মাচু পিচু : ইনকাদের হারানো শহর। ধারণার চেয়েও প্রাচীন।সময়টা খ্রিস্টপূর্ব ১৪২০ সাল।
লিখেছেনঃ
#প্রভাষক_একাব্বর_রসায়নবিজ্ঞান
✓ বর্তমান বিশ্বের সাতটি নতুন বিস্ময়ের একটি।
✓ ইন্তিউয়াতানা পাথর : এই পাথরে তারা কপাল ঘসে
আধ্যাত্মিক জগৎ দেখতে পেত।
✓ইন্তিউয়াতানা পাথর :২১শে মার্চ ও ২১শে সেপ্টেম্বর, বছরে এই দুবার দিনের মাঝামাঝি সময়ে সূর্য ইন্তিউয়াতানা পাথরের একেবারে ওপরে থাকে।
ফলে এর কোনও ছায়া তৈরি হয় না। প্রকৃতপক্ষে ইন্তিউয়াতানা একটি “মহাকাশ ঘড়ি”।
✓ মাচুপিচুকে খ্রিষ্টপূর্ব ১৪৩৮ সালের নিদর্শন বলে ঘোষণা করেছিলেন ঐতিহাসিকেরা।
সম্প্রতি গবেষকরা বলছেন, সময়টা আরও অন্তত দু’দশক পিছিয়ে যাবে। সময়টা খ্রিস্টপূর্ব ১৪২০ সাল।
মাচু পিকচু ( Machu Pikchu অর্থাৎ “পুরানো চূড়া”) কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের আগের সময়কার একটি ইনকা শহর, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে যার উচ্চতা ২৪০০ মিটার (৭,৮৭৫ ফিট)। এটি পেরুর উরুবাম্বা উপত্যকার ওপরে একটি পর্বতচূড়ায় অবস্থিত।
মাচু পিচুই সম্ভবতঃ ইনকা সভ্যতার সবচেয়ে পরিচিত নিদর্শণ, যাকে প্রায়শঃ ইনকাদের হারানো শহর বলা হয়। এটি ১৪৫০ সালের দিকে নির্মিত হয়, কিন্তু এর এক শ বছর পর ইনকা সভ্যতা যখন স্পেন দ্বারা আক্রান্ত হয় তখন এটি পরিত্যাক্ত হয়ে পড়ে। কয়েক শ বছর অজ্ঞাত থাকার পর ১৯১১ সালে হাইরাম বিঙাম ( Hiram Bingham) নামে এক মার্কিন ঐতিহাসিক এটিকে আবার সমগ্র বিশ্বের নজরে নিয়ে আসেন।
তারপর থেকে মাচু পিচু পর্যটকদের কাছে একটি আকর্ষণী দর্শনীয় স্থান হয়ে উঠেছে। এটিকে ১৯৮১ সালে পেরুর সংরক্ষিত ঐতিহাসিক এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং ইউনেস্কো ১৯৮৩ সালে এটিকে তাদের বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে। এটি বর্তমান বিশ্বের সাতটি নতুন বিস্ময়েরও একটি।
মাচু পিচু ঐতিহ্যবাহী ইনকা বাস্তুকলার এক অনুপম নিদর্শণ। পালিশ করা পাথর দ্বারা নির্মিত এই শহরের প্রধান স্থাপনাগুলো হচ্ছে ইন্তিউয়াতানা,সূর্য মন্দির ও তিন জানালা ঘর ইত্যাদি।
ধারণা করা হয় ইন্তিউয়াতানা ইনকাদের নির্মিত একটি মহাকাশ ঘড়ি।পুরাকীর্তিবিদদের কাছে মাচু পিচুর পবিত্র অঞ্চল হিসেবে পরিচিত অংশে এ স্থাপনাগুলো অবস্থিত।বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে হাইরাম বিঙাম মাচু পিচু থেকে যে সব পুরাকীর্তি নিয়ে গিয়েছিলেন সেসব ফেরত দেবার জন্য ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পেরু সরকার ও ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় এর মধ্যে এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। বর্তমানে অতিরিক্ত পর্যটক সমাগমের ফলে এই প্রাচীন শহরের অস্তিত্ব নিয়ে অনেকেই সংশয় প্রকাশ করেছেন।
