলগ্ন পুকুরটায় সকালবেলায় জাল ফেলা হয়েছিল! এবারে সেগুলি পাক করার পালা। দেখবেন বাড়ির কর্তা-গিন্নি মিলে এক বড়সড়ো কড়াই চড়িয়েছেন গ্যাস বার্নারে ।বাড়ির ছোট বড় সব সদস্যরা গোল হয়ে ঘিরে বসেছে রান্নাঘরটিকে।

এবারে শুধু ছ্যাক-ছোঁক শব্দ! চোখের নিমিষে কেজি পাঁচেক গরম মাছ ভাজা যেন হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে। দুপুরে ভাতের পাশেও পাবেন মাছের রকমারি পদ। মাছে- পেঁয়াজে, মাছ ঝালদা, মাছ চচ্চড়ি, মাছের টক, মাছ পোস্ত জিভে জল আনা সব এক একটা পদ। কি মশাই! নগর কলকাতার ফুড ফেস্টিভ্যালের কথা মনে পরছে? ধ্যুস্, কিসে আর কিসে তুলনা দাদা!

খানিক বিশ্রামের পর, বিকেলে যদি গ্রাম ঘুরতে বেরোন, দেখবেন মাটির বাড়িগুলো থেকে উঁকিঝুঁকি মারছে বেশ কিছু কাঁচা পাকা মুখ। তাদের দৃষ্টিকে অনুসরণ করে নিজেকে হয়তো আপনার উত্তম বা সুচিত্রা মনে হতেই পারে! কিন্তু গ্রামের ধর্মরাজ তলা, কালাচাঁদ ঠাকুর বা জটাধারীতলা সম্বন্ধে বিস্তৃত শোনার পরও আপনি যখন ধর্ম ঠাকুর আসলে শিব, বিষ্ণু না সূর্যের অবতার এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাবেন না তখন নির্ঘাত আপনার নাগরিক অহমিকা ধাক্কা খাবে!

রাতে ঘরে ফিরে, দেশি গাইয়ের খাঁটি দুধের বাটি হাতে ,আপনি হয়তো আলাপচারিতায় মেতে উঠেছেন। আর তখনই শুনবেন বাঞ্ছারামের সাজানো বাগানের আড়ালের কান্নাগুলোকে। চাষে লাভ নেই; গ্রামে ভালো চিকিৎসা পরিষেবা নেই। গল্প শুনবেন পাশের বাড়ির রহমত চাচা কিভাবে জমি বেঁচে লাখ দশেক টাকা ছেলের প্রাইমারি স্কুলে চাকরির জন্য এক দালালের হাতে তুলে দিয়ে সর্বশ্রান্ত হয়েছেন!

জানতে পারবেন গ্রামের ঝকঝকে ছেলেরা কিভাবে এ রাজ্যে মনমতো কাজ না পেয়ে পাড়ি জমিয়েছে ভিন্ রাজ্যে। এখন সেখানেই বসত গড়েছে। ভুলেছে গ্রামকে! উঠতি মেধারাও নেতা মন্ত্রীদের চামচাদের ঘরে থরে থরে সাজানো সাজানো নোটের তারা দেখে মুছরে পড়েছে। স্বপ্নহীন এক প্রজন্ম যেন!

সুন্দর একটা ছুটি কাটিয়ে আপনি যখন ফিরে আসবেন সেই গ্রাম থেকে, তখন হয়তো হাজারো প্রশ্ন উথাল পাথাল করছে আপনার মনে। এই যেমন ধরুন, গ্রাম তো দিয়েই গেল চিরটাকাল! বিনিময়ে পেল কি? যে আন্তরিকতা ও আতিথেয়তার ওম আপনাকে মুড়ে রয়েছে এখনো কি ফিরিয়ে দিতে পারলেন তাকে? আপনার ভিতরে যে আলো রয়েছে তা দিয়ে একটা প্রদীপও কী জ্বালিয়েছেন কখনো এই মানুষগুলোর জন্য?

‘তেলেনাপোতা আবিষ্কার’ গল্পের মতই গৃহের নিশ্চিন্ত নির্ভরতায় ফিরে এই প্রশ্নগুলো আপনাকে হয়তো খোঁচা মারা থামিয়ে দেবে একদিন । আপনি ডুবে যাবেন রোজনামচায়। শুধু চোখের সামনে ভেসে বেড়াবে পুকুর পাড়ে মাছরাঙাদের ডানা ঝাপটানি!

৩০-০৯-২০২২।

2 thoughts on “Nandita”

  1. খুবই মনে দাগ কাটলো লেখাটি । অনেকবার পড়লাম । ছবির মতো ভাসছে সব কিছু । আরো একটি লেখা পড়েছিলাম শাপলা বড়ুয়ার , এই রকম প্রবন্ধ কম আসে পত্রিকায় ।

  2. পাঠকের ভালো লাগলে এরকম আত্মনিষ্ঠ প্রবন্ধ পত্রিকায় আরো পাবেন আশা রাখছি।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *