সবুজ যখন ধূসর বর্ণে
(WHEN GREEN IN THE GRAY COLOR)
এম জাহিদুল হক
তারপর বহুদিন কেটে গেছে। পৃথিবীর বয়স এখন প্রায় ৪৬০ কোটি বছর। জন্মলগ্ন থেকে বহু যুগ পৃথিবী আচ্ছাদিত ছিল সবুজের সমারোহে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে বিনষ্ট হতে শুরু হলো পৃথিবীর প্রাকৃতিক সম্পদ। একসময়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে গৌরাম্বিত পৃথিবী আজ অনেকটাই প্রাকৃতিক দুর্যোগে আক্রান্ত; ম্লান হয়ে পরছে সবুজের ঔজ্জ্বল্য ও স্নিগ্দতা। পৃথিবী কিছুটা প্রাকৃতিক, কিছুটা মনুষ্যসৃষ্ট কারণে আজ ভয়াবহ ‘জলবায়ু পরিবর্তন’ সমস্যার মুখোমুখি।
বাড়ছে পৃথিবীর উষ্ণতা, বাড়ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফ্রিকোয়েন্সি। পৃথিবী দ্রুত
গরম হয়ে পড়ছে। অনেকটাই বদলে গেছে আমাদের বহু পরিচিত আবহাওয়ার আচরণ। বাংলাদেশের চির পরিচিত ঋতুতেও এসেছে লক্ষণীয় পরিবর্তন; বর্ষা কাল ছাড়াও বৃষ্টির পরিমান অনেক বেড়ে গেছে। ঝড় ঝঞ্জার প্রকোপও বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। তাপমাত্ৰা বৃদ্ধি পাওয়ায় উত্তর মেরুর বরফ দ্রুত গলতে শুরু করেছে – বাড়ছে সমুদ্রের উচ্চতা। পৃথিবীর অনেক নিচু অঞ্চলসহ বাংলাদেশেরও অনেক সমুদ্রতীরবর্তী অঞ্চল এবং দ্বীপ সমুদ্র গর্ভে সম্পূর্ণরূপে বিলীন হয়ে যাওয়ার আশংকায় রয়েছে। নদী ভাঙ্গন তীব্র হয়েছে। খরা, অতি বৃষ্টি, বন্যায় কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৃদ্ধি পাচ্ছে রোগ বালাইও।
বিগত ২০১৯ সাল হতে করোনা নামক ভাইরাস পৃথিবীতে বয়ে এনেছে এক নতুন দুর্যোগ; করোনা জনিত প্রচন্ড সংক্রামক কোবিদ -১৯ রোগের প্রকোটে মানুষের জীবন বিপন্ন।
কোবিদ-১৯ অতিমারী ছিনিয়ে নিয়েছে লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণ; প্রায় প্রত্যেকেই হারিয়েছে তাদের কোনো না কোনো আপনজনকে। এলোমেলো হয়ে গেছে মানুষের জীবন ও জীবিকা। বিনষ্ট হয়েছে মানুষ প্রতি মানুষের সম্প্রীতি ও ভালোবাসা।
তবুও থেমে যায়নি জীবন। জলবায়ু পরিবর্তন তথা বিশ্বের তাপমাত্ৰা নিয়ন্ত্রণের জন্য মানুষ একতাবদ্ধ হয়ে কাজ করে যাচ্ছে। জাতিসংঘ, কমনওয়েলথসহ বিশ্ব সংস্থা সমূহ পরিবেশ সবুজ যখন ধূসর বর্ণে বিপর্যয় ঠেকাতে এবং পরিবেশ সংরক্ষণের লক্ষ্যে গ্রহণ করেছে বিভিন্ন কর্মসূচি।
আমি এই গল্পের নায়ক। অবস্থার প্রেক্ষিতে আমার জীবনেও ছন্দ পতন ঘটেছে। হতাশা এখনো আমাকে গ্রাস করতে পারেনি। জীবনকে বাঁচিয়ে রাখতে আশায় বুক বেঁধে এগিয়ে চলেছি অজানা ভবিষ্যতের পথ ধরে। যদি জবাকে ফিরে পাই। জবার কথা পরে বলছি ।
আমি ঢাকায় একটি বেসরকারি হাসপাতালে নার্সিং সহকারী হিসেবে কর্মরত। তখন
আমাদের হাসপাতালে প্রচন্ড কোবিদ-১৯ রোগীর চাপ। প্রতিদিন শহরের বিভিন্ন প্রান্ত হতে অনেক মুমূর্ষ রোগী আসছিলো আমাদের হাসপাতালে।
অনেকেই চিকিৎসক এবং নার্সসহ হাসপাতালের সবার অক্লান্ত পরিশ্রম ও সেবা-যত্নে প্রাণে বেঁচে গেছে; আবার অনেকে মৃত্যুবরণও করেছে। যদিও কোবিদ-১৯ এর সুবাদে জাত-ধর্ম, ধনী-দরিদ্র দূরত্ব অনেকাংশেই কমে এসেছিলো তবুও মানুষ দ্বিধান্বিত ছিল এই ভয়ে যে কখন কে কোবিদ-১৯ আক্রান্তদের সংস্পর্শে এসে জীবনের ঝুঁকিতে পরে যায়।
যাই ঘটুক না কেন সময় ছুটে চলে তার আপন গতিতে। অসাধু মানুষের অসৎ ব্যাবসার অভিশাপ জীবনকে প্রভাবিত করলেও ভালো মানুষের মানবিক মূল্যবোধ তখনও বিলীন হয়নি। আমার মনে পড়ছে এক দিনের কথা। সেদিন এক অসহায় বৃদ্ধা কোবিদ রোগী মারাত্মক শ্বাস কষ্ট নিয়ে আমাদের হাসপাতালে এলো। ঐ সময় আমাদের কোনো আই সি ইউ বেড খালি ছিল না; অক্সিজেন সিলিন্ডারও ছিল না।
এমন সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় বেশ ক’ জন কোবিদ রোগী বৃদ্ধার সাহায্যে হাত বাড়ালো। তারা তাদের হাই-ফ্লো অক্সিজেন বৃদ্ধার সাথে শেয়ার করলো। বৃদ্ধার আপনজন বলতে কেউ ছিল না। ঢাকার একটি বস্তিতে ছিল তার বাসস্থান। ভিক্ষা করে ও প্রতিবেশীদের সাহায্য সহযোগিতায় তার জীবন চলতো। বৃদ্ধা হঠাৎ সবুজ যখন ধূসর বর্ণে করে অসুস্থ হওয়ায় প্রতিবেশীরা তাকে আমাদের হাসপাতালে নিয়ে আসে।
এতটা অসুস্থ থাকা সত্ত্বেও বৃদ্ধা তার স্নিগ্ধ ব্যাবহারে খুব অল্প সময়েই হাসপাতালের সকলকে আপন করে ফেলেন। ডাক্তারসহ আমরা সবাই বৃদ্ধাকে সুস্থ করে তোলার জন্য স্পেশাল কেয়ার নিচ্ছিলাম। সবার সেবা শুশশ্রুষায় বৃদ্ধা শিগ্রি সুস্থ হয়ে উঠেন। এটা ছিল আমাদের সবার জন্য খুবই আনন্দঘন একটি মুহূর্ত। ঐ দিন এতো স্ট্রেস এবং কষ্টের মাঝেও আমরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে ডাক্তার নার্স সবাই একসাথে নেঁচেছিলাম। একটি টিফিনের বাটি বাজিয়ে আমার লেখা একটা ‘RAP’ সংগীত এর তালে তালে সবাই নেচে গেয়ে ফুর্তি করেছিলাম; রোগীরাও দারুণভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিল, ওরাও আমাদের সাথে তাল দিচ্ছিলো –
করোনা, তুমি এসেছো
কোনো এক ভিন গ্রহ থেকে
মানুষকে জ্বালাতে, কিন্তু-
করোনা তুমি কখনই জিতবে না।
ভ্যানিশ করা হবে তোমাকে-
করোনা তুমি কখনই জিতবে না।
ফিরতে হবে তোমার নিজ গ্রহে-
করোনা তুমি কখনই জিতবে না।
আমাদের মনোবল দৃঢ়
রয়েছে ভ্যাকসিন অস্ত্র
করোনা তুমি কখনই জিতবে না।
সবুজ যখন ধূসর বর্ণে
আজ সকাল থেকেই টিপ্ টিপ্ করে বৃষ্টি ঝরছিল। হোস্টেল হতে হাসপাতালে যাওয়ার জন্য তৈরী হচ্ছিলাম। গত রাত্রে প্রায় ৪ টার সময় ডিউটি শেষে রুমে এসেছি। এক কলিগ-এর শরীরটা হটাৎ একটু খারাপ হয়েছিল। তাই তার ডিউটিটাও আমাকে করতে হয়েছে । আমরা সবাই প্রায় ২৪ ঘন্টাই কাজ করি। আমাদের হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ হাসপাতালের পাশেই একটি বাড়ি ভাড়া করে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলো — এক দিকে পুরুষ, অন্য দিকে মহিলা নার্সরা থাকতো।
সকালে বিছানা ছাড়তে আজ একটু আলসেমি লাগছিলো। সারাদিন পি পি ই, মাস্ক, হ্যান্ড গ্লাভস পরে কাজ করতে খুব কষ্ট হতো। অবশ্য আমরা এসব কষ্ট গ্রাহ্য না করেই একনিষ্ঠ চিত্তে রোগীদের সেবা প্রদান করতাম। বৃষ্টি বরাবরই আমার খুব ভালো লাগে । যদিও বৃষ্টি বয়ে আনে দরিদ্র মানুষদের জন্য দুঃখ দুর্দশা। তবুও বৃষ্টি এলে আমার মনে প্রবাহিত হয় এক অনাবিল প্রশান্তি ও জীবন বার্তা। নাহঃ, আর দেরি করা যাবে না। তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।
আমাদের হোস্টেল থেকে হাসপাতালের দূরত্ব অতি সামান্য। দৌড়েই চলে যাওয়া যায়। হটাৎ পাশের নর্দমা থেকে কুকুরের কান্নার আওয়াজ ভেসে এলো। এগিয়ে যেয়ে দেখি একটি সাদা রঙের সুন্দর কুকুর নর্দমার নোংরা পানিতে পরে আছে। তার পুরো শরীরটা নোংরা পানিতে ভিজে গেছে । এই করোনা অতিমারীর সময়ে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণী সবাই একটি ভয়াবহ দু:সময় অতিক্রান্ত করছে। এতো সুন্দর কুকুরটা এই নর্দমায় এলো কি করে ? ভাবলাম, মনে হয় কারো পালিত অথবা মালিক এটিকে পরিত্যাগ করেছে । হায়রে, বেচারা হয়তো ক’ দিন সবুজ যখন ধূসর বর্ণে ধরে কিছু খায়নি। যা হোক, অনেক কষ্ট করে কুকুরটিকে নর্দমা হতে উদ্ধার করলাম।
হাসপাতালের গেটে এ স্থাপিত কলের পানি এবং সাবান দিয়ে তাকে পরিষ্কার পরিছন্ন করলাম।
এখন কুকুরটাকে একটু উষ্ণতার মাঝে রাখতে হবে। কিছু খাবারের ব্যাবস্থাও করতে হবে। আমার বরাদ্দকৃত নাশতাটুকু তাকে খাওয়ালাম। কুকুরটি প্রচন্ড ক্ষুদার্থ ছিল। নিমিষেই সব কিছু খেয়ে ফেললো। হাসপাতালের গার্ডকে বলে ওর একটা থাকার ব্যাবস্থাও করে দিলাম।
সত্যি কথা বলতে কি, কোবিদ অতিমারীর কারণে আজকাল মানুষের ফেলে দেওয়া উচ্ছিষ্ট খাবারও পাওয়া যায় না ডাস্টবিন গুলোতে। ফলে স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়ানো কুকুর, বেড়ালগুলোকে প্রায় না খেয়েই দিন যাপন করতে হচ্ছে। এই কঠিন সময়ে অসহায় মানুষগুলোর সাথে সাথে প্রাণীগুলোর প্রতিও দয়াশীল হওয়া প্রয়োজন। কষ্ট করে হলেও ওদের জন্যও কিছু খাবারের ব্যবস্থা করা আমাদের মানবিক দায়িত্ব।