উল্লেখ্য, ২০০৩ সালে এখানে আগত পর্যটকের সংখ্যা ৪০০,০০০ ছাড়িয়ে যায়।
এটি এখন নতুন সপ্তম বিস্ময়।
ইনকা সভ্যতার স্বর্ণযুগে ১৪৫০ সালের দিকে মাচু পিচু নির্মিত হয়। কিন্তু তার ১০০ বছরেরও কম সময়ের মধ্যে এটি পরিত্যাক্ত হয়ে পড়ে।
সম্ভবতঃ স্পেনীয় অভিযাত্রীদের আগমনের আগেই এই শহরের অধিকাংশ অধিবাসী গুটিবসন্তে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছিল। মাচু পিচুর সন্ধানকারী হাইরাম বিঙাম এবং আরও অনেকেরই মতে এই সুরক্ষিত শহরটি ইনকাদের ঐতিহ্যগত জন্মস্থান অথবা সূর্য কুমারীদের পবিত্র কেন্দ্র ছিল।
আবার কেউ কেউ মনে করেন এটি একটি জেলখানা হিসাবে ভয়ংকর অপরাধীদের রাখার জন্য নির্মিত হয়েছিল। অন্যদিকে জন রো ও রিচার্ড বার্গারসহ আরও অনেকের গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, মাচু পিচু কোনও প্রতিরক্ষামূলক আশ্রয়স্থল নয়, বরং এটি ইনকা সম্রাট পাচাকুতিকেরএকটি অবকাশযাপন কেন্দ্র। বেশির ভাগ পুরাতত্ত্ববিদই এই মতবাদকে সমর্থন করেছে।
১৯১১ সালের ২৪শে জুলাই মার্কিন ঐতিহাসিক ও ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রভাষক হাইরাম বিঙাম মাচু পিচুর নাম দেন ইনকাদের হারানো শহর এবং তার প্রথম বইটিও এই শিরোনামে প্রকাশিত হয়।
কিছু পরিবার ১৯১১ সালে শহরটি আবিষ্কারের সময় পর্যন্ত সেখানে বসবাস করত, যদিও নগরীর আদি বাসিন্দাদের অধিকাংশই শহর তৈরির এক শ বছরের ভেতর মারা যায়।সে সময় মাচু পিচুতে কিছু মমি (বিশেষতঃ মহিলাদের) পাওয়া যায়।
১৯১৩ সালে জাতীয় ভৌগোলিক সংস্থা তথা ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটি তাদের এপ্রিল মাসের পুরো সংখ্যাটি মাচু পিচুর ওপর প্রকাশ করলে শহরটি ব্যাপক প্রচারণা পায়। মাচু পিচুর আশপাশের ৩২৫.৯২ বর্গ কিলোমিটার এলাকাকে ১৯৮১ সালে পেরুর “সংরক্ষিত ঐতিহাসিক এলাকা” হিসেবে ঘোষণা করা হয়। শহরের ধ্বংসাবশেষ ছাড়াও এই এলাকায় অন্তর্ভুক্ত অঞ্চল উদ্ভিদ ও জীব বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ।
মাচু পিচুকে ১৯৮৩ সালে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এ ঘোষণায় মাচু পিচুকে বর্ণনা করা হয়েছে ধ্রুপদী বাস্তুকলার নিদর্শন ও ইনকা সভ্যতার অনন্য স্বাক্ষর হিসেবে। ২০০৭ সালের ৭ই জুলাই New Open World Corporation কর্তৃক আয়োজিত প্রতিযোগিতায় মাচু পিচু বিশ্বের সাতটি নতুন বিস্ময়ের একটি নির্বাচিত হয়।
নির্মাণ কৌশলে ইনকারা খুবই দক্ষ ছিল। ইনকারা পাথরের নির্মাণ পদ্ধতিতে পৃথিবীর সেরাদের সেরা ছিল। তাদের নির্মিত পাথরের দেয়ালগুলোর জোড় এতই নিপুঁন যে, একটা পাতলা ছুরির ফলাও সেগুলোর ভেতর দিয়ে প্রবেশ করানো যায় না।
