Md. Akabbor Ali PK

ম্যাগনেটিক রহস্য ! ম্যাগনেটিক পিলার এত‌ই দামি !
বজ্রপাত ও ম্যাগনেটিক পিলার নিয়ে যত ভুল ধারণা।

লিখেছেনঃ

#প্রভাষক_একাব্বর_রসায়নবিজ্ঞান

“ম্যাগনেটিক সীমানা পিলার” নিয়ে যুগ যুগ ধরে নানাজনের নানা মত,গুজব‌ ও রহস্যময় কথা আজও সমাজে প্রচলিত। অনেকেই এই পিলারে প্লাটিনাম ও ইউরোনিয়ামের মতো মূল্যবান ধাতু রয়েছে বলেও
গল্প সাজান। তাই সাধারণ সীমানা পিলারকেও অনেকেই মহামূল্যবান মনে করেন। মহামূল্যবান মনে করার আরেকটি কারণ আছে। কষ্ঠিপাথরের মূর্তির মতো এদেশে “সিমানা পিলার” নিয়ে কেউ ধরা পড়লেই তার মূল্য নির্ধারণ করে বিভিন্ন মিডিয়ায় সংবাদ প্রকাশিত হয়।
যেমন: বরগুনার পাথরঘাটায় একজন পিলার সহ আটক হলে হাইকোর্ট আসামির জামিন আবেদন নাকচ করে দেন। সেই পিলারের আনুমানিক মূল্য
প্রায় 20 কৌটি টাকা ধরে সংবাদ প্রকাশিত হয়। মহেশখালীতেও খননকালে কৌটি টাকা মূল্যের পিলার পাওয়া গেছে বলে সংবাদ প্রকাশিত হয়।

যেহেতু প্রকাশিত পিলারের মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে, সেহেতু সেইসব পিলারগুলোয় মূল্যবান কোনো পদার্থ থাকতেই পারে। তবে সেসব নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তবেই বলা সম্ভব। উল্লেখ্য যে, সীমানা পিলার ও ম্যাগনেটিক পিলারের মধ্যে কিছু পার্থক্য আছে।

এমনিতে সীমানা পিলার সাধারণ ধাতব পদার্থের তৈরি হলেও ব্রিটিশ আমলের সীমানা পিলারগুলো বেশ কিছু মূল্যবান ধাতব পদার্থ দ্বারা তৈরি হয়েছিল।
কেউ কেউ মনে করেন ম্যাগনেটিক পিলারের মাধ্যমে বৃটিশরা দেশের সব গোপন তথ্য চুরি করে নিয়ে যেত!

ইন্ডিয়া বাংলাদেশ সিমান্ত এলাকাতে প্রাথমিকভাবে কিছু পিলার পাওয়ার কারনে একে সিমান্ত পিলার বলা শুরু হয়। আর এর মধ্যে থাকা তামা পিতল, টাইটেনিয়াম জাতীয় ধাতবের সমন্বয়ে তৈরী বিদ্যুৎ সুপরিবাহি হওয়াতে একে মহামুল্যবান বলে অপপ্রচারের ফলে এসব পিলার চুরি হতে থাকে।

✓ তাহলে আসল ঘটনা কি বজ্রপাত ?

এক.
বৃটিশদের শাসনামলে সীমানা পিলারগুলো ফ্রিকুয়েন্সি অনুযায়ী একটি থেকে আরেকটির দূরত্ব মেপে মাটির নীচে পুতে রাখা হয়েছিল।
যেগুলো পিতল,তামা,লোহা টাইটেনিয়াম সহ ধাতব চুম্বক সমন্বয়ে গঠিত ছিল।ধাতব চুম্বকত্ব দ্বারা গঠিত হওয়ার কারনে বজ্রপাত হওয়ার সময়ে যে ইলেকট্রিক
চার্জ তৈরি হয় সেটি সরাসরি এই পিলারগুলো শোষণ করে আর্থিং এর কাজ করতো বলে মনে করা হয়।
মানুষের বিশ্বাস এর ফলে বজ্রপাত হতো কিন্তু মানুষ মারা যেতো না।

কিছু অসাধু লোক গুজব ছড়ায় এই পিলারগুলোর অনেক দাম।এ কারণে দেশের বিভিন্ন সিমানা অঞ্চল থেকে পিলারগুলো নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। কিছু লোক এগুলোকে মহামুল্যবান বলে অপপ্রচার করে খুঁজে বের করে চুরি করে নিয়ে যায়।

বজ্রপাত থেকে বাঁচার জন্য এই প্রযুক্তির পিলারগুলো সারাদেশ জুড়ে একটি নির্দিষ্ট দুরত্ব পর পর ফ্রিকুয়েন্সি মেপে মেপে মাটির নিচে পুঁতে রাখা হয়েছিল !

অবশ্য আগেকার চেয়ে বর্তমানে বজ্রপাতে মানুষ নিহত হওয়ার সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে।যে কারনে মানুষ রীতিমতো চিন্তায় পড়ে গেছে। আর সে কারনে সবার ধারণা বৃটিশ আমলে এগুলো মাটির নিচে পুতে রাখা হয়েছিল !

