উঁহু ! তিন পাহাড়ে পরস্পরে কোনো মিল নেই | না ধাপের আঁক কষায় না পাহাড় থেকে নদী দেখায় | পাঠক মিল পেলে ভালো | না পেলে বলি –বেশ তো হে ! তাও ভালো !
সেবার — ব্রিজের ওপর দুপুর | চাকা চাকা রোদ্দুর | বেশ ম্যাচ করে গেছে আমার কটকটে হলুদ শাড়িতে | বাস থেকে দেখলাম একটি সবুজ গাছে ভরা ভাঙা বাড়ি | বেশ কবছর ধরে বাড়িটা ভাঙার নোটিশ ঝুলছিল | ভাঙা পড়েছে তাও দেখেছি যাতায়াতের পথে | জানি না শুধু ভাঙার পরও ভাঙা অংশটার সবুজে ভরে ওঠার গল্পটাকে |
ছাদ ভাঙা হয়ে গিয়েছে | ঘরগুলোর দেয়াল ক্ষয়ে আসছে | তবু সে দেয়ালে ছেয়ে যাচ্ছে অটুট সবুজ | বর্ষা নেই | তাও এত লতাগুল্ম ! প্রতি ঘরের দেয়ালকে এমন আপনজনের মত ঘিরেছে , মনে হচ্ছে এরা সব একটি একটি গাছঘর | ওপরে রাংতার মত চকচকে আকাশ | কী সুন্দর ! কী সুন্দর !
ভাবলাম নামি | কে আর দেখবে ? ঢুকি সবুজের ঘর – দুয়ারে ! সেখানে হয়ত দাঁড়িয়ে বেরং এক পুরুষ | ভয় হল | নাহ ! আমিই বড় বেমানান | যান চলল গন্তব্যে | থাক শ্যামল ছায়ায় সে |
ছুটল কাল | কালক্ষয় হল |
এবার —–সল্টলেক | সুন্দর বাগানে সাজানো বাড়ি | সম্ভ্রান্ত গৃহস্থ | পরিচয় আছে | জানি গাছ খুব ভালোবাসেন | মাঠের মাঝে শপিং মল গজালে খুব রাগ করেন | নাহ —তাঁর এই গাছ ভালোবাসায় কোনো কপটতা নেই | কিংবা আমিই জানিনি বৃক্ষপ্রেমীর মন মাঝারের ক্ষেতটুকু কতটা সত্য ছিল !
দেখলাম — তাঁর মালি একটি বড় সবুজ দেবদারু গাছের মাথা ছাঁটছে | কেশবতী কিশোরীর একলা বৈধব্যের মত দেখাচ্ছে অনেক সবুজের মাঝে ক্রমশ ছোট হতে থাকা সবুজ গাছ | বললাম — কাটছ কেন ? পাতাগুলো ছিঁড়ছ কেন খামোখা ? মালী বললে —-বেশি পাতা হয়ে ঝাঁকড়া হয়ে গেছে গাছটা ! কেটে সুন্দর করে দিচ্ছি |
মালিক | মুখে চিত্রকরের বুঝদার হাসি —” গাছ খানিক বাড়ালেই হবে ? দেখতে সুন্দর লাগবে –মানুষের চোখ আরাম পাবে —সেটুকু গাছই রাখতে হয় বাগানে !”
ওহ ! ভ্যানগখ ! তুমি এক সূর্যমুখীর কেশর ছড়িয়ে সারা মাঠটাকে করে ফেল লক্ষ সূর্যের মাঠ |একালের চিন্তাশীল ভাইরাসের রেগুলার খাদ্য হয়েও গাছ গেলেন | গপাগপ করে খান গাছ , গাছের পাতা , ডালপালা | একেবারে শেকড় অব্দি | গলগল ঢেউ দিয়ে মানুষের পেট বেয়ে নামে সবুজের ধারা | বোধহয় খাদক হয়ে ওঠার শেষ অহমিকায় | বা অতিমারীর খাদ্য হয়ে ওঠার লজ্জা ঢাকতে | তাই বুঝি নিজের পছন্দে গাছের হাত মটকে সে সুন্দর করে নিজ আবাস !
সুন্দর –তাও সে কেবল আমার ? নির্ধারণ আমার ! রক্ষণ আমার ! শেষ করাও আমার ?
না বাবা ! আমি থাকি গাধি হয়ে | প্রাণপণ জড়িয়ে রাখি অঙ্কহীন বিশালকে ! —- হঠাৎ লম্বা হওয়া জঙ্গল এক সে | ও সেই আমার মাথাভর্তি চুলওয়ালা BABY রে !
দুই :
বড় হতচ্ছাড়া আমি | সবাই দেখে পূর্ণচাঁদের সমুদ্র — যে সমুদ্র লাফায় প্রখর জোছনায় | আর আমি মেঘলা দিনের সমুদ্র –আকাশের ছায়া কাঁপে যে সাগরে | লক্ষ্য করেছি বারেবারে , মেঘা দিনে সমুদ্রের ঢেউয়ে কেমন পায়রার পাখার রঙ ধরে ! কী যে ভালো লাগে !
বেছে বেছে বর্ষা দেখেই একবার গিয়েছিলাম পুরীতে | শহরের থেকে একটু দূরে থাকার জায়গা | সমুদ্রের তীরটা ফাঁকা ফাঁকাই থাকত | শূন্যকূলেই দেখা পেয়েছিলাম যুগলের | উৎকলী বর আর বৌ | বর বৌ দুজনেরই তখন অনেক বয়স | জিজ্ঞেস করে জানলাম বরটি পুরী মন্দিরের পান্ডা | মহিলাটি কিন্তু কিছুতেই আমার সাথে সহজ হতে পারলেন না | কেবলই এড়িয়ে গেলেন | যত এড়াতে লাগলেন ততই পুরুষটি অপ্রস্তুত চোখে হাসতে লাগতে লাগলেন মহিলার দিকে তাকিয়ে | অপ্রস্তুত কিন্তু মায়ায় কাদা হয়ে যাওয়া চোখ |
গা ভর্তি ভারী সোনার গয়না,উজ্জ্বল জরিশাড়িতে শরীর জড়ানো বুড়ি বউ ম ম কর্পূরের গন্ধে আমার সামনে গুটিসুটি মেরে যাচ্ছিলেন কেমন | অস্বস্তি হতে লাগল | হঠাৎই মনে হল আমার —এঁরা স্বামী স্ত্রী নন | আসেনও দুজনে দুজায়গা থেকে | কিন্তু আসা চাইই |
সেবার প্রতিদিনই কমবেশি বৃষ্টি নামছে সমুদ্রে | তাও যে কদিন ছিলাম একদিনও কামাই দেখিনি | বরের আলাপে জানলাম , রক্তে শর্করা বেড়ে গেছে বউয়ের | ডাক্তার হাঁটতে বলেছে নিয়মিত | বউ কিছুতে হাঁটতে চান না আর বর হাঁটাবেনই | কী নিবিড় আদরে যে না হওয়া বর তাঁর না হওয়া বৌয়ের মোটা আঙুলগুলোকে জড়িয়ে নিতেন ! ঢুকিয়ে নিতেন একদম মুঠি করে |
চলে আসার দিন আকাশ জুড়ে মেঘ | মেঘের নীচে সাগরে ঝাপটায় লাখ পায়রা | ফেনায় লুটোয় পালক | তীর ধরে ছাতা মাথায় হাঁটছে বর বৌ | সেদিন হাঁটবে না বলে পণ করেছে বুড়ি বৌ | একহাতে ছাতা সামলাতে সামলাতে তাকে বইছে বুড়ো বর | এ দৃশ্যে কোনো মহান কিছু আবিষ্কার করিনি | কিন্তু আজো আকাশে যখন মেঘ উপচোয় পায়রাসাগর দুমদাম আসে আমার সমুখে | কিনারায় দু পুতুল | সুখ আর দুখ | জীবন হয় না বিমুখ |
তিন :
আমি মহান নই | সে সাধ্যি কৈ আমার | সাধ আছে কেবল চলার পথে ছোট ছোট ভালোগুলোকে খুঁজে বেড়াবার | আর তারপর সেই খুঁজে পাওয়া ভালো মানুষ আর ভালো ঘটনাকে স্তূপ করে একটি ভালোপাহাড় বানাবার |
দুপুর রোদে হনহনিয়ে যাচ্ছিলাম সল্টলেকে মায়ের বাড়ি | পথের ওপর একটি সদ্য তৈরি হওয়া প্রাসাদ | বাড়িটির সারা গায়ে গণেশ হনুমানের মূর্তি দেখে নাক মুখ কুঁচকে পালাচ্ছিল ঘোর নাস্তিক ময়ূরী | ঈশ্বর খোঁজার আগ্রহটুকুও যার তৈরি হয়নি | হঠাৎ দেখলাম নীচে একটি বিরাট পরিষ্কার জালা | পাশে সেই বাড়ির মারওয়ারী মালিক | এই অব্দি চেনা দেখা দৃশ্য আমাদের | অবাক হলাম —যখন দেখলাম একই জালার জল তিনি হাঁকডাক করে বিলিয়ে চলেছেন ভদ্র অভদ্র সবাইকে | ভদ্র অভদ্র মতে মানে আমাদের চালিত মতে | দুচারটে মুসলিম মিস্ত্রীকেও দেখলাম বেশ যত্ন করে জল খাওয়াচ্ছেন ভদ্রলোক |
খচরামো করব বলেই জিজ্ঞাসা করলাম —কে শেখালে আপনাকে এসব ?
–কী সব ?
—-এই যে আপনার এই কায়দা মেরে অসাম্প্রদায়িক থাকার চেষ্টা !
—–বোন আমার চেষ্টা কেবল তোমাদের সবাইকে এই গরমের দুপুরে পেটপুরে জল খাওয়ানো | শিখিয়েছেন আমার ঈশ্বর |
এতো সাবলীল উত্তর শুনে ঝোঁক চাপল ভদ্রলোককে আরো অপ্রস্তুত করার | পাপীর পুন্যদৃশ্য অস্বীকার করার ইচ্ছে | বললাম —
—রাতে তো দোকানের গদিতে গিয়ে আটায় ভুষি মেলাবেন |
—- মিলাব তো | ওউ ভি করি | এও করি | জল খেয়ে ঠান্ডা হলে তো তোমরা কজন মানুষ !
আমার ভালোপাহাড়ে পাথর পড়লো আরো একটা | আমার একখন্ড রত্নপাথর |
পাহাড় গড়া শেষ হয়নি |
পাহাড় শেষ হয় না |
পাথর দেয়াটা বাকি রয়ে যায় |