maitrayee sinharay

রাজলক্ষী বৃদ্ধাশ্রম
মৈত্রেয়ী সিংহরায়
01.09.2021

  সেদিন সকাল থেকেই ভীষণ মেঘ করেছে। আকাশ জুড়ে মেঘ ও হাওয়ার খেলা। অল্প অল্প বৃষ্টি। দক্ষিণের জানলাটা খোলা। ঝাপটা এসে পড়ছে ঋষির মুখে চোখে। মা,সুমিতা দেবী এসে তাড়াতাড়ি জানলা বন্ধ করতে গেলেন। ঋষি মায়ের  হাতটা ধরে ফেলে ” একটু খোলা থাক না মা।” মা বলেন “ছেলের কান্ড দেখো! বালিশ বিছানা সব ভিজে যাবে যে! যাকগে যা ভালো বুঝিস কর। আমি যাই বারান্দা থেকে কাপড়- সায়া তুলি। এই অসময়ে বৃষ্টি!” তুই তাড়াতাড়ি উঠে পড়। আজ তোর প্রথম অফিস!
কাপড় – সায়া! ঋষি ফিরে যায় বেশ
কয়েক বছর আগে। এমনই অসময়ে বৃষ্টি।
ঋষি পড়ছিল ঠাকুমার ঘরে। ঠাকুমা নিরুপমা দেবীও গড়াচ্ছিলেন নিজের বিছানায়। ঋষি কে বললেন ” ভাই আমার কাপড়- সায়াটা বোধহয় ভিজছে….একটু তুলে এনে দিবি?”
ঋষি ঠাকুমাকে জড়িয়ে ধরে আদর করে
কাপড়-সায়া তুলতে যায়। ঋষির মা দেখলেন ঋষি ঠাকুমার কাপড় তুলে এনে
ঠাকুমাকে দিচ্ছে। ঘরে ঢুকে কঠিন স্বরে
বললেন ” আপনাকে কতবার বলেছি যে ঋষির সামনে ফাইনাল পরীক্ষা, ওকে অনবরত ফরমাস করবেন না। আর তাছাড়া
আমার ছেলে আপনার ওই নোংরা কাপড়চোপড় তুলতে পারবে না। আপনি
নিজে উঠতে পারলেন না?”
নিরুপমাদেবী সেদিন কোনো কথা বলেন
নি। শুধু নাতির মাথায় হাত রেখে বলেছিলেন ” খুব ভালো করে পড় দাদুভাই।”
পরের দিন নিরুপমা দেবীর ছেলে সুকান্ত খাবার টেবিলে বসে মাকে বললেন ” মা তোমাকে একটা কথা বলার ছিল।” নিরুপমা দেবী বুঝলেন ছেলে কি কথা বলতে চাইছে। হেসে বললেন “বল্ না কি বলবি?”
ছেলে সুকান্ত  আমতা আমতা করে বলে “মা ঋষির সামনে পরীক্ষা। বুঝতেই তো পারছো কেমন প্রতিযোগিতা। আর তাছাড়া আমার তো মাত্র এই দুটি ঘর। ঋষির পড়াশুনার খুব অসুবিধা হচ্ছে। বলছিলাম ঢাকুরিয়ায় কয়েকজন বৃদ্ধা একসঙ্গে থাকেন…ঐ বৃদ্ধাশ্রমের মতন আর কি! তুমি যদি কয়েকদিন ওখানে গিয়ে থাকতে তাহলে আমাদের খুব সুবিধা হতো।” নিরুপমা দেবীর গলা দিয়ে খাবার নামতে চাইছিল না কিছুতেই। শুধু ঘাড় নেড়ে সম্মতির কথা জানালেন। ঋষি অনেক রাত পর্যন্ত ঘুমোয় নি। ঠাকুমার গা বরাবরই ভীষণ ঠান্ডা। আজ আরও বেশিরকমের ঠান্ডা মনে হচ্ছিল। ঠাকুমা মাথায় হাত রেখে বললেন ” ঘুমিয়ে পড়ো দাদুভাই। অনেক রাত হয়েছে। ভালো  করে পড়াশুনা করে মানুষ হও।”
তাড়াতাড়ি উঠে তৈরি হয়ে নেয় সে। আজ বেশ স্বাধীন মনে হচ্ছে নিজেকে। বুঝতে পারছে সাপের খোলস ছাড়ার মতো
তার পুরনো খোলসটা ধীরে ধীরে খসে যাচ্ছে। নতুন খোলস যা মানুষের দায়িত্ব নিতে ভালোবাসে। অন‍্যমনস্ক হলেই দেখছে
কেউ একজন তার জীবনের অনেকখানি
জুড়ে আছে।
মা ঠাকুরের ফুল নিয়ে এসে মাথায়
ছোঁয়ান আর বলেন ” খুব আনন্দ হচ্ছে  না রে!” ঋষি মনে মনে বলে ” মনকেমন করছে। কাউকে বলতে পারছি না। কে যেন
আমার  চারপাশে ঘোরাফেরা করছে। ভেতরে চঞ্চল বালকের মতো একটা অস্থিরতায় পাগল হয়ে উঠছি। ক্ষতবিক্ষত
হচ্ছি। আমার মনুষ‍্যত্বে হাতুড়ির ঘা পড়ছে।
কেমন একটা অপরাধবোধে ম্রিয়মাণ হয়ে যাচ্ছি মা।”
নিজেকে সামলে মা বাবাকে প্রণাম করে
অফিসে বেরিয়ে যায় ঋষি। অফিসে নতুন একটা অনুভূতি। কাজ বুঝে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সকলের সঙ্গে বেশ আনন্দে কাটল। কিন্তু মনের মধ‍্যে কে যেন বিড়বিড় করছে আজই আজই, তানাহলে অনেক  দেরি হয়ে যাবে।
বাড়ি ফিরতে বেশ দেরি হয়ে গেল।
কলিংবেল বাজতেই মা সুমিতা দেবী দরজা
খুলেই যেন আকাশ থেকে পড়লেন। বাঁ হাত
দিয়ে ঠাকুমাকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে
ঋষি। ঋষি একমুখ হেসে মাকে বলে ” মা
জানো, ঠাকুমার ‘মানুষ হও’ কথাটা বড় হতে
হতে আমাকে ক্রমশঃ গ্রাস করেছে। আমি
বাবার মতো হতে কোনোদিন চাই নি। আর
এইজন‍্যই তুমি কোনোদিন আমার কাছ থেকে কোথাও যাবে না। রাজলক্ষী বৃদ্ধাশ্রমে স্পর্ধা ভরে বলে এসেছি আমাদের বাড়ি থেকে  আর কোনোদিন কেউ এখানে  আসবে না। ”
নিরুপমাদেবী জীর্ণ হাতটি বৌমার
হাতের ওপর রেখে বললেন  “তোমাকে অনেক অভিনন্দন বৌমা। তুমি সত‍্যিকারের
মা, ছেলেকে মানুষ করতে পেরেছ। আমি তোমার কাছে হেরে গেছি। ভগবান তোমার
মঙ্গল করুন।”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *