পানুর ডায়েরী – ৩
মুহাম্মদ সেলিম রেজা
অজয় নামে একটি ছেলে পানুকে সময়ে অসময়ে বিরক্ত করত। কখনও চুল টেনে দিত, কখনও বা কান মলে দিত। এমনও হয়েছে স্যার পড়া ধরেছেন, পানু বলার জন্য উঠছে অজয় তখন তার সার্ট চেপে ধরেছে। একদিন তো ইয়ার্কির ছলে ধাক্কা মেরে পুকুরে ফেলে দিয়েছিল।
অজয় গাট্টাগোটা জোয়ান। ইচ্ছা করলে পানুকে উকুনের মতো দু’-অঙুলের টিপে মেরে ফেলতে পারে। তারওপর সে স্থানীয় ছেলে। পড়শোনার ধার ধারে না, অফ পিরিয়ডে একদল বখাটে ছেলে নিয়ে মস্তানি করে বেড়ায়। সব মিলিয়ে পানুর কোন যোগ্যতাই ছিল না অজয়ের মোকাবেলা করার। আমরা ক’জন সহপাঠী একদিন পানুর হয়ে বলতে গেলে অজয় আমাদেরই থ্রেট করে বসল।
পানু কিন্তু চুপচাপ বসে ছিল না, বলে পারবে না জেনে কলে মারার পথ খুঁজছিল সে। দূরে দূরে থেকেও খবর রাখত অজয়ের প্রত্যেকটি মুভমেন্টের। এইভাবে সে একদিন জানতে পারে সায়েন্সের নম্রতার প্রতি তার দূর্বলতা আছে, কিন্তু মেয়েটি তাকে মোটেই পছন্দ করে না। মোক্ষম সূযোগ, গুছিয়ে একখানা প্রেমপত্র লিখে পরদিন স্কুলে এসে নম্রতার বাংলা বইয়ের মধ্যে রেখে দিল পানু।
বাপরে! সে একটি দিন গেছে।
তিন পিরিয়ডে বাংলা বই খুলতে গিয়ে পত্রখানা নম্রতার চোখে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে সে তা তুলে দিল স্যারের হাতে। বাংলার প্রতাপস্যারের পরিচয় আমরা আগেই পেয়েছি। তিনি পত্রখানা চোখের সামনে মেলে ধরে পাঠে মনোনিবেশ করলেন। আমরা ছাত্রছাত্রীরা বিস্ফারিত্র নেত্রে তাঁর মুখ পায়ে চেয়ে বুকের ধুকপকানি গুনছি। ওদিকে পত্রে ব্যবহৃত শব্দবজ্রের আঘাতে প্রতাপস্যারের ভ্রূযুগল ক্রমাগত ওঠানামা করছে।
পত্রপাঠ শেষ করে স্যার দুই হাতের তালুতে থুতনি স্থাপন করে কিছুক্ষণ নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকলেন। তারপর সম্মুখে দৃষ্টি প্রসারিত করে তর্জনির ইশারায় অজয়কে কাছে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন, এটা তুমি লিখেছ?
অজয় তৎক্ষণাৎ বলল, না স্যার।
– তাহলে তোমার নাম লেখা কেন?
– আমাকে ফাঁসানোর জন্য কেউ এই কাজ করেছে।
– কেউ তোমাকে ফাঁসাতে চাইবে কেন? কার পাকা ধানে মই দিয়ে রেখেছো শুনি?
– বিশ্বাস করুন স্যার আমি….