শহরটিতে ১৪০ টি স্থাপনার মধ্যে রয়েছে কিছু মন্দির, পবিত্র স্থান, উদ্যান এবং আবাসিক ভবনসমূহ (আবাসিক ভবনগুলো খড়ের ছাউনি দেয়া ছিল)।
মাচু পিচুতে রয়েছে ১০০টিরও বেশি সিড়ি যার মধ্যে কিছু কিছু একটি মাত্র গ্রানাইট পাথরের খণ্ড কুদে তৈরি করা হয়েছে। এখানে আরও রয়েছে প্রচুর সংখ্যক ঝরনা, যেগুলো পাথর কেটে তৈরি করা ছোট ছোট খালের মাধ্যমে পরস্পর সংযুক্ত এবং এসব মূলতঃ সেচ কাজে ব্যবহারের জন্য তৈরি করা হয়েছিল। প্রমাণ পাওয়া গেছে যে, এই সেচ ব্যবস্থা ব্যবহার করে একটি পবিত্র ঝরনা থেকে পানি প্রতিটি বাড়িতে সঞ্চালনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
✓ মাচু পিচুর ইনকা দেয়াল।
প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে, মাচু পিচুর শহর ব্যবস্থা তিনটি বড় বিভাগে বিভক্ত ছিল।
এগুলো হল :
• পবিত্র এলাকা।
• জনসাধারণের এলাকা।
এ দুটি শহরের দক্ষিণে অবস্থিত। এবং
• পুরোহিত ও অভিজাত শ্রেনীর এলাকা।
পবিত্র এলাকায় মাচু পিচুর প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদগুলো অবস্থিত, যেমন: ইন্তিউয়াতানা পাথর, সূর্য মন্দির এবং তিন জানালা ঘর। এসব স্থাপনা উৎসর্গ করা হয়েছিল ইন্তি, তাদের সূর্য দেবতা এবং মহান দেবতার প্রতি। জনসাধারণের এলাকার স্থাপনা গুলোর মধ্যে রয়েছে গুদামঘর এবং বসত বাড়ি।
অভিজাত এলাকায় সম্ভ্রান্ত শ্রেনীর থাকার জন্য একটি অংশ ছিল। এ অংশের বাড়িগুলো একটি ঢালের ওপর কয়েক সারিতে অবস্থিত। হামাউতা বা বিচক্ষণ ব্যক্তিদের দেয়াল কিছুটা লালচে রঙের। অন্যদিকে নিউস্তা বা রাজকুমারীদের অংশের ঘরগুলো অসম আয়তাকার। স্মৃতিসৌধ একটি খোদাইকৃত ভাস্কর্য, যার ভেতর একটি নকশাকৃত কক্ষ রয়েছে। এটি যজ্ঞ এবং উৎসর্গের কাজে ব্যবহার করা হত।
সড়ক ব্যবস্থার অংশ হিসাবে ইনকারা মাচু পিচু পর্যন্ত একটি রাস্তা তৈরি করেছিল। বর্তমানে হাজার হাজার পর্যটক ইনকাদের পথে পায়ে হেঁটে মাচু পিচু ভ্রমণ করে। তবে এর জন্য আগে কোস্কোতে যাত্রাবিরতি করে স্থানীয় আবহাওয়ার সাথে মানিয়ে নিয়ে তারপর উরুবাম্বা উপত্যকা হয়ে আন্দেস পর্বতমালার ওপর দিয়ে দুই থেকে চার দিনের এই পদযাত্রায় বের হতে হয়।
✓ ইন্তিউয়াতানা পাথর ।
স্থানীয় উপাখ্যান অনুসারে কোনও অনুভূতি সম্পন্ন মানুষ যদি এই পাথরে তার কপাল ঘসে তাহলে আধ্যাত্মিক জগৎ দেখতে পাবে। ইন্তিউয়াতানা পাথর দক্ষিণ আমেরিকার পূজিত পবিত্র পাথরগুলোর একটি। স্পেনীয়রা ২০ শতকের আগে এই পাথরটি খুঁজে পায়নি; ফলে এটি ইনকাদের অন্যান্য পবিত্র পাথরের মতো ধ্বংস হবার হাত থেকে বেঁচে যায়।
এই পাথরগুলো এমন ভাবে স্থাপন করা হয় যাতে শীতকালে এগুলো সরাসরি সূর্যের দিকে নির্দেশ করে। একে “সূর্যের আকঁড়া বিন্দুও” বলা হয়, কেননা উপকথা অনুসারে এটি সূর্যকে তার জায়গায় আটকে রাখার উদ্দেশ্যে নির্মিত।
২১শে মার্চ ও ২১শে সেপ্টেম্বর, বছরে এই দুবার দিনের মাঝামাঝি সময়ে সূর্য ইন্তিউয়াতানা পাথরের একেবারে ওপরে থাকে; ফলে এর কোনও ছায়া তৈরি হয় না। প্রকৃতপক্ষে ইন্তিউয়াতানা একটি “মহাকাশ ঘড়ি”।
এটি ২০০০ সাল পর্যন্ত অক্ষত অবস্থায় ছিল। সেই বছর একটি মদ কোম্পানির বিজ্ঞাপন নির্মাণের সময় ৯৯০ পাউন্ড ওজনের একটি ক্রেন এই পাথরের ওপর পড়ে গেলে কলমের আকারের একটুকরা ভেঙে যায়। কোম্পানিটির দাবী তারা এই ঘটনার জন্য দায়ী নয়। অনেক মানুষ মনে করে এই ঘটনার পর আত্মারা ইন্তিউয়াতানা ছেড়ে চলে গেছে।
✓ মাচুপিচু ধারণার চেয়েও প্রাচীন।
দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের পেরুর অন্তর্গত একটি প্রাচীন নগরী মাচুপিচু। যা দক্ষিণ আমেরিকার ইনকা সভ্যতার একটি উল্লেখযোগ্য শহর ছিল। এখন শুধুই ইনকা সভ্যতার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির বিচারে একটি পর্যটনকেন্দ্র মাত্র। পেরুর রাজধানী লিমা থেকে ৩৫৭ মাইল দক্ষিণ-পূর্বে ইনকাদের প্রাচীন এই রাজধানী কুচকো অবস্থিত। এই কুচকো থেকে ৫০ মাইল উত্তর-পশ্চিমে দুটি উচ্চ পর্বতশৃঙ্গের মধ্যবর্তী উচ্চ উপত্যাকায় এই শহরটি তৈরি করা হয়েছিলো।
সম্প্রতি রেডিওকার্বন প্রযুক্তি ব্যবহার করে একদল বিজ্ঞানী জানান, প্রাচীন এই নিদর্শনটি আরও অন্তত দুই দশকের পুরোনো।
গবেষক দলের প্রধান ও ইয়েল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক রিচার্ড বার্গার জানান, ইনকা সাম্রাজ্য নিয়ে স্প্যানিশ ঔপনিবেশিক আমলে করা তথ্য-উপাত্ত পুনরায় খতিয়ে দেখতে হবে।
তিনি আরও জানান, আধুনিক রেডিওকার্বন প্রযুক্তির সহায়তায় ইনকা সভ্যতার নিদর্শন নিয়ে নতুন কিছু তথ্য পেয়েছেন তারা। যার সঙ্গে ঐতিহাসিকদের তথ্যের কোনো মিল নেই। ঔপনিবেশিক শাসনামলে নথিভুক্ত তথ্যনির্ভর, প্রাথমিক এবং এসব রেকর্ড এখন সংশোধন আমাদের করা প্রয়োজন।
দীর্ঘদিন ধরে ইনকা সভ্যতার প্রাচীন নিদর্শন মাচুপিচুকে খ্রিষ্টপূর্ব ১৪৩৮ সালের নিদর্শন বলে ঘোষণা করেছিলেন ঐতিহাসিকেরা। ষোড়শ শতাব্দীতে স্প্যানিশরা এ অঞ্চল দখল করার ওপর ভিত্তি করে তারা এই অনুমান করেছিলেন।
তবে এখন গবেষকেরা বলছেন, সময়টা আরও অন্তত দু’দশক পিছিয়ে যাবে। সময়টা খ্রিস্টপূর্ব ১৪২০ সাল।
রাজা Pachacuti এই Machu Picchu সভ্যতার প্রতিষ্ঠাতা। প্রি-কলুম্বিয়ান আমেরিকায় ইনকা সভ্যতাই (Inca Empire) সবচেয়ে প্রাচীন এবং প্রভাবশালী বলে খ্যাত ছিল।
তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া,সিএনএন,ইত্তেফাক।
ZEENEWS .