বজ্রপাতে মৃত্যু রোধকল্পে সরকারকে বৃটিশদের মতো করে পিলার স্থাপনের উদ্যোগ আবার গ্রহণ করা উচিৎ বলেও অনেক বিশেষজ্ঞ মতামত দেন ।

দুই.
বজ্রপাত ও ম্যাগনেটিক পিলার নিয়ে যত ভুল ধারণা :

✓ ম্যাগনেটিক পিলারগুলো কিসের তৈরি?

লোহা,তামা,পিতল,টাইটানিয়াম ধাতব পদার্থগুলো বিভিন্ন অনুপাতে যুক্ত করে ছাঁচে ঢেলে তৈরি করা হয়েছে এই পিলারগুলো। এতে ধাতব ম্যাগনেট বা ধাতব চুম্বক মিশানোর বিষয়টি একটি মুখরোচক
গল্প মাত্র।
প্রাকৃতিক পরিবেশে, বিশেষ করে ইউরোপের বিভিন্ন খনিতে কালো রংয়ের একধরনের পাথর পাওয়া যায় যেগুলোতে চৌম্বকের কিছু গুণাবলি দেখা যায়। এই পাথরগুলোকে বলে লোডস্টোন (Lodestone) বা খনিজ চুম্বক বা প্রাকৃতিক চুম্বক। এগুলোর চৌম্বকত্ব খুবই দূর্বল এবং এই পাথরটি অন্যান্য ধাতব পদার্থের সাথে গলিয়ে ম্যাগনেটিক পিলার তৈরি করার বিষয়টি যুক্তিযুক্ত নয়।
হযরত ঈসা আঃ নবীর জন্মের প্রায় ৬০০ বছর পূর্বে গ্রীসের আনাতোলিয়া’র (বর্তমান তুরস্কের পশ্চিম অংশ) ম্যাগনেসিয়া (magnesia) নামক এলাকায় থ্যালেস অব মেলিতাস (Thales of Miletus) নামের একজন দার্শনিক প্রথম এর সন্ধান দেন বা আবিষ্কার করেন।

✓ ম্যাগনেটিক পিলার কি বজ্রপাতের সময় আর্থিং হিসেবে কাজ করে?

বজ্রপাতের সময় এই ধাতব দন্ড বা পিলারটি আর্থিং হিসেবে কাজ করতে কোন ভূমিকা রাখে না। কারণ এই পিলারগুলো মাটির কয়েক ফুট নিচে পোঁতা ছিল। (যদিও বৃটিশ আমলে এগুলোর মাথা দৃশ্যমান করে পোঁতা হয়েছিল )
এগুলো যদি আর্থিং হিসেবে কাজ করতো তাহলে এর আকারে এবং গঠনে পরিবর্তন আনতে হতো। যেমন: এগুলোকে আরো লম্বা করে মাটির অনেক গভীরে প্রবেশ করিয়ে ভেজা অংশে ঢুকানো হতো এবং সেটার সাথে কোন মোটা তার যুক্ত করে বিদ্যুতের খাম্বার মতো অনেক উচুঁতে উঠিয়ে রাখতে হতো। তাছাড়া তারটি অবশ্যই কম রেজিস্ট্যান্সের কোন ধাতব যেমন- খাঁটি তামা (Copper) দিয়ে তৈরি করতে হতো।

✓ ব্রিটিশরা এমন পিলার কেন স্থাপন করেছিল ?

সে সময় এই বাংলা অঞ্চলটি ছিল বৃটিশদের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অন্তর্গত এলাকা। তখন ছিল জমিদারি প্রথা এবং ভূমির খাজনা আদায় ছিল জমিদারদের অন্যতম প্রধান আয়ের উৎস।

তাই বৃটিশরা খাজনা আদায়, নিখুঁত ভূমি বন্টন, নিখুঁত সীমানা নির্ধারণ এবং ভূমি জরিপ ইত্যাদির সুবিধার্থে মৌজাগুলোর সীমানা এসব পিলার পুঁতে স্থায়ীভাবে নির্ধারণ করে দেয়।
যেহেতু এগুলো যুগযুগ ধরে মাটির নিচে থাকবে তাই এগুলোকে মরিচা রোধী করতে বিভিন্ন ধাতুর মিশ্রণে (এলয়) তৈরি করা হয়েছে।
এলয় ধাতু হওয়ায় এগুলোর গলনাংক অনেক বেশি। ফলে চুরি করে নিয়ে এগুলো দিয়ে অন্য কিছু বানানো তখনকার সময় সম্ভব ছিলনা।
বৃটিশরা এটাও ভেবেছিল যে, এগুলো মাটির অনেক গভীরে চলে গেলেও মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে এগুলোর অবস্থান সনাক্ত করা সম্ভব হবে।(এগুলোর নিজস্ব কোন ফ্রিকোয়েন্সী বলে কিছু নেই। ফ্রিকোয়েন্সী মেপে নির্দিষ্ট দূরত্ব পরপর এগুলো বসানোর বিষয়টি একেবারেই মিথ্যা এবং পিলারের সাথে ফ্রিকোয়েন্সীর বিষয়টি একেবারেই অসামঞ্জস্যপূর্ণ।)
আর প্রজাদের জমির অস্থায়ী সীমানাগুলোতে একজাতের বহুবর্ষজীবি ঘাস লাগিয়ে দিত।যাতে যুগযুগ ধরে পানি,বৃষ্টি,খরা সহ্য করে বেঁচে থাকতে পারে।
এই ঘাসগুলোকে ফুলঝাড়ু বা চেঙ্গামুড়া ঘাস বলে।

✓ তাহলে বজ্রপাত বেড়ে যাওয়ার কারণ কি?

