ধুলোয় লেখা প্রেমের কাব্য
তৈমুর খান

তরুণ কবি মতিলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘গোছা ফুলের বাগান'(প্রথম প্রকাশ ২০২২) হাতে এসে পৌঁছেছে। বিশেষ নাট্যকর্মী থেকে কবিতায় পদার্পণ পাঠক হিসেবে আমাদেরও কৌতূহলী করেছে। কাব্যখানি খুলেই ‘ধুলোয় লেখা প্রেম’ নামে একটি কবিতার শেষ পাঁচ লাইনে চোখ আটকে গেল:
“কথায় কথায় মহাভারতে রাত জাগা চাঁদ,
ফেনিল জোছনার নীচে দুই মায়াময়
ছোট্ট কোটরে জমায় রঙিন পাথর,
ঝিঁঝিঁ ডাকা রাত ধুলোয় লেখে প্রেম,
খাদের কিনারে স্বপ্ন হাতড়ায় খরকুটো।”
অংশটিতে একটা ছবি ভেসে ওঠে, কিন্তু সেই ছবিটা খুব সাধারণ নয়, যখন ‘মহাভারত’ শব্দটি লেখা হয় তখন চাঁদেরও জ্যোৎস্না ছড়ানো অন্যমাত্রা পায়। যদিও চাঁদকে ‘রাতজাগা’ অবস্থায় দেখা গেছে। ‘মহাভারত’ মহাজীবনের কাব্য, যা আবহমান সমস্ত মানুষেরই জীবনচেতনার তাৎপর্য বহন করে। আর সেইসব জীবনের আকাশে চাঁদের রাতজাগাও শেষ হয় না। তারই জ্যোৎস্নায় ‘দুই মায়াময়’ রঙিন পাথর জমায়। এখানে ‘মায়াময়’ শব্দটা শুধু লক্ষ্মীপেঁচা কিংবা কোনো পাখির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়।তা আবহমান নারী-পুরুষ হয়ে যায়। ‘রঙিন পাথর’ আমাদের মোহাবিষ্ট বস্তুর প্রতীক। যা স্বপ্নরাজ্যের রোমান্টিক ভাবালুতায় পর্যবসিত করে। ঝিঁঝিঁডাকা সেই রাত মাটির পৃথিবীতে প্রেম লিখে চলে আর খাদের কিনারে ভাসা খড়কুটো স্বপ্ন হাতড়ায়। জীবনচারণার আবেগি প্রক্ষেপণ থেকে মর্মরিত সত্যটি রূপকআশ্রয়ে আলোড়িত হয়েছে। মানুষের কাছে বাঁচার তাগিদ, আত্মরক্ষার তাগিদ, স্বপ্নরচনার তাগিদ সবকিছুই এক আদিম প্রজ্ঞায় বাহিত হয়। তারই যাবতীয় প্রতিফলন নানা ক্রিয়ার সংরাগে প্রকাশ পায়। এখানেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। মানুষের মৌলিক স্ট্রিংক্ট কখনো পরিবর্তন হয় না। পাবলো নেরুদা একটা কবিতায় লিখেছেন:
“As if you were on fire from within.
The moon lives in the lining of your skin.”
অর্থাৎ
যেন ভেতর থেকে আগুন জ্বলছে।
চাঁদ তোমার ত্বকের আস্তরণে বাস করে।
এই ভেতরের আগুনকে আমাদের প্রাণসত্তার শিখা হিসেবেই তার প্রকাশকে উপলব্ধি করি। আগুন তো প্রবৃত্তিমুখিন জীবনের ভাষাই, চাঁদ সেখানে জ্যোৎস্নাময় রোমান্সের প্রক্রিয়ার স্বপ্ন-জাগরণের ক্ষেত্র। এই চাঁদকেই ধারণ করে কবি ‘চাঁদমুখ’ কবিতায় লিখেছেন:
“আধো চাঁদের গায়ে হাত রেখেছি
জল খাওয়া করতলের মুদ্রায়
পান করেছি আকণ্ঠ জ্যোৎস্না
চাঁদের প্রহরী সেজে তুমি
সবটুকু চৌর্য সম্পদ শুষে নিতে
দীর্ঘ চুম্বন করেছ কম্পিত ঠোঁটে
এ জীবনে মরে যাওয়ার পর
নিঃস্ব হাতে বারংবার ফিরেছি
শুধু চাঁদের মুখের পানে চেয়ে।”
কবিও এই মানব শরীরে চাঁদের দেখা পেয়েছেন। জ্যোৎস্না পান করে দীর্ঘ চুম্বনের প্রত্যাশাকে জাগ্রত করেছেন। চাঁদের মুখ পানে চেয়ে মৃত্যুকেও বাতিল করেছেন জীবনের গরিমায়। কাব্যের ৪২টি কবিতায় জীবনধারার আবেগীয় স্রোতকে তিনি স্বাভাবিক ছন্দেই প্রবাহিত করেছেন। মায়ের জন্য যে এপিটাফে সুদৃশ্য ঝিনুক সাজিয়েছেন, সেই এপিটাফে নিজের পুনর্জন্মের নৌকাও ভাসিয়েছেন। যে আকাশে রংধনু নেই, সেই আকাশকেও সংগ্রামী জীবনের প্রত্যয়ী ছাদ ভেবেছেন। মনখারাপের বিকেলবেলায় নীলপ্রজাপতির সান্নিধ্য জাগিয়ে তুলেছেন। অন্ধকার জটিল জীবনাচার থেকে বেরিয়ে এসে সাদাচোখে সরল অনাড়ম্বর জীবনপ্রজ্ঞাকে ধারণ করতে চেয়েছেন। কবিতায় সেই ‘আনন্দময় সুখে’রই প্রকাশ:
“যে বৃষ্টি ধারায় বিষাদ মোছে অশ্রু
তার নামে বসন্ত বাহার
যে নক্ষত্র দেখে ব্যথাতুর ঘুম আসে
তার নামে স্বপ্ন সাজায় বুক
যে ভরসায় পদবীতে বিশ্বাস লেখো
তার নাম আনন্দময় সুখ।”
বৃষ্টিধারা কান্না হলেও তা বিষাদ মুছে দেয়। বসন্তের আগমন সূচিত করে। যে নক্ষত্রে ব্যথাতুর ঘুমের আয়োজন করে, সেই ঘুমও স্বপ্ন এনে দিতে পারে। বিশ্বাস শব্দটি শুধু পদবীর নয়, তা প্রত্যয়েরও। মহাকবি উইলিয়াম শেক্সপিয়র লিখেছেন:
“Love comforteth like sunshine after rain.”
অর্থাৎ ভালোবাসা বৃষ্টির পরে রোদের মতো সান্ত্বনা দেয়।
সুতরাং ভালোবাসা দুঃখের যেমন, তেমনি সুখেরও। জীবনের অন্তরায়, শূন্যতাগুলি এই ভালোবাসার জ্যোৎস্নায় ভরে উঠেছে। তাই কবিতাগুলিতে এক রকমের romantic pain এর দেখা পাওয়া যায়। বারবার একই রকম আবহাওয়া ফিরে এসেছে।
গোছা ফুলের বাগান: মতিলাল গঙ্গোপাধ্যায়, বার্ণিক প্রকাশন, কৈয়ড়, পূর্ব বর্ধমান-৭১৩৪২৩, প্রচ্ছদ:তৌসিফ হক, মূল্য ১২৫ টাকা ।
