
লালন ফকিরের গান ও জীবন দর্শন
[Lalon Fakirs’ songs and philosophy of life]
সংকলন
সুভাষ চন্দ্র সূত্রধর
ভূমিকা
সাধক লালন ফকির(১৭৭২-১৮৯০ইং) ছিলেন একজন কায়াবাদী মানুষ। তিনি ছিলেন লোকধর্মের প্রবর্তক। লোকধর্মের মানুষদের পা মাটিতে থাকলেও জীবন বোধ বা জীবন দর্শন থাকতো উপরের দিকে। অর্থাৎ এঁদের জীবন বোধ স্রষ্টার সাথে সম্পর্কযুক্ত। এঁরা জীবনকে ভোগ করেন বিচিত্র ওঠা পড়ার দ্বন্দে ও ছন্দে। এঁরা প্রচলিত মতবিশ্বাসের ঊর্ধ্বে উঠে আমৃত্যু তাঁদের লোকধর্ম টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করে যান। এঁরা অনেক ক্ষেত্রেই সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন বা উপেক্ষিত। কিন্তু কখনো কখনো আবার হয়ে ওঠেন সমাজের পরম পূজনীয়। ফকির লালন ছিলেন তাঁদের মধ্যে একজন। তাঁর মতে, অধরা সত্ত্বা (যে সত্ত্বাকে ধরা যায় না/পরমাত্মা/স্রষ্টা) মানুষকে সৃষ্টি করেনি, মানুষই অধরা সত্ত্বাকে সৃষ্টি করেছে। আর এখানেই প্রচলিত মতবিশ্বাসের সাথে তাঁদের দর্শন বা লোকধর্মের দর্শন সাংঘর্ষিক। তবে সৃষ্টি তত্ত্বের বিষয়টি যেহেতু রহস্যাবৃত। তাই কোনটি যে সঠিক পথ বা মত তা একমাত্র বিধাতাই জানেন।
The great sage Socrates used to say,
‘Only God knows if it will be good for us.’
According to Vedic philosophy, ‘The Nature is the source of power of the Universe.’
সুতরাং একথা অনস্বীকার্য বিষয়টি অবশ্যই রহস্যাবৃত ও অমীমাংসিত। লালনের লোকধর্মের দর্শন সনাতন ধর্মের গুরুবাদী (Guruism) দর্শনের কিছুটা সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়। ‘গুরু’ হলেন তিনি, যিঁনি শিষ্যের অজ্ঞান রূপ সকল অন্ধকার দূরীকরণে সমর্থ এবং শিষ্যকে ইহকাল ও পরকালের পথের সন্ধান দিতে পারেন। মূলত এখানে গুরু বলতে পরমগুরু বা স্রষ্টাকে বুঝানো হয়েছে। লালন ফকির যাঁকে ‘সোনার মানুষ’ হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। সেই অধরা সোনার মানুষের সন্ধান যিনি পান, তাকে আর জাগতিক চাওয়া পাওয়ার কথা চিন্তা করতে হয় না। তিনি পরমপদ লাভ করেন। আর এটাই সম্ভবত মানব জীবনের পরম লক্ষ্য।
কাজেই লালন ফকিরের দর্শন চিন্তা আধ্যাত্বিকতায় পরিপূর্ণ।
লালন ফকিরের বাউল তত্ত্বঃ
লালন ফকির ছিলেন বাউল মতাবলম্বী। তাঁর এ বাউল মত তাঁর নিজস্ব এবং তা মানবতাবাদী ও শাস্ত্র নিরপেক্ষ। আর তাঁদের ধর্মমত হলো মানব ধর্ম। যার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলো মানবপ্রেম। বাউল তত্ত্বের বীজমন্ত্র হলো ‘প্রকৃত মানুষকে খুঁজে বের করা।’ আর প্রকৃত মানুষকে খুঁজে পেলেই সিদ্ধি সাধনের পূর্ণতা পাওয়া যায়। তাই তো লালন বলেন,
‘প্রকৃত মানুষের সন্ধানে মানুষের প্রেমে মজেছেন।’
লালন ফকির মতাদর্শে সর্ব মতবিশ্বাসের সমন্বয় পাওয়া যায়। যেমন –
‘রাম, রহিম, করিমকালা,
এক আল্লাহ জগৎময়।’
এক্ষেত্রে শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের অমিয় বাণী –
‘যত মত, তত পথ।’
ইহার সাথে বা সর্ব ধর্মের সমন্বয়ের বাণী এর দর্শনের সাথে কিছুটা মিল খুঁজে পাওয়া যায়।
Ramakrishna Poramhangsh Dev used to say,
‘As much as the way’ means the tactics of knowing can be different but the knowing things are identical.’
অর্থাৎ জানার বস্তু এক কিন্তু তাঁকে জানার বিভিন্ন পথ থাকতে পারে। আর বিভিন্ন মতাদর্শগুলি হলো একেকটা পথ। অর্থাৎ ঈশ্বর এক।
According to Hinduism,
‘The Debota’s are the symbols of the various power of God. That’s multiple expressions in One.’
লালনের মতাদর্শে বারবারই মানুষকে জাতপাতের ঊর্ধ্বে উঠার কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ মানুষকে প্রকৃত মানুষ হয়ে ওঠার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। এটাই বাউল তত্ত্বের মূখ্য দর্শন।
কবিয়াল অসীম সরকার বলেন –
‘জাত থাকে কতক্ষণ,
মানুষ না হয় যতক্ষণ।’
অর্থাৎ যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা জাতপাতের বা বিশেষ কোনো মতাদর্শের উর্ধ্বে ওঠতে না পারবো বা প্রকৃত মানুষ হতে না পারবো ততক্ষণ আমাদের পরম মুক্তি মিলবে না। আর বাউল সম্প্রদায় সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে উঠে বিশ্বমানবতার প্রেমে মজেছেন। যার মূল হলো মানব প্রেম বা মানুষকে ভালোবাসা।
তাই তো স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন –
‘জীবে প্রেম করে যেই জন,
সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।’
আর এ ব্যাপারে লালন ফকিরের বক্তব্য অত্যন্ত স্পষ্ট ও শক্ত।
‘সবাই বলে লালন ফকির হিন্দু কি যবন ;
লালন বলে, আমার আমি না জানি সন্ধান।
এক ঘাটেতে আসা যাওয়া ;
একই পাটনী দিচ্ছে খেয়া,
তবে কেউ খায় না কারো ছোঁয়া।
ভিন্ন জল কোথায় পাস?
লালন ফকির ছিলেন আধ্যাত্বিকতার প্রতীক। তাঁর গানের বাণী যেন ‘মানুষের শাশ্বত অন্তরাত্মার প্রতিধ্বনি।’ সেই ধ্বনি মানুষের হৃদয়ে যে প্রশ্নের উদ্রেক করে। তা হলো-
‘আমি কে? আমি কি আমার ভিতরের পাখিটারে বশ মানতে পেরেছি?
এই পাখিটাই হলো জীবের আত্মা। লালন বলেন –
‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি,
কেমনে আসে যায়?–।’
অথবা,
‘ক্ষ্যাপারে তুই না জেনে তোর আপন খবর যাবি কোথায়?
আপন ঘর না বুঝে বাইরে খুঁজে পড়বি ধাঁধায়। –।’
লালনের এ আত্মার ধারণা সনাতন ধর্মের সাথে কিছুটা সাদৃশ্য পাওয়া যায়। সনাতন হিন্দু ধর্মের মতানুসারে,
‘Which located inside the body but in extra and which can’t be proveded that entity. It’s called the human soul. God is called the Supreme soul.The Supreme soul is the manifestion of fullness. But the human soul is the part of the Supreme soul. And the body is living organism.
উপসংহারঃ
লালন ফকির ছিলেন মানুষের আত্মশুদ্ধির অনন্য শিক্ষক। তাই আমাদের আত্মশুদ্ধির জন্য লালনের গানে আশ্রয়ের কোনো বিকল্প নেই। তিনি সকল প্রকার সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে উঠে, সমাজের অস্পৃশ্যতা, ধর্মীয় গোঁড়ামী ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধ কড়া বার্তা দিয়েছেন তাঁর গানের মাধ্যমে। তিনি ছিলেন প্রকৃতপক্ষে মানবতার ধারক ও বাহক। যাঁরা দেবতার মূর্তি তৈরি করেন নাই, মসজিদ তৈরি করেন নাই, শাস্ত্র তৈরি করেন নাই। যাঁরা শুধু গান তৈরি করে ও গানের সুরে মানবতার জয়গান করে গেছেন। জয় হোক লালন দর্শনের, জয় হোক বিশ্বমানবতার।
সমাপ্ত
Excellent work. 🙏🙏🙏