বজ্রপাত বেড়ে যাওয়ার মূল কারণ সম্পূর্ণভাবে পরিবেশগত বিষয়।এতে ম্যাগনেটিক পিলার থাকা
বা না থাকায় মানুষের কোন হাত নেই। জলবায়ুর পরিবর্তন, বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ইত্যাদি কারণে
গত দুই দশক ধরে পৃথিবী জুড়ে ক্রমেই বজ্রপাতের পরিমাণ বাড়ছে।

নাসা’র (NASA) হিসাব মতে পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত হয় উগান্ডার লেক ভিক্টোরিয়া এলাকায়,গড়ে বছরের ২৪২ দিনই সেখানে বজ্রপাত হয়।

ভেনিজুয়েলার লেক মারাকেইবো (Lake Maracaibo) এলাকায় প্রতি ১ বর্গ কিঃমিঃ এলাকায় বছরে গড়ে ২৩৩ বার বজ্রপাত হয়। তবে সংখ্যার হিসেবে সবচেয়ে বেশি এবং ভয়াবহ বজ্রপাত হয় আফ্রিকার দেশ ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো’তে। (শুধু কঙ্গো আলাদা আরেকটি দেশ)

পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বজ্রপাতপ্রবণ ১০ টি শহরের মধ্যে ৫ টি শহরই ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো’র। বাকি পাঁচটি শহরের মধ্যে ২ টি কলম্বিয়া’র, একটি পাকিস্তানের, ১ টি ভেনিজুয়েলা’র এবং ১ টি ক্যামেরুনের শহর।

তালিকার ১০০ শহরের মধ্যেও বাংলাদেশের কোন শহরের নাম নেই।

বজ্রপাতের ঘটনাগুলো নাসা’র আবহাওয়া বিষয়ক স্যাটেলাইট (Meteorologycal Satellite) দ্বারা সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ করা হয় এবং রেকর্ড রাখা হয়।

✓ বজ্রপাতে এখন বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে কেন?

গত এক দশকে বজ্রপাতের কারণে বাংলাদেশে মানুষের মৃত্যু বেশি হওয়ার বেশ কয়েকটি কারণ
হতে পারে। তারমধ্যে প্রধানতম কয়েকটি হলো-

ক) দেশ জুড়ে বহুবর্ষজীবি উঁচু গাছের পরিমাণ ব্যাপক ভাবে কমে যাওয়া,যেমন: তাল, নারিকেল দেবদারু ইত্যাদি গাছ কমে গেছে। আগে গ্রামাঞ্চলে বসতবাড়িতে, পুকুরের আইল, সড়কের পাশে এবং বিলেও প্রচুর তালগাছ এবং উঁচু দেবদারু গাছ দেখা যেত।
যেগুলো বজ্রপাতের সময় ‘লাইটনিং এ্যারেস্টার’ এর মতো কাজ করতো। অর্থাৎ উঁচু গাছগুলো বজ্রপাতকে “আকর্ষণ” করে মাটির অভ্যন্তরে পাঠিয়ে দিতো (এখনো দেয়)।
বাংলাদেশ সরকার সেজন্য ইতিমধ্যে তালগাছ লাগানোর উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন।

খ) জনসংখ্যা বা মানুষ বেড়েছে কয়েকগুণ। প্রতি বর্গ কিলোমিটারে মানুষের ঘনত্বও বেড়েছে অর্থাৎ পুরো দেশ ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা হয়েছে। সুতরাং যেখানেই বজ্রপাত হোক, স্বাভাবিকভাবেই জানমালের ক্ষয়ক্ষতি কিছুটা হবেই।

গ) এখন নিমিষেই মৃত্যুর খবর দ্রুত জানা যাচ্ছে,ফলে মনে হয় যেন বজ্রপাতে মানুষের মৃত্যুহার বেড়েছে। তুলনামূলক কম হলেও ৩০-৪০ বছর আগেও অনেক মানুষ মারা যেত যেগুলোর ৯৯% ই সংবাদ মাধ্যমে আসতো না। এমনকি দুই তিন কিলোমিটার দূরের গ্রামে কেউ বজ্রপাতে মারা গেলেও খবর পাওয়া যেত তিন চার দিন পর। আর অনেক দূরে হলে তো কোনো খবরই পাওয়া যেত না।

 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *