Mayuri Mitra

তিন পাহাড়  –  ড. ময়ূরী মিত্র

উঁহু ! তিন পাহাড়ে পরস্পরে কোনো মিল নেই | না ধাপের আঁক কষায় না পাহাড় থেকে নদী দেখায় | পাঠক মিল পেলে ভালো | না পেলে  বলি –বেশ তো হে ! তাও ভালো !
এক :
সেবার — ব্রিজের ওপর দুপুর | চাকা চাকা  রোদ্দুর | বেশ ম্যাচ করে গেছে আমার কটকটে হলুদ শাড়িতে  |  বাস থেকে দেখলাম একটি সবুজ গাছে ভরা ভাঙা বাড়ি | বেশ কবছর ধরে বাড়িটা ভাঙার নোটিশ ঝুলছিল  | ভাঙা পড়েছে তাও দেখেছি যাতায়াতের পথে | জানি না শুধু ভাঙার পরও ভাঙা অংশটার  সবুজে ভরে ওঠার গল্পটাকে |
                ছাদ  ভাঙা হয়ে  গিয়েছে  | ঘরগুলোর দেয়াল ক্ষয়ে আসছে  | তবু সে  দেয়ালে ছেয়ে যাচ্ছে  অটুট সবুজ | বর্ষা নেই | তাও এত লতাগুল্ম  !  প্রতি ঘরের দেয়ালকে এমন আপনজনের মত  ঘিরেছে , মনে হচ্ছে এরা সব একটি  একটি গাছঘর | ওপরে রাংতার মত চকচকে আকাশ | কী সুন্দর ! কী সুন্দর !
                 ভাবলাম নামি | কে আর দেখবে ? ঢুকি  সবুজের ঘর – দুয়ারে ! সেখানে  হয়ত দাঁড়িয়ে  বেরং এক পুরুষ | ভয় হল | নাহ ! আমিই  বড় বেমানান | যান চলল গন্তব্যে  | থাক  শ্যামল ছায়ায় সে |
       ছুটল কাল | কালক্ষয় হল |
                এবার  —–সল্টলেক | সুন্দর বাগানে সাজানো বাড়ি | সম্ভ্রান্ত গৃহস্থ | পরিচয় আছে | জানি গাছ খুব ভালোবাসেন | মাঠের মাঝে শপিং মল গজালে খুব রাগ করেন | নাহ —তাঁর এই গাছ ভালোবাসায় কোনো কপটতা নেই | কিংবা আমিই  জানিনি বৃক্ষপ্রেমীর মন মাঝারের  ক্ষেতটুকু কতটা সত্য ছিল !
        দেখলাম — তাঁর মালি একটি বড় সবুজ দেবদারু গাছের মাথা ছাঁটছে | কেশবতী কিশোরীর একলা বৈধব্যের মত দেখাচ্ছে অনেক সবুজের মাঝে ক্রমশ ছোট হতে থাকা সবুজ গাছ | বললাম — কাটছ কেন ? পাতাগুলো ছিঁড়ছ কেন খামোখা ? মালী বললে —-বেশি পাতা হয়ে ঝাঁকড়া হয়ে গেছে গাছটা ! কেটে সুন্দর করে দিচ্ছি |
              মালিক | মুখে চিত্রকরের বুঝদার হাসি —”  গাছ খানিক বাড়ালেই হবে ? দেখতে সুন্দর লাগবে –মানুষের চোখ আরাম পাবে —সেটুকু গাছই রাখতে হয় বাগানে !”
           ওহ !  ভ্যানগখ ! তুমি এক সূর্যমুখীর কেশর ছড়িয়ে  সারা মাঠটাকে করে ফেল লক্ষ সূর্যের মাঠ |একালের চিন্তাশীল ভাইরাসের  রেগুলার খাদ্য হয়েও গাছ গেলেন | গপাগপ করে খান গাছ , গাছের পাতা , ডালপালা | একেবারে শেকড় অব্দি | গলগল ঢেউ দিয়ে মানুষের পেট বেয়ে নামে  সবুজের ধারা  | বোধহয় খাদক হয়ে ওঠার শেষ অহমিকায় | বা অতিমারীর  খাদ্য হয়ে ওঠার  লজ্জা ঢাকতে | তাই বুঝি নিজের পছন্দে গাছের হাত মটকে  সে সুন্দর করে  নিজ আবাস !
                 সুন্দর –তাও সে কেবল আমার ?  নির্ধারণ আমার !  রক্ষণ আমার ! শেষ করাও আমার ?
           না বাবা ! আমি থাকি গাধি হয়ে | প্রাণপণ  জড়িয়ে রাখি অঙ্কহীন  বিশালকে !  —-   হঠাৎ লম্বা হওয়া জঙ্গল এক সে   | ও সেই  আমার মাথাভর্তি চুলওয়ালা  BABY রে !
দুই :
বড় হতচ্ছাড়া আমি | সবাই  দেখে  পূর্ণচাঁদের   সমুদ্র — যে সমুদ্র লাফায় প্রখর জোছনায় | আর আমি মেঘলা দিনের সমুদ্র –আকাশের  ছায়া কাঁপে যে সাগরে | লক্ষ্য করেছি বারেবারে , মেঘা দিনে  সমুদ্রের ঢেউয়ে  কেমন পায়রার পাখার রঙ ধরে ! কী  যে ভালো লাগে !
        বেছে বেছে বর্ষা দেখেই একবার গিয়েছিলাম পুরীতে |  শহরের থেকে একটু দূরে থাকার জায়গা | সমুদ্রের তীরটা ফাঁকা ফাঁকাই থাকত | শূন্যকূলেই  দেখা পেয়েছিলাম যুগলের  | উৎকলী বর আর বৌ | বর বৌ দুজনেরই তখন অনেক বয়স | জিজ্ঞেস করে জানলাম  বরটি পুরী মন্দিরের  পান্ডা | মহিলাটি কিন্তু কিছুতেই আমার সাথে সহজ হতে পারলেন না | কেবলই এড়িয়ে গেলেন  | যত এড়াতে লাগলেন  ততই পুরুষটি অপ্রস্তুত চোখে হাসতে লাগতে লাগলেন মহিলার দিকে তাকিয়ে | অপ্রস্তুত কিন্তু মায়ায় কাদা হয়ে যাওয়া  চোখ |
              গা ভর্তি ভারী  সোনার গয়না,উজ্জ্বল  জরিশাড়িতে  শরীর জড়ানো বুড়ি বউ   ম ম কর্পূরের গন্ধে  আমার সামনে   গুটিসুটি মেরে যাচ্ছিলেন কেমন  |  অস্বস্তি হতে লাগল | হঠাৎই  মনে হল আমার —এঁরা স্বামী স্ত্রী নন |  আসেনও দুজনে দুজায়গা থেকে | কিন্তু আসা চাইই |
            সেবার  প্রতিদিনই কমবেশি বৃষ্টি নামছে সমুদ্রে | তাও যে কদিন ছিলাম একদিনও কামাই দেখিনি  |  বরের আলাপে জানলাম , রক্তে শর্করা বেড়ে গেছে বউয়ের |  ডাক্তার হাঁটতে বলেছে নিয়মিত | বউ  কিছুতে হাঁটতে চান না আর বর  হাঁটাবেনই | কী  নিবিড় আদরে যে না হওয়া বর তাঁর  না হওয়া বৌয়ের মোটা  আঙুলগুলোকে   জড়িয়ে নিতেন  ! ঢুকিয়ে নিতেন একদম মুঠি করে |
     চলে আসার দিন আকাশ জুড়ে মেঘ  | মেঘের নীচে সাগরে ঝাপটায়   লাখ  পায়রা  |  ফেনায়  লুটোয় পালক  | তীর ধরে ছাতা মাথায় হাঁটছে   বর বৌ |  সেদিন হাঁটবে না বলে পণ করেছে বুড়ি বৌ |  একহাতে ছাতা সামলাতে সামলাতে তাকে বইছে বুড়ো বর |  এ দৃশ্যে কোনো মহান কিছু আবিষ্কার করিনি  | কিন্তু আজো আকাশে  যখন  মেঘ উপচোয়  পায়রাসাগর দুমদাম  আসে আমার সমুখে |   কিনারায় দু  পুতুল | সুখ  আর দুখ  | জীবন হয় না বিমুখ |
তিন :
আমি মহান নই | সে সাধ্যি কৈ আমার | সাধ আছে কেবল চলার পথে ছোট ছোট ভালোগুলোকে খুঁজে বেড়াবার | আর  তারপর সেই খুঁজে পাওয়া ভালো মানুষ আর ভালো ঘটনাকে স্তূপ করে একটি ভালোপাহাড় বানাবার |
                     দুপুর  রোদে  হনহনিয়ে যাচ্ছিলাম সল্টলেকে মায়ের বাড়ি | পথের ওপর একটি সদ্য তৈরি হওয়া প্রাসাদ | বাড়িটির সারা গায়ে গণেশ হনুমানের মূর্তি দেখে নাক মুখ কুঁচকে পালাচ্ছিল ঘোর নাস্তিক ময়ূরী | ঈশ্বর খোঁজার আগ্রহটুকুও  যার তৈরি হয়নি | হঠাৎ দেখলাম নীচে একটি বিরাট পরিষ্কার জালা | পাশে সেই বাড়ির মারওয়ারী মালিক |  এই অব্দি চেনা দেখা দৃশ্য আমাদের | অবাক হলাম —যখন দেখলাম একই  জালার জল তিনি হাঁকডাক করে বিলিয়ে চলেছেন ভদ্র অভদ্র সবাইকে | ভদ্র অভদ্র মতে মানে আমাদের চালিত মতে | দুচারটে মুসলিম মিস্ত্রীকেও দেখলাম বেশ যত্ন করে জল খাওয়াচ্ছেন ভদ্রলোক |
      খচরামো করব বলেই জিজ্ঞাসা করলাম —কে শেখালে আপনাকে এসব ?
–কী সব ?
—-এই যে আপনার এই কায়দা মেরে  অসাম্প্রদায়িক থাকার  চেষ্টা !
 —–বোন আমার  চেষ্টা কেবল তোমাদের সবাইকে এই গরমের দুপুরে পেটপুরে জল খাওয়ানো | শিখিয়েছেন আমার ঈশ্বর |
              এতো সাবলীল উত্তর শুনে ঝোঁক চাপল ভদ্রলোককে  আরো অপ্রস্তুত করার | পাপীর পুন্যদৃশ্য অস্বীকার করার ইচ্ছে | বললাম —
—রাতে তো দোকানের গদিতে গিয়ে আটায় ভুষি মেলাবেন |
—- মিলাব তো | ওউ ভি  করি | এও করি |  জল খেয়ে ঠান্ডা হলে তো তোমরা  কজন মানুষ !
আমার ভালোপাহাড়ে পাথর পড়লো আরো একটা | আমার একখন্ড রত্নপাথর |
  পাহাড় গড়া শেষ হয়নি |
   পাহাড় শেষ হয় না |
    পাথর দেয়াটা বাকি রয়ে যায় |

 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *