
ঋতুরানী শরৎ
মোবারক মন্ডল
প্রকৃতিতে নববধুর ন্যায় সুসজ্জিত শরৎ ঋতু বহমান।
গ্রামের মেঠো পথের ভোরে হালকা কুয়াশা। সূর্যোদয়ের মুহূর্তে মৃদু হাওয়া। এরপর কাঠফাটা রোদ। আবার পরক্ষণেই ঝুম বৃষ্টি। বৃষ্টিও এদিকে আছে, তো ওদিকে নেই। এই তো শরতের রূপ।
বর্ষার ঝরঝর বাদল যখন বিরহকাতর প্রেমিক হৃদয়ের আকাশে কান্না হয়ে ঝরে,তখনি সজীব প্রকৃতি এই বিরহ- ব্যাথায় প্রশান্তির প্রলেপ দিতে নিয়ে আসে শরতের শুভ্রতার ছোঁয়া। এই ছোঁয়ার স্নানে শুদ্ধ হয় প্রতিটি হৃদয় মন। এর সাথে অনাবিল আনন্দের ঝর্ণা হয়ে আসে সুনীল আকাশের স্বচ্ছতায় শিমুল তুলার মতো শাদা শাদা মেঘ। প্রকৃতিও নানান বাহারী ফুলের সজ্জায় সাজিয়ে তুলে তার অঙ্গ সৌষ্ঠব। শিউলি, বেলী, কাশফুল প্রভূতি ফুল বিমোহিত করে তৃষ্ণার্ত আঁখি। গ্রামের বধূ যেমন মাটি লেপন করে নিজ গৃহকে নিপুণ করে তোলে, তেমনি শরৎকাল প্রকৃতিকে সুন্দর করে সাজিয়ে দেয়।
শরৎকালের শুরু থেকেই প্রকৃতি নতুন সাজে সাজতে শুরু করে। অপরূপ বিভা ও সৌন্দর্যের কারণে শরৎকালকে বলা হয়ে থাকে ঋতুরানী। শরৎকে বলা হয় শুভ্রতার প্রতীক। সাদা কাশফুল, শিউলি, স্নিগ্ধ জ্যোৎস্না, আলোছায়ার খেলা চলে দিনভর। শরৎ প্রকৃতিকে যে মোহনীয় রূপ-রসে সাজায় তাতে প্রতিটি হৃদয়কে উতলা করে তোলে।নীল আকাশের শাদা মেঘ নিয়ে আসে কোমল আনন্দের বার্তা।রপময়,নির্মল শরত প্রকৃতির সাথে সাথে মানুষের মনকেও করে তোলে কাব্যিক। রাতের অপূর্ব স্বচ্ছ জোছনায় ভিজে উঠে রোমান্টিক মন।সৃষ্টি হয় অসাধারণ সব কবিতা,গান আর সুরের ছন্দ । শরতের স্নিগ্ধতা এক কথায় অসাধারণ! জলহারা শুভ্র মেঘের দল যখন নীল, নির্জন, নির্মল আকাশে পদসঞ্চার করে তখন আমরা বুঝতে পারি শরৎ এসেছে। শরতের আগমন সত্যিই মধুর।
শরৎকালের প্রথম মাস অর্থাৎ ভাদ্রের শুরু থেকেই শরতের আবির্ভাবটা লক্ষণীয়। ঋতু পরিক্রমার তৃতীয় ঋতু শরৎকাল। গঠিত হয় ভাদ্র ও আশ্বিন মাস নিয়ে। খ্রিষ্টীয় পঞ্জিকা অনুসারে মধ্য আগস্ট থেকে মধ্য অক্টোবর পর্যন্ত শরৎ ঋতুর পথচলা। এই সময় কাশফুলের অপরূপ সৌন্দর্য পুলকিত করেনি এমন মানুষ খুঁজে মেলা ভার। গাছে গাছে শিউলির মন ভোলানো সুবাসে অনুভূত হয় শরতের ছোঁয়া। শরতের মেঘহীন আকাশে গুচ্ছ গুচ্ছ কাশফুলের মতো সাদা মেঘের ভেলা কেড়ে নেয় মন। শরৎকালেও বর্ষণ হয়, তবে বর্ষার মতো অবিরাম নয়। বরং শরতের বৃষ্টি মনে আনন্দের বার্তা বয়ে আনে। চারপাশের শুভ্রতার মাঝে বৃষ্টির ফোঁটা যেন আনন্দ-বারি! বৃষ্টি শেষে আবারও রোদ। দিগন্তজুড়ে সাতরঙা হাসি দিয়ে ফুটে ওঠে রংধনু। প্রকৃতির এ অপরূপ যেন প্রিয় মানুষের সান্নিধ্য চায়। হয়তো ইচ্ছা হয় গোধূলির ওপারে হারিয়ে যেতে প্রিয়জনের হাতটি ধরে। তাই তো কবি বলেছেন –
“প্রিয়তম আমার,ঐ চেয়ে দেখ,নববধুর ন্যায় সুসজ্জিত শরতকাল সমাগত।’ ‘কাশফুলের মতো যার পরিধান, প্রফুল পদ্মের মতো যার মুখ, উন্মত্ত হাঁসের ডাকের মতো রমনীয় যার নুপুরের শব্দ, পাকা শালি ধানের মতো সুন্দর যার ক্ষীণ দেহলতা, অপরূপ যার আকৃতি সেই নববধুর মতো শরৎকাল আসে।’
কবি শরৎ কে অপরূপা, সুন্দরী নারীর দেহের সৌন্দর্যের সঙ্গে তুলনা দিয়েছেন।
শরতের ভোরে ফোটা শিউলি ফুল আর দূর্বা ঘাসের ডগায় শিশিরের জল দেখে মনে হয় প্রকৃতির সব সৌন্দর্য উদার হাতে দান করেছে শরতের প্রভাতকে। কাশবনে পড়ন্ত বিকালের অনুভূতি। শরতের মৃদু বাতাসে সি্নগ্ধ রোদ দিঘির জলে চিকচিক করে। সত্যিই অসাধারণ অনুভূতি। শরতের নান্দনিক সৌন্দর্য, স্বচ্ছ সকালের কোমল রোদ, পূর্ণিমা রাতের অসাধারণ সুন্দর জোছনা সবার মন-মন্দিরে এক স্বর্গীয় অনুভূতির দোলা দেয়।নীল আকাশে শুভ্র মেঘের আনাগোনা, নদী তীরের শাদা কাশফুল কাব্যিক এই উপমাই শরতের কবিতার সুর। শরতের আরেকটি উল্লেখ যোগ্য দিক হলো—এ সময় মাঠ জুড়ে থাকে সবুজ ধানের সমারোহ। ধানের কচিপাতায় জমা হওয়া শিশিরের ওপর প্রভাতের তরুণ আলো মুক্তার মতো দ্যুতি ছড়ায়। আমাদের দেশের কৃষকরা নবান্নের আশায় দিন গোনে।
পরিশেষে বলা যায়, শরত প্রকৃতিকে অপরূপ রূপে সাজিয়ে যায় যার আবেশে অতি সাধারন মানুষ ও ভাবাবেগে আপ্লুত হয়।শরত অবসাদগ্রস্ত মনেও নতুন প্রেরণার সঞ্চার করে।তাই তো আমরা প্রকৃতিতে দেখি, এই ঋতুতে কি অপূর্ব রঙের খেলা, কি অপরূপ রঙিন ভুবন সাজায় প্রকৃতি। শরৎ এ প্রাণবন্ত রূপ নিয়ে হেসে ওঠে গ্রাম বাংলার বিস্তৃত দিগন্ত।