তারপর কখন যে দিনের কাজ কর্মে ডুবে গেছি নিজেও জানি না। দিন শেষে যখন হোস্টেলে গেলাম তখন রাত প্রায় দশটা। আজও নাইট ডিউটি করতে হবে। তাড়াতাড়ি কিছু খেয়ে আবার হাসপাতালে যাওয়ার জন্য রেডি হলাম। হটাৎ মোবাইল ফোনটি বেজে উঠলো –
দেখলাম মা ফোন করেছে।
— মা, কেমন আছো? বাবা ও সুমি কেমন আছে ? সুমি আমার অত্যন্ত আদরের ছোট বোন।
–আমি ভালো, ওরা সবাই ও ভালো আছে। তুই কেমন আছিস বাবা ? নিজের খাওয়াদাওয়া, স্বাস্থ্যের প্রতি নজর রাখছিসতো?
— হ্যাঁ, মা। তুমি এ ব্যাপারে কোনো চিন্তা করবে না। তুমি সাবধানে থেকো এবং বাবা ও সুমির প্রতি নজর রেখো।
স্যার, ৭ নং বেডের রোগীটা ডাকছে – ওয়ার্ড বয় এসে জানালো।
সবুজ যখন ধূসর বর্ণে –মা, আমি এখন রাখছি। পরে আবার কথা হবে।
হাসপাতাল থেকে হোস্টেলে ফিরেছি। গেট এ সিকিউরিটি গার্ড একটি পার্সেল প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে বললো – স্যার, ডাক পিয়ন এটা দিয়ে গেছে। একটু আশ্চর্য হলাম কারণ প্যাকেটটি চেনা চেনা লাগছিলো। তাইতো এটাতো আমারই প্রেরণ করা পার্সেল প্যাকেট। ক ‘দিন আগে এখানকার স্থানীয় পোস্ট অফিস থেকে আমি এই পার্সেলটি পাঠিয়েছিলাম জবার নাম এ –ওদের ঠিকানায়। জবা একটি বই পাঠাতে বলেছিলো – মেডিক্যাল ভর্তির প্রিপারেশন গাইড। ও এখন এইচ এস দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। ছোট বেলা থেকেই ওর ডাক্তার হওয়ার খুব সখ ছিল। আর তাই সে অত্যান্ত মনোযোগ সহকারে পড়াশোনা করছিল। অবসর সময়ে মেডিক্যাল কলেজ এ ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। লকডাউন থাকা সত্ত্বেও সুমির ফরমাইশকৃত বইটি আমি আমার এক বন্ধুর বইয়ের শপ থেকে সংগ্রহ করেছিলাম। কিন্তু কেন এটা ফেরত এলো তা আমার বোধগম্য হচ্ছিলোনা।
জবা ছিল আমার ঘনিষ্ট বন্ধু। বয়সে আমার ছোট হলেও আমরা একজন ছিলাম আরেকজনের পরিপূরক। গ্রামের নির্মল পরিবেশে আমরা বড় হয়েছি। গ্রামের অন্য মানুষগুলোর মতো আমাদের মনও ছিল নির্মল; আমাদের চাওয়া-পাওয়ার মাঝে ছিল ভারসাম্য, খুব অল্পতেই আমরা সন্তুষ্ট। আমাদের রয়েছে অনেক সবুজ এবং সতেজ স্মৃতি। আমি সবসময়ে জবাকে উৎসাহিত করতাম এবং ওকে ওর অভীষ্টে পৌছার জন্য সর্বপ্রকার সহযোগিতা করে আসছিলাম। প্যাকেটটি উল্টে পাল্টে দেখলাম – ওদের গ্রাম থেকে বেশ দূরে অবস্থিত একটি পোস্ট অফিস পার্সেলটি ফেরত পাঠিয়েছে। প্যাকেট এর উপরে ফেরত সিলমোহর দিয়ে সবুজ যখন ধূসর বর্ণে লেখা-“প্রাপকের ঠিকানা খুঁজে পাওয়া যায়নি “।
সেটা কি করে সম্ভব ? পার্সেল প্যাকেট-এ তো আমি সঠিক করেই জবার নাম ও ঠিকানা
লিখেছিলাম। তবুও পার্সেলটি ফেরত এলো কেন ? বিষয়টি ভাবতে ভাবতে আমি গভীর চিন্তায় হারিয়ে গেলাম। অনেক কিছুই মনে আসছিলো………..
