Nandini

nandini

চায় পে চর্চা
স্বনন্দিনী

নাহ্ আমার সঙ্গে বিশেষ ভাব নেই তেমন। সকালেই যা একবার পরস্পরের কাছাকাছি আসা । ইনি কিন্তু জনপ্রিয় খুব। শুনেছি চীন দেশে জন্ম। সেখান থেকেই ইউরোপীয় সাহেবদের হাত ধরে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় আগমন। ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তর-পূর্বের পাহাড়ি ঢাল এনার বড্ড প্রিয়। চট্টগ্রাম ,সিলেট ,আসাম, দার্জিলিং ই এনার পছন্দের চারণভূমি।

ইহাতে নাই কোন মাদকতা দোষ
করিলে পান তবেই চিত্ততোষ ।

‌ ‌ ঘড়ির কাঁটা দশটা চল্লিশ ছুঁই ছুঁই। জল, স্থল ,পাহাড় ডিঙিয়ে ইস্কুলে হাজির হয়ে গেছেন একদল জ্ঞানবৃক্ষ। প্রথম দুটি পিরিয়ড গেল। মগজাস্ত্র নিভু নিভু। গলা শুকিয়ে কাঠ। একটা পরিচিত গন্ধের জন্য মনটা আনচান করছে। দিদিমণি হাঁক পারলেন চা…। কোথায় কী! ভোঁ ভাঁ। দাদাবাবুদের রকমসকম অবশ্য ভিন্ন। চোখেমুখে কেমন একটা নিশ্চিন্তভাব। যেন বাতাসে তার আসার খবর পেয়েছেন তারা। সরকারি অফিস গুলোর অভিজ্ঞতা অবশ্য আলাদা।

তোমাকে চাই …

আচ্ছা ধরুন, কাঁধে ঝোলাব্যাগ ,গালে মাসখানেকের নাকামানো দাঁড়ি, চোখে কালোফ্রেমের চশমা এক ভাবুক ধোঁয়ার কুন্ডলী পাকিয়ে যাচ্ছেন… পাকিয়ে যাচ্ছেন… কিস্যু মাথায় আসছে না। কিম্বা সন্ধ্যেবেলায় বোকাবাক্সের সামনে বোকা হতে বসেছেন জনাকয়েক। অথবা অযাচিতভাবে অপরাহ্ণে এসে হাজির হয়েছেন রাই কাকিমা ,চম্পা জেঠিমারা। তিন ক্ষেত্রেই মোক্ষম দাওয়াইটি কি বলুন তো!

বহুরূপে সম্মুখে তোমার…

নানা রূপে ইনি মোহময়ী। সবুজাভ, লালচে, সাদাটে, আদা সহযোগে ,মশলা মিশ্রিত কত কী! সর্বোপরি ‘চিনি কম’ অথবা with sugar. শীতের দিনের অব্যর্থ টনিক। আয়েশী রোদে পিঠ দিয়ে বসে এক কাপ ‘Hot tea’… ব্যাস, ‘করলো দুনিয়া মুঠ্ঠী মে’।

চেনা বামুনেরও পৈতে লাগে

জলব্যতীত পৃথিবীর সর্বাধিক জনপ্রিয় পানীয় হলো চা ।অথচ কফির মত তাকে ঘিরে সেরকম রাজকীয় ‘হাউস’ গড়ে উঠতে দেখেছেন কেউ ? পাড়ার চায়ের ঠেকগুলোই যা তার ব্র্যান্ডিং করে। নিদেনপক্ষে কিছু গান ও তো রচনা হতে পারতো! এক্ষেত্রেও হাতে হ্যারিকেন। শুধু কবীর সুমনই যা কুল রাখলেন। মুম্বাইয়ের নামী প্রযোজক – পরিচালক কফিকে সঙ্গে নিয়ে সেলিব্রিটিদের সাক্ষাৎকার নিতে বসলেন। আমরা হাঁ করে সেই দৃশ্য গিললাম। কিন্তু চা কে ঘিরে এমন উন্মাদনা কৈ? ভাবটা যেন এমন যে, ঘরের মেয়ের আবার দরবারে ঠাঁই হয় না কী! এ ব্যাপারে ধন্যবাদ দিতে হয় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীজীকে। চা কে সঙ্গে নিয়ে বেতার তরঙ্গে ভেসে তিনি পৌঁছে গেলেন ভারতবাসীর অন্দরমহলে। আর কিছু না হোক চা ভারতবর্ষের এক নম্বর পানীয়র মর্যাদা টা তো পেল!

শত শত সাম্রাজ্যের ভগ্নশেষ ‘পরে
ওরা কাজ করে।

১৯২০ সালে ২১শে মে তারিখটিকে ইউনেস্কো আন্তর্জাতিক চা দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছে। বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা দারিদ্র ও অপুষ্টিতে চায়ের অমূল্য অবদানের প্রতি সচেতনতা বাড়াতে এবং এর গুরুত্ব সকলের কাছে পৌঁছে দিতে এই পদক্ষেপ। অথচ একটু সতর্ক দৃষ্টি রাখলেই টের পাওয়া যায় এই পেশার সঙ্গে জড়িত শ্রমিকদের জীবন কতখানি অপ্রাপ্তিতে ঘেরা। ভারত, বাংলাদেশ ,শ্রীলংকার অন্যতম রপ্তানিকারক ফসল এটি। কিন্তু শ্রমিকেরা কমমজুরি, অপুষ্টি, অশিক্ষা ও অস্বাস্থ্যের শিকার। চা শ্রমিকদের একটা বড় অংশ মহিলা। অথচ চা বাগানগুলিতে শৌচব্যবস্থা বেহাল। মেয়েদের মধ্যে তাই জরায়ু ক্যান্সারের প্রবণতাও বেশি।

শুধু বর্তমান বঞ্চনাই নয় চা শিল্পের গায়ে লেগে আছে অনেক রক্তাক্ত ইতিহাস। আমেরিকার ‘বোস্টন টি পার্টি’ আন্দোলনের কথা মনে পড়তে পারে। আমাদের এই উপমহাদেশে রয়েছে ‘মুল্লুকে চলো’ আন্দোলন। সিলেটের মালিনী ছড়া চা বাগানে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আঠারোশো পঞ্চাশের দশকে চা চাষ শুরু করে। বাগান তৈরি ও পরিচর্যার জন্য বিহার, উড়িষ্যা ও দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দরিদ্র শ্রমিকদের প্রলোভন দেখিয়ে নিয়ে আসা হয়। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে ভূমির অধিকার না পেয়ে ও নানাবিধ অন্যায় অত্যাচারের সম্মুখীন হয়ে একসময় শ্রমিকরা বিদ্রোহ করে ‘মুল্লুকে চল’ হাঁক দেয়। প্রায় ৩০ হাজার শ্রমিক পায়ে হেঁটে চাঁদপুর মেঘনা ঘাটে এসে পৌঁছান । ১৯২১এর ২০শে মে ইংরেজ পুলিশ বাহিনী নির্বিচারে তাদের ওপর গুলি চালায়। এই ঘটনার পর থেকেই ২০শে মে কে চা -শ্রমিক দিবস হিসাবে ঘোষণার দাবি জানানো হতে থাকে। যদিও সে স্বপ্ন আজও অধরা।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *