দ্বিতীয় ভালোবাসা
মৈত্রেয়ী সিংহরায়
30.08.2021
সেদিন ছিল রবিবার। মনোরমা দেবী স্পেশাল ব্রেকফাস্ট লুচি কুমড়োর তরকারী বানাচ্ছেন। ঘরদোর ঝাড়াঝাড়ি করতে গিয়ে
একটু দেরীই হয়ে গেল। অনিমেষ বাইরে
ড্রয়িংরুমে বসে খবরের কাগজ উল্টাচ্ছেন।
মনোরমা দেবী রান্নাঘর থেকেই বলছেন “মিমিটা লুচি আর কুমড়োর তরকারি বড্ড ভালোবাসে। আমার খুব মন কেমন করছে
জানো। গতকাল ওরা কেউ ফোন রিসিভ
করল না!” বলতে না বলতেই শুনতে পেলেন
কলিংবেল বেজে উঠল,,,,,সবারে করি আহ্বান। তারপরই শুনতে পেলেন অনিমেষের গলা ” কি রে কি ব্যাপার, তুই!!
রমা দেখো কে এসেছে!”
মনোরমা তাড়াতাড়ি বাইরে এলেন।
” মিমি তুই!! ” দেখলেন বিশাল বড়ো সুটকেস নিয়ে মিমি হাঁফাতে হাঁফাতে ঘরে
ঢুকছে।
ভীষণ বুদ্ধিমতী মনোরমা দেবী। দ্রুত বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে এবং কোনো জিজ্ঞাসাবাদ না করেই মিমির কাছে গিয়ে বললেন ” আয় আয়,লুচি করেছি, কুমড়োর তরকারিও করেছি। ওয়াশ রুমে যা। একেবারে ফ্রেশ হয়ে নে।”
মেয়েটাকে বেশ বিধ্বস্ত লাগছে। চোখাচোখি হতেই অনিমেষকে ইশারা করে বললেন যেন অযথা কৌতূহল না দেখান। মিমি,অরণ্য দিল্লিতে থাকে। বছর খানেক হল বিয়ে হয়েছে। অরণ্য বেশ বড়ো একটা কোম্পানিতে চাকরি করে। মিমি সরকারি চাকরির পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। বড় স্যুটকেস দেখে বুঝলেন মিমি সরাসরি এখানে এসেছে। ওর মা-বাবার কাছে ওঠেনি।
মিমি স্নান সেরে দু’হাত দুদিকে দিয়ে
লাফাতে লাফাতে এসে মনোরমাকে জড়িয়ে
ধরে বলে ” মণি, আই লাভ ইউ।” সঙ্গে সঙ্গে
অনিমেষ বলেন “আর আমাকে?” আহ্লাদে
গদগদ হয়ে মিমি বলে ” আই লাভ ইউ বাবি।” মিমি অরণ্যের মা বাবাকে মণি ও বাবি বলে ডাকে। মনোরমা মনে মনে বেশ বুঝতে পারেন মিমি এখন একটা জলভরা
এক-খন্ড মেঘ। যে কোনো মুহূর্তে ধারাপাত
শুরু হতে পারে। তাই মিমির হঠাৎ করে চলে আসার গভীর গোপন রহস্য ছুঁতে মন চাইলেও ওঁরা এই ব্যাপারে নির্লিপ্ত থাকারই
চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
মনোরমা মিমির পছন্দের খাবার তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। অনিমেষ মিমির
সঙ্গে সাম্প্রতিক নানা ঘটনা নিয়ে গল্প জুড়ে
দিলেন। আর মনে মনে মেয়েটির বুদ্ধিমত্তার
প্রশংসা না করে পারলেন না, গোপনে এক অপার আনন্দ অনুভব করলেন– অরণ্যের জীবনসঙ্গী হিসেবে মিমি একেবারে পারফেক্ট। কিন্তু কি এমন হলো যে মিমি
ব্যাগপত্তর গুছিয়ে নিয়ে চলে এল!
দুপুরে খাবার টেবিলে বসে মিমি
নানারকম মজার মজার গল্প করতে লাগল।
মনোরমা তারই মধ্যে লক্ষ্য করলেন মিমির মনের মধ্যে নিরন্তর এক আকাশের মধ্যে যেন টুকরো টুকরো মেঘের ছবি।
বেজায় গরম। ভাদ্র মাস জানিয়ে
দিয়ে যাচ্ছে। মনোরমা রান্নাঘর থেকে বললেন ” মিমি নিজের ঘরে গিয়ে একটু
রেস্ট নিয়ে নে। পরে আবার কথা হবে।”
মিমি শুনতে পেল মণি, বাবিকে বলছে “হ্যাঁ গো, আমার তো কাল স্কুল। কন্যাশ্রী ঐক্যশ্রী
সব ফর্ম-ফিলাপ আছে। আমাকে তো যেতেই হবে। অন্যান্যবার মিমি অরণ্য একসঙ্গে থাকে আমার অসুবিধা হয় না।”
মিমি কিছু না বলে নিজের ঘরে চলে যায়।
মিমি চিকেন সসেজ কিনে এনেছে।
সন্ধেবেলা সেগুলো ফ্রাই করে। তিনজন মিলে খেতে খেতে লুডো খেলায় মেতে ওঠে। তখনও পর্যন্ত মিমি কেন চলে এসেছে এই নিয়ে কোনো কথা হয় নি। হঠাৎই অনিমেষের মোবাইল ফোন বেজে উঠল। দেখলেন অরণ্যের ভিডিও কল। মাকেও সে ফোনে যুক্ত করে। মিমি তাড়াতাড়ি মনোরমার কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে আঁচলটা মুখে চাপা দিয়ে নেয়।
মনোরমার কি মনে হল হঠাৎই-ই বললেন
” বাবু, মিমিকে একবার ডাকতো, জরুরী
কথা আছে।” অরণ্য থতমত খেয়ে যায়
বলে ” মিমি ব্যস্ত আছে মা। একটু পরে ডাকছি।” মনোরমা বলেন ” সত্যি বলছিস?”
মিমির মুখের থেকে আঁচল সরিয়ে বলেন
” এটা তবে কে বাবু।” অরণ্য চমকে ওঠে মিমি তাহলে ওর নিজের মা বাবার কাছে
যায়নি! বেশ একটা স্বস্তি অনুভব করে সে।
মাকে বলে “কিছুই হয়নি মা, ও যদি চলে যায় আমি কি করতে পারি!”
মিমি হঠাৎই তীব্র আর্তনাদ করে ওঠে। দু চোখ দিয়ে জলের বন্যা। এক নিঃশ্বাসে বলে যায়—–
“ও মিথ্যে কথা বলছে মণি…. বিশ্বাস করো.. সারাদিন ওয়ার্ক ফ্রম হোমের নামে
ঘরের দরজা দিয়ে বসে থাকে আর সন্ধেবেলা থেকেই শুরু করে দেয় অনলাইন
গেম…..অনেক রাত পর্যন্ত চলে সেই খেলা.. আমি যে একটা রক্তমাংসের মানুষ বাড়িতে
আছি সে খেয়াল কারো থাকে না….. কেউ আমাকে ভালোবাসে না….আমার বাবা-মা নয়…এমন কি তোমরাও না…আমার বাবা-মায়ের প্রথম ভালোবাসা দাদা…আর
তোমাদের প্রথম ভালোবাসা অরণ্য….আমি
কি বুঝি না… বুঝি,বুঝি সব বুঝি…. আমি
এসেছি বলে তোমার কত অসুবিধা…. তুমি
স্কুলে যেতে পারবে না….অরণ্য এলেও কি তুমি একই কথা বলতে মণি….একদিন কি
আমি তোমার অরণ্য হতে পারি না ………আমি জানি আমি মেয়ে। তাই সকলের দ্বিতীয়
ভালোবাসা…”——.বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়ে মেয়েটা। মনোরমা- অনিমেষ- অরণ্য সবাই চুপ। মনোরমার দু-চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পরে। মিমির মাথাটা বুকের বাঁদিকে চেপে ধরেন। তখনও মেয়েটা ফুঁপিয়ে চলেছে। এতো অভিমান!!! আস্তে আস্তে ওর চুলে বিলি কাটেন আর বলেন “মিমি আমার বুকের লাব-ডাব শব্দটা শুনতে পাচ্ছিস? লাব তুই আর ডাব অরণ্য। একটা শব্দে আঘাত লাগলেই আমি মরে যাব। ”
অনিমেষ ছেলেকে এস.এম.এস করলেন কালকের ফ্লাইটেই যেন অরণ্য বাড়ি আসে। কোনো অজুহাত গ্রাহ্য হবে না।
..