আমরা ও জবারা পদ্মা পারের বাসিন্দা। জবাদের গ্রামটি ছিল আমাদের দু ‘তিনটি গ্রামের
পরে। আমাদের গ্রামগুলো ছিল অনেক সুন্দর, শ্যামল সবুজ ছবির মতো। পদ্মা নদীর তীর
ঘেঁষে হলেও অনেক গ্রামেই ছিল নদী হতে অনেকটা দূরে। অবশ্য জবাদের গ্রামসহ আরো
ক’ টি গ্রাম পদ্মার গা ঘেঁষে ছিল। তবে তখন নদীর কোনো ভাঙ্গন ছিল না। নৌকাই ছিল
আমাদের প্রধান যান-বাহন। জবাদের পরিবারের সাথে আমাদের পরিবারের সম্পর্ক ও সখ্যতা ছিল দীর্ঘ দিনের। আমার বাবা একজন পল্লী চিকিৎসক আর জবার বাবা স্কুল শিক্ষক; তাঁদের মাঝে ছিল ঘনিষ্ট বন্ধুত্ব। দুই পরিবারের মধ্যে ছিল আত্মীয়তার চেয়েও দৃঢ় বন্ধন।
আমি ছিলাম আমার পরিবারের বড় ছেলে। আমাদের পরিবারের মোট সদস্য সংখ্যা ৪ জন –
বাবা, মা, আমি আর আদরের ছোটবোন সুমি। বাবা বেশির ভাগ চিকিৎসাই করতেন বিনা
পয়সায়। মানুষের কল্যাণ করাই ছিল তাঁর একমাত্র কাজ। গ্রামের সবাইকে বাবা প্রাণ দিয়ে
ভালোবাসতেন। বিপদে আপদে সবসময় মানুষের পাশে দাঁড়াতেন। এমনকরে বাবার আয়-
রোজগার ছিল অতি সামান্য। এই সীমিত আয়ে বাবা কোনোরূপে সংসার চালিয়ে আমার এবং ছোট বোন সুমির শিক্ষার খরচ যোগাতেন। তবে বাবা ছিলেন গ্রামের সবার অত্তান্ত প্রিয়,
সবুজ যখন ধূসর বর্ণে আপনজন। সবাই বাবাকে খুব ভালোবাসতো এবং শ্রদ্ধা করতো।
আমারও খুব ইচ্ছে ছিল ডাক্তারি পড়ে ডাক্তার হবার।
কিন্তু বাবার স্বল্প আয় দিয়ে ডাক্তারি পড়া সম্ভব ছিল না। আর পরিবারের বড় সন্তান হওয়ায় সংসারের যাবতীয় দায়িত্ব আমার উপরেই বর্তায়। তাই এস এস সি পাশ করে ঢাকার একটি নার্সিং স্কুল এ ভর্তি হই। তারপর একদিন ভালোভাবে পাশ করে ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে নার্সিং সহকারীর চাকুরিও পেয়ে যাই। আমাদের জীবন লাভ করে নতুন গতি। আমি আয়ক্ষম হওয়াতে আমাদের পরিবারেও সচ্ছলতা ফিরে এলো। আমি ডাক্তার হতে না পারলেও আমার প্রচন্ড আশা জবা ডাক্তার হোক। আর জবার ডাক্তার হতে আমি সর্বাত্মক সহায়তা দিয়ে যাবো।
–আরে দোস্ত, আজ হাসপাতালে যাবিনে ? রুম-মেট এর কথায় বাস্তবে ফিরে এলাম। –চল
যাই, দেরি হয়ে গেলো।
এরপর আরো কিছুদিন কেটে গেলো। কোবিদ-১৯ এর প্রকোপ কিছুটা স্থিমিত হয়েছে।
লকডাউনও শিথিল করা হয়েছে। তবে একটি কথা সবাইকে মনে রাখতে হবে –কোবিদ এর
প্রকোপ কমে এলেও সাধনতামূলক নিয়মসমূহ, যেমন- ফেস মাস্ক পরা, ভীড় ও জনবহুল
স্থানগুলো থেকে দূরে থাকা, হাত ধোয়া, ইত্যাদি আরো অনেকদিন ধরে মেনে চলতে হবে।
কোবিদ এর প্রকোপ কমায় জীবন আস্তে আস্তে ধূসর বর্ণ থেকে সবুজ বর্ণে রূপান্তরিত
হতে শুরু করেছে। প্রকৃতিতে বসন্তের ছোঁয়া লেগেছে। জীবনের এখন আবার জেগে উঠার
পালা।
ভাবছিলাম ছুটি নিয়ে একবার বাড়ি থেকে ঘুরে আসবো। অনেক দিন বাবা, মা, বোনের সাথে
দেখা হচ্ছে না। আর জবার পার্সেলটা কেন ফেরত এলো, তা জানাও খুব দরকার। মা কে
সবুজ যখন ধূসর বর্ণে
একটা ফোন করা উচিত। মা এর নম্বরটা ডায়াল করলাম। মা প্রথম রিঙেই ফোন ধরলেন।
–মা, তোমরা কেমন আছো ?
–খুব ভালো না বাবা। তোর বাবার শরীরটা ক’দিন থেকে ভালো যাচ্ছেনা।
–বাবার কি হয়েছে মা ?
মা জানালেন বাবার নাকি খুব জ্বর-সর্দি-কাশি ইত্যাদি । বুকটা অজানা আশংকায় কেঁপে
উঠলো। বাবার কোবিদ-১৯ হয়নিতো ?
গত এক মাস ধরে বাবা অনেক মুমূর্ষু রোগীর চিকিৎসা করছিলেন। এদের মধ্যে বেশ ক’জন
কোবিদ পজিটিভও পাওয়া গিয়েছে। কয়েক জনের মৃত্যুও ঘটেছে। বাবা তাঁর সীমিত চিকিৎসা ব্যবস্থার মাধ্যমে এসব রোগীকে সাহায্য করছিলেন। ইতোমধ্যে অনেককে সদর হাসপাতালেও প্রেরণ করেছেন।
বাবার অবস্থা ক্রমেই খারাপ এর দিকে এগুচ্ছিলো। স্থানীয় চিকিৎসক বাবাকে ঢাকায় নিয়ে
যাবার পরামর্শ দিয়েছেন। কষ্ট করে হলেও বাবাকে একটি এম্বুলেন্স রিসার্ভ করে ঢাকায়
রওয়ানা দিতে বললাম। মাকে কিছু টাকাও পাঠিয়ে দিলাম।
বাড়িতে যাওয়া বাতিল করে আমি বাবার চিকিৎসা, মা বোনের থাকার ব্যবস্থা করতে শুরু
করলাম। সারা দিন কাজ করতে করতে খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। রুমে এসে বিশ্রাম
সবুজ যখন ধূসর বর্ণে নিচ্ছিলাম। শরীরটা কেমন মেজ মেজ করছে। মাঝ রাতে প্রচন্ড জ্বর এলো। আমি ভয় পেয়ে আমার ইনচার্জ ডাক্তার সাহেবকে ফোন দিলাম –“স্যার, আমার শরীরটা খুব অসুস্থ লাগছে “। তিনি আমাকে জরুরী ভিত্তিতে হাসপাতালে ভর্তি হতে বললেন। আরটি-পি সি আর টেস্টে আমার কোবিদ-১৯ পজিটিভ এলো। আমার অবস্থার দ্রুত অবনতি হলো। আমাকে আই সি ইউ তে স্থানান্তর করা হলো।
ক’দিন কি ভাবে কেটেছে আমি জানি না। যা হোক, সৃষ্টিকর্তার অসীম অনুগ্রহে, ডাক্তার এবং
আমার বন্ধু সহকর্মীদের অক্লান্ত প্রচেষ্টা ও পরিচর্যায় ২0/২৫ দিনের মাথায় আমি অনেকটা
সুস্থ হয়ে উঠি। কোবিদ-১৯ টেস্টও নেগেটিভ হয়েছে। সেড়ে উঠলেও আমি খুবই দুর্বল হয়ে
পড়েছিলাম। বাবা কেমন আছেন ? অনেক দিন কোনো খবর নেয়া হয়নি। রুমমেটকে
জিজ্ঞেস করলাম -মা ফোন করেছিল কি ?
বাবার কোনো সংবাদ আছে ? কিন্তু সে কিছুই বললো না। শুধু বললো–আগে সুস্থ হো, পরে এসব নিয়ে ভাবিস। আর থাকতে পারলাম না, মা কে ফোন করলাম। মা ফোন ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন, কিছু বলতেই পারলেন না। পরে ছোটবোন সুমি অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে বললো–ভাইয়া, বাবা আর নেই। বাবাকে ঢাকায় পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়েছিল কিন্তু যাত্ৰার আগের রাতে তিনি আমাদের সকলকে দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে পরপারে চলে গেছেন।
বাবার অকাল মৃত্যুতে আমার মনে প্রচন্ড আঘাত লেগেছে। বাবার জন্য আমিতো কিছুই
করতে পারলাম না। সারা জীবন আমাকে এই কষ্ট নিয়ে বাঁচতে হবে।
সবুজ যখন ধূসর বর্ণে
মাকে আমার রুমমেট আমার কোবিদ-১৯ এ আক্রান্তের হওয়ার খবর দিয়েছিলো। মা বোন
আসতেও চেয়েছিলো। কিন্তু গ্রামের মুরুব্বিরা তখন যেতে নিষেধ করে। কারণ আমার
অবস্থাও তখন অত্যন্ত খারাপ ছিল। এমতবস্থায় ওদের ঢাকায় আসা আর হয়নি। বাবার মৃত্যুতে মা সম্পূর্ণরূপে ভেঙ্গে পড়েছিলেন। মা ও সুমির কাছে মনে হচ্ছিলো এটাই বুঝি ‘এন্ড অফ লাইফ ‘।
আমার মন আর ঢাকায় থাকতে চাইছিলো না। মনে হচ্ছিলো, হয়তো আর কোনোদিনই
স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারবো না। কিন্তু যে কোনো দুর্যোগকালে মহান বিধাতা
মানুষকে বেঁচে থাকার শক্তি দান করে থাকেন। ক’দিনের মধ্যেই বাড়ির উদ্দ্যেশে রওনা হয়ে
যাই।
মা ও সুমি আমাকে পেয়ে অনেক কান্না-কাটি করলো। ওদের সান্তনা দেয়ার কোনো ভাষা
আমার ছিল না। তবুও আমি যথাসম্ভব নিজেকে সামলে নিলাম। এক পর্যায়ে মা ও সুমিকে
জবার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। ওরা জানালো যে অনেকদিন ধরেই জবাদের সাথে
যোগাযোগ নাই। জবার মা-বাবা অনেকদিন ধরে সুমিদের বাড়িতে আসছেন না। এমনকি
বাবার মৃত্যুতেও আসেনি। খোঁজ করেও জবাদের কোনো খবর পাওয়া যায়নি।
জবারা তবে গেলো কোথায় ? মাকে জবার বরাবরে প্রেরিত পার্সেল ফেরত আসার ঘটনাটি
জানালাম। আরো জানালাম যে বেশ কিছু দিন ধরে জবার সাথে ফোন এ কথাও হচ্ছে না;
আমি করলেও ফোন কল যায় না। মা বললেন জবাদের গ্রামে নিজে যেয়ে খোঁজ নিয়ে
আসতে।
সবুজ যখন ধূসর বর্ণে
পরদিন অপরাহ্নে একটি নৌকো করে জবাদের গ্রামের উদ্দেশ্যে যাত্ৰা করলাম। পদ্মায় বেশ
স্রোত। আমাদের নৌকোটি স্রোত ভেঙে ভেঙে সামনে এগিয়ে চললো। মানষপটে ভেসে
উঠছিলো গ্রামের সেই সোজা, সরল, সদা প্রাণোচ্ছল মেয়েটির সুন্দর অবয়ব। আমার সারা মন জুরেই ছিল জবা, শুধু জবা। জবা ছাড়া আমার জীবনে আর কাউকে ভাবতেও পারি না।
ঘন্টা খানেকের মধ্যেই আমরা জবাদের গ্রামের কাছাকাছি পৌছে গেলাম। কিন্তু কোথায়
জবাদের সেই ছায়ানীড় সবুজ গ্রাম ? চারিদিকে শুধু পানি আর পানি, অথৈ জল।
বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। সমগ্রহ দেশ জুড়েই রয়েছে বিভিন্ন নদী ও শাখা নদী। সম্ভবত
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ইদানিং বিভিন্ন নদীর ভাঙ্গন তীব্রতর হয়েছে। পদ্মা নদীর ভাঙ্গনে অনেক গ্রাম নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। অনুসন্ধান করে জানা গেলো–কিছুদিন আগে তীব্র ভাঙ্গনের মুখে জবাদের সম্পূর্ণ গ্রামই নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। গ্রামের বসত বাড়ি, স্কুল, মসজিদ, মন্দির, হাট-বাজারসহ সবকিছুই নদী কেঁড়ে নিয়েছে।
পোস্ট-অফিসসহ বেশ ক’টি সরকারি দফতর স্থানপরিবর্তন করে অন্য গ্রামে যেয়ে দৈনন্দিন কাজ-কর্ম চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। যেহেতু জবাদের গ্রাম নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে সেহেতু জবার নাম-এ আমার প্রেরিত বই-এর পার্সেলটি ওর ঠিকানা খুঁজে না পাওয়ায় ফেরত গিয়েছিলো। অনেক চেষ্টা করেও জবা ও তাদের পরিবার কোথায় চলে গিয়েছে তা জানা গেলো না।
একদিকে বাবার মৃত্যু শোক অপরদিকে জবার হারিয়ে যাওয়া, আমার মনটাকে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত করেছে। কে জানে জবা ও তার বাবা-মা বেঁচে আছেন না উন্মত্ত পদ্মা তাদেরকেও গ্রাস করেছে ?
সবুজ যখন ধূসর বর্ণে
মনটা অত্যন্ত ভারাক্রান্ত। তখন সন্ধ্যা প্রায় ঘনিয়ে আসছিলো। আকাশে মেঘ করেছে; হয়তো বৃষ্টি আসবে। আজ বৃষ্টির আগমন মনটাকে তেমন পুলকিত বা রোমাঞ্চিত করছিলো না। মনে হচ্ছিলো বিষাদের ছায়া পুরো পৃথিবীটাকে ছেঁয়ে ফেলেছে। দূরে কোনো মাঝি আপন মনে গেয়ে নৌকোর দাঁড় বইছিলো —
“সর্বনাশা পদ্মা নদী-
তোর কাছে শুধাই…… “
মনে হচ্ছিলো গোধূলির শেষ লগ্নের মতো আমার জীবন লগ্নও হয়তো শেষ প্রান্তে পৌছে গেছে, ভাবছিলাম, পদ্মা তীরে আবার কি কোনোদিন আমার জবাকে ফিরে পাবো ?