অজয়কে কথা শেষ করতে না দিয়ে নম্রতা প্রতিবাদে ফেটে পড়ল, মিথ্যে কথা বলছে স্যার। মাঝেমধ্যেই ও আমাকে বিরক্ত করে।
অন্য মেয়েরাও নম্রতার হয়ে সাক্ষী দিল। বেগতিক বুঝে অজয় মরিয়া হয়ে উঠে বলল, হাতের লেখা মিলিয়ে দেখুন স্যার তাহলেই সব পরিস্কার হয়ে যাবে।
কথায় যুক্তি আছে। টিকটিকির মতো মাথা নেড়ে প্রতাপস্যার ঘোষণা দিলেন সবাই বাংলা খাতা জমা দাও। নির্দেশ পেয়ে একে একে সবাই খাতা জমা দিলে স্যার তা বগলদাবা করে ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেলেন। সাথে সাথে গুজগুজ ফিসফাস। সবার মুখে এক কথা, অজয় কী সত্যি নির্দোষ? সে যদি পত্র না লিখে থাকে তাহলে কে লিখেছে? না জানি কার কপালে আজ দুর্ভোগ আছে, ইত্যাদি ইত্যাদি।
কেউ না জানুক আমি জানি আসল অপরাধী পানু? কিন্তু সে একেবারে নির্বিকার। পেনের পিছনদিকটা কানের ফুটোয় ঢুকিয়ে বেদম কান চুলকাচ্ছে। আস্ত গাধা না হলে কেউ এতটা নির্লিপ্ত থাকতে পারে?
টিফিনের পর আমাদের পুনরায় এক খোঁয়াড়ে জড়ো করা হল। একটু বাদে বেতের ছড়ি হাতে প্রতাপস্যার প্রবেশ করলেন, পিছনে খাতা বগলে পটলাদা। তিনি তৎক্ষণাৎ খাতাগুলি টেবিলে রেখে দিয়ে চলে গেলেন। প্রতাপ স্যার চেয়ারে বসে একটি খাতা আলাদা করে রেখে বাকিগুলো নিয়ে পরপর নাম ধরে ডেকে ফেরত দিতে শুরু করলেন। ধীরে ধীরে টেবিল শূন্য হয়ে এল অথচ পানুর ডাক পড়ছে না। তবে কী….? না আর ভাবতে পারছি না। চরম উৎকন্ঠায় আমি তখন ঘামতে শুরু করেছি।
বেচারা পানু! কেন এ কাজ করতে গেলি কেন হতভাগা? প্রতাপস্যারের প্রতাপ কী তুই সইতে পারবি? পানুর ডাক পড়লে সশঙ্ক চিত্তে তার দিকে তাকিয়ে চমকিত হলাম। চোখেমুখে ভয়ের লেশমাত্র নেই, মিটিমিটি হাসতে হাসতে গিয়ে স্যারের সামনে দাঁড়াল। স্যার খাতাখানা তার হাতে দিয়ে বললেন, এই যে বাপের ছেলে হাতের লেখা এতো খারাপ কেন? মনে হচ্ছে যেন আরশোলা কালিতে চুবিয়ে খাতায় ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। কাল থেকে একপাতা করে লিখে এনে দেখাবি কেমন।
– ঠিক আছে স্যার। সুবোধ বালকের মতো ঘাড় নেড়ে পানু নিজের আসনে ফিরে গেলে স্যার জানালেন পত্রের লেখার সাথে কারও হাতের লেখা মেলেনি। কাজেই তিনি কাউকে শাস্তি দিতে পারছেন না। সেই সঙ্গে তিনি অজয়কে সাবধান করে দিলেন ভবিষ্যতে যেন সে আর নম্রতাকে বিরক্ত না করে।
স্যারের কথা শুনে আমার চোখ কপালে উঠে গেল। কিন্তু সেই মুহূর্তে আলোচনা করার অবকা না থাকায় বিমুর্ত পাথরের মতো বসে সময় অতিবাহিত করতে থাকতাম। ছুটি হলে পরে স্কুল কম্পাউণ্ডের বাইরে এসে পানুকে চেপে ধরলাম। সে তখন টাট্টুঘোড়ার মতো গর্দান উঁচু করে বলল, আমি কী এতোই বোকা যে নিজের হাতের লেখা দেব? ওটা ভাইপোকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছি।
